পেঁচো মাতালের এক সমস্যা হল, সে নালাতে পড়বেই। সে নালা দেখতে পায় না তা নয়, সে নালার উপর দিয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টাও করে, কিন্তু শেষপর্যন্ত নালায় পড়ে, পড়ার পরেই তার প্রথম কাজ হল, নালাটা কত বাজে, তা জনে জনে বলা। সে যে নালায় পড়েছে, এটা তার দোষ নয়, নালাটা বড্ড বেখাপ্পা, বাজে, তাই সে নালায় পড়েছে, এটাই সে মানুষজনকে বোঝায়, অন্তত বোঝাতে চায়।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ধরণ ধারণ তেমনই, তিনি বোঝাতে চান, মানুষ বোঝে না। একবার নয়, দু বার নয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইস্তক তিনি দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু দেশের মানুষ এতটাই বোকা, এতটাই অবুঝ যে তাঁর হাজার চেষ্টাতেও, তারা কান দিচ্ছে না। একবার নয়, বার বার। আসুন তাঁর এই চেষ্টাগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক, বোঝার চেষ্টা করা যাক যে জনতা, দেশের মানুষ অবুঝ না আমাদের প্রধান সেভক নির্বোধ?
ক্ষমতায় আসার পরেই তিনি জমি অধিগ্রহণ কানুন, আইন আনলেন, সে আইন নাকি দেশের মানুষের জন্য, বিকাশের জন্য। কিছুদিন পরেই বিকাশ গেল ছাগল চরাতে, তিনি খেটেখুটে আইন তৈরি করে, আইন পাশ করার পরে ফেরত নিলেন, মানুষ সে আইন প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তিনি নাকি মানুষের জন্যই সে আইন এনেছিলেন। এরপর নোটবন্দি, ডিমনিটাইজেশন, দেশ নয়, পৃথিবীর প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা বললেন, ভুল হয়ে যাচ্ছে ফেরত নিন, বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবেন, উনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন, অর্থনীতিবিদরা একই কথা বলে যেতে থাকলেন, বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল, উনি আর সেই ডিমনিটাইজেশনের নাম মুখেও আনেন না, ভুল হয়েছে নিশ্চিত বুঝেছেন, কিন্তু ভুল স্বীকারও করলেন না, আজও তার বোঝা বয়ে চলেছে দেশের মানুষ, এখনও।
এবার মধ্যরাতে বিরাট নৌটঙ্কি, সংসদের দুই সদনের বৈঠক ডেকে জি এস টি চালু করা হল, কাদের জন্য, আমাদের চাওলা কাম চৌকিদার প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য এক নতুন দিগন্ত নাকি উন্মোচিত হল, তারপর সেই দিগন্তে শকুন ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছোট ব্যবসায়ীদের কপালে হাত, যাদের জন্য বিল এল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত, তারা বুঝতে পারছে না, বুঝতে চাইছে না, মোদিজী বোঝাতে পারছেন না। আবার অর্থনীতির উপর আঘাত, আবার জিডিপির পতন।
এরপর নাগরিকত্ব আইন আনলেন, সেও নাকি দেশের জন্য, দেশের সংখ্যালঘু মানুষদেরই ভালোর জন্য, হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি, মোটাভাই আইন আনলেন, আরেক মোটাভাই ক্রোনলজি বোঝাচ্ছেন, এন আর সি আগে, তারপর সি এ এ ইত্যাদি। দেশশুদ্ধু মানুষ পথে, হাতে সংবিধান, তারা নাকি সব্বাই দেশদ্রোহী, তারা নাকি সব্বাই বুঝতে পারছে না যে, মোদিজী-শাহজী তাদের ভালোর জন্যই এই বিল এনেছেন, সংসদে গরিষ্ঠতা আছে, বিল এনে বিতর্ক হবার পর বিল পাশ করানোর রীতি মোদিজীর না পসন্দ, তিনি অর্ডিনান্স আনবেন, তারপর এক সকালে ধ্বনিভোটে তাকে বিল তৈরি করবেন, কারণ তিনি তো জানেন এই বিল মানুষের জন্যই আনা, কেবল মানুষ বুঝতে পারছে না, তো বিল পাশ হল, মানুষের প্রতিবাদের সামনে ৫৬ ইঞ্চি সিনা কুঁকড়ে ১৪ ইঞ্চি, এখনও সে বিলের রুলও তৈরি হল না। মানুষ বুঝল না কী আর করা যাবে?
