কৃষক আন্দোলনের শক্তি আমরা সিঙ্গুরে দেখেছিলাম। যে ধাক্কা ছিল ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের শাসনের পতনের অন্যতম কারণ। সেটা ছিল রাজ্যস্তরে। এবার কৃষক আন্দোলনের শক্তি আমরা দেখলাম জাতীয় স্তরে। প্রায় ১৪ মাসের এই আন্দোলনে। অবশেষে ভোটের মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করলেন। তাঁর নাটকীয় ক্ষমা চাওয়া, প্রায় সাতশো কৃষকের মৃত্যু, বিজেপির পক্ষ থেকে আন্দোলনের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী, দেশবিরোধী শক্তির যোগসাজসের লাগাতার মিথ্যা অপপ্রচার ইত্যাদির পর, সরকারের এই নিঃশর্ত পিছুহটা ভারতের রাজনীতিতে একটা মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
এই ঘটনাটা কখন ঘটছে? দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে একবার তাকানো যাক। সদ্য আমরা পেরিয়ে এসেছি দোসরা অক্টোবর। গান্ধীর জন্মদিন। সেদিন, ২০২০-এর মতোই গান্ধী হত্যাকারীর সমর্থকদের ‘গডসে জিন্দাবাদ’ কথায় টুইটার ছেয়ে গিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দলের নেতারা চুপ করে তা দেখেছেন। কোনও বিরোধিতা করেননি। কোনও নিন্দা করেননি। যেমন ২০১৯-এ বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর গডসেকে দেশ প্রেমিক বলার পর তাকে শাস্তি দেবেন বলেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। যখন হিন্দুত্ববাদী ‘কুইন’ কঙ্গনা রাণাওত গান্ধীকে খাটো করার উদ্দেশে প্রতিদিন নানা বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। বিজেপি নেতারা যা কার্যত নীরব থেকে সমর্থন করে চলেছেন। এইরকম একটা সময়ে গান্ধীর দেখানো পথ, সত্যাগ্রহের মাধ্যমে এক বিরাট জয় অর্জন করলেন দেশের কৃষকরা।
আরও পড়ুন: কৃষকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার কেন্দ্রের, অবশেষে ৩ কৃষি আইন প্রত্যাহার করলেন মোদি
গান্ধী হত্যার দিন আরএসএস রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি বিলিয়েছিল, একথা জওহরলালকে লিখেছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল। আরএসএসের-ই রাজনৈতিক সংগঠন, তিনশোর বেশি আসনে বলীয়ান প্রবল প্রতাপশালী বিজেপিকে আজ কিন্তু সেই গান্ধীর দেখানো পথে হাঁটা কৃষক-সত্যাগ্রহীদের শক্তির কাছে হার মানতে হল। ১৯৪৮-এ গান্ধী হত্যার প্রায় ৭৩ বছর পরে তাঁর সত্যাগ্রহের আদর্শ যে এই ভাবে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ বলে হিন্দুত্ববাদীদের রাস্তা রুখে দাঁড়াবে, তা হয়তো নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। মনে হচ্ছে সেই শীর্ণ লাঠি হাতে খাটো ধুতি পরা গুলি বিদ্ধ মানুষটা যেন ফের গেয়ে উঠলেন, রঘুপতি রাঘব রাজা রাম…।
দিল্লিতে আন্দোলনে কৃষকরা
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু কার কাছে? তিনি কি আন্দোলনস্থলে মৃত্যু বরণ করা সেই সাতশো কৃষকের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, বাবা, মায়ের কাছে ক্ষমা চাইলেন? না। লখিমপুর খেড়িতে গাড়ি চাপা দিয়ে যে কৃষক এবং সাংবাদিকদের খুন করা হয়েছিল, তিনি কি তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইলেন? না। যে মন্ত্রীর ছেলে ওই গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত সেই মন্ত্রীকে যে তিনি এখনও মন্ত্রিসভায় রেখে দিয়েছেন , তিনি কি তার জন্য ক্ষমা চাইলেন? না। তাঁর দলের নেতা মন্ত্রীরা যে বলেছিলেন এই আন্দোলন দেশ বিরোধীদের মদতে চলছে, এই কথার জন্য তিনি কি ক্ষমা চাইলেন? না তা-ও নয়। আন্দোলন স্থলে বার বার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া, পানীয় জলের জোগান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কি তিনি ক্ষমা চাইলেন? না।
ভাঙবে তবু মচকাবে না বলে একটা কথা আছে। শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণ শুনে সেই কথা মনে পড়ে গেল। নিঃশর্ত ভাবে কৃষি আইন প্রত্যাহার প্রসঙ্গে তিনি বললেন কিছু কৃষকের আন্দোলন ছিল এটা। তাহলে তো ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকারকে বলতে হয় কিছু মানুষের ভোটে জেতা বিজেপি সরকার!
আরও পড়ুন: তিন কৃষি আইন, ১৮ মাসে কোন পথে প্রত্যাহার
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দুটো খুব বড়ো মাপের আন্দোলন আমরা দেখলাম। শাহিনবাগ এবং কৃষক আন্দোলন। সিএএ বিরোধী শাহিনবাগের আন্দোলনও (যে আন্দোলনে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে কোভিডের জন্য সেই আন্