সাতসকালে সংসদ ডেকে কোনও বিতর্ক নয়, কোনও আলোচনা নয়, ৩৭০ ধারা তুলে কাশ্মীরকে দু টুকরো করে, রাজ্য থেকে তাকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করার বিল পাশ হয়ে গেল, কার জন্য? কাশ্মিরীদের জন্য, তারা যাতে বোঝে সেই জন্যই সেখানকার ইন্টারনেট কেটে দেওয়া হল, ১৪৪ ধারা জারি হল, কিন্তু কাশ্মিরীরা বুঝতে পারছে না, কিছুতেই না। তার আহত, তারা ক্ষুব্ধ, প্রধানমন্ত্রী নাকি তাদেরই ভালোর জন্য করছেন এসব, কিন্তু তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, কি কান্ড।
পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়িয়ে তার থেকে টাকা তুলে যে মানুষেরই কাজ করা হচ্ছে, সেটা আমাদের দেশের জুমলাবাজ প্রধানমন্ত্রী মানুষকে, আবার বোঝাতে পারছেন না, দেশের মানুষকে তাদের ট্যাক্সের পয়সায় কি করে ফ্রিতে ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে সেটাও বোঝাতে পারছেন না, উনি সব বুঝছেন, কেবল মানুষকে বোঝাতে পারছেন না। দেশের শ্রমিক, এখনও যা অবশিষ্ট আছে, কারণ নতুন চাকরি নেই আর পুরনো চাকরিতে ছাঁটাই হচ্ছে, তারপরেও যা আছে সেই শ্রমিকদের জন্য শ্রম বিল আনলেন, শ্রমিকরা বুঝতে পারছেন না, তারা রাস্তায়, মিছিল করছে স্লোগান দিচ্ছে, কি অবুঝ শ্রমিক ভাবুন, তাদের উন্নয়নের জন্য, তাদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য বিল আনলেন মোদিজী, কিন্তু তারাই বুঝতে পারছে না, কালা কানুন ওয়াপস লো বলে স্লোগান তুলছে।
দেশের রেল, জাহাজ বন্দর, বিমান বন্দর, কয়লা খনি, জঙ্গল জমি বেচে দিচ্ছেন, আদানি আম্বানিরা কিনে নিচ্ছে, এসবই তো দেশের মানুষের জন্য, দেশের মানুষের উন্নতি আর বিকাশের জন্য, আবার সমস্যা, দেশের মানুষ সেটা বুঝতে চাইছে না, রাষ্ট্রিয় সম্পত্তি কেন বেচে দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলছেন, হরতাল করছেন, আন্দোলন করছেন দেশ, দেশের সম্পত্তি অর্থনীতি ইত্যাদি ভোগে পাঠানোর পরে মোদিজী, কৃষকদের বিকাশের জন্য মাঠে নামলেন, বিকাশ করেই ছাড়বেন।সংসদে নিজেদেরই ৩০৩ জন সাংসদ, তবুও সংসদ এড়িয়ে তিনটে অর্ডিনান্স আনলেন, কৃষকদের উন্নতি করার জন্য, তারপর নিয়মমাফিক ধ্বনিভোটে সেই অর্ডিনান্সকে পাশ করালেন, রাষ্ট্রপতির সইয়ের পর সেটা আইন হল। কিন্তু কৃষকরা পথে,
তাদেরকে খলিস্থানী বললেন, আন্দোলনজীবি বললেন, দেশের বিকাশের বিরোধী বললেন, জলকামান চালালেন, টিয়ার গ্যাস চালালেন, রাস্তায় লোহার কাঁটা দিয়ে পোক্ত ব্যারিকেড তৈরি হল, ৬৭১ জন মারা গেলেন, হাজার দশেক মামলা রুজু হল, ইউ এ পি এ জারি করা হল, ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে চাকার তলায় পিষে মারা হল। সমস্যা সেই একই, এত কঠিনভাবে বোঝানোর পরেও কৃষকরা বুঝল না, তারা তখনও বলে যাচ্ছে কৃষি বিল ওয়াপস লো। এদিকে দিল্লিতে হার, বাংলায় হারের পর ঘাড়ের ওপর উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন, অতঃপর তিনি বিল ফেরত নিলেন, তপস্যা ইত্যাদি ভারি ভড়কম কথা বলে শেষ করলেন, বিল ফেরত নেওয়া হচ্ছে।
কনসেনসাস পলিটিক্স কাকে বলে তা তিনি জানেন না, জানার কথাও নয়, গণতান্ত্রিক নিয়ম কানুন, রীতি নীতি কাকে বলে তাও জানা নেই, ইলেকটোরাল অটোক্রাসির চুড়ান্ত নিয়ে হাজির এই দ্বিতীয় দফার মোদি সরকার, আমাদের গরিষ্ঠতা আছে, ব্যস, এটাই শেষ কথা আমরা যা ভালো বুঝবো, যেটাকে মনে করবো বিকাশ, সেটাই মেনে নিতে হবে। ফলও হাতে নাতে, বিল তৈরি হচ্ছে, ফেরত নিতে হচ্ছে, একধরণের কথা বলছেন, কিছুদিন পরে তা বদলাতে হচ্ছে।
যাদেরকে আন্দোলনজীবি বললেন, তাদের আন্দোলনের পরে বিল ফেরত নিলেন কেন? কোনও জবাব আছে? নেই। যে ৬৭১ জন কৃষক এই আন্দোলন চলাকালীন মারা গেছেন, তাদের কী হবে? কোনও জবাব আছে। ড্রেন থেকে উঠেই ড্রেনটাকে বাজে বললে হবে? মানুষ বুঝে যাবে? তাকিয়ে দেখুন জুমলাবাজ চওকিদার, ট্রাক্টরের পর ট্রাক্টর এসেছে লক্ষ্ণৌতে, মানুষের মিছিল, জুমলা শুনতে নয়, তাদের হক আদায় করে নিতে, সোনার ফসল ফলায় যারা তারাই আজ মিছিলে, আপনি আবার একবার ক্ষমা প্রার্থনার নৌটঙ্কি করলেন বটে, কিন্তু তাকিয়ে দেখুন, তারা আপনার এই নাটকে কানও দেননি, তিনটে বিল ফেরত নিয়েছেন, বেশ করেছেন, ওটা তো ভবিতব্যই ছিল, এছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা ছিল আপনার কাছে? কিভাবে ইউ টার্ন নিতেন? এবার আসুন, এতক্ষণে নিশ্চই আপনার কানে গিয়েছে, কৃষকরা কেবল বিল প্রত্যাহারের পরেই আপনার কথামত বাড়ি ফিরে যায় নি, যাবেও না। তারা এম এস পির লিগ্যাল গ্যারান্টি চায়, চাষের খরচের ওপর ৫০ শতাংশ লাভ চায়, বিদ্যুৎ বিল তারা মেনে নেবে না। কানে গেছে তো এসব? এই দাবি নিয়ে তারা রাস্তাতেই আছে, আপনি স্বপ্ন দেখছেন, কৃষকরা ঘরে ফিরে যাবে, নেহাতই স্বপ্ন, তারা কোনও জুমলাবাজকে খুশি করার জন্য আন্দোলনে নামে নি, তাদের ৬৭১ জন শহীদ কমরেডের মৃত্যুর ক্ষতিপুরণ চায়, আপনাকে এর সবটাই মানতে হবে, সবকটা দাবি। না মানলে কৃষকরা পথেই থাকবে, ওই হিন্দু মুসলমান ইত্যাদি ভড়কিবাজি আমাদের অন্নদাতারা ধরে ফেলেছে, এবার তাদের বাঁচার লড়াই, সেই লড়াই এর সামনে কোনও স্বৈরাচার টিকবে না।
ঢেউ উঠেছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে,
ঢেউ উঠেছে কারা টুটেছে আলো ফুটেছে প্রাণ জাগছে জাগছে জাগছে,
গুরু গুরু গুরু গুরু ডম্বর পিনাকী বেজেছে বেজেছে বেজেছে
মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ তরণী ভাসানো ঢেউ উঠেছে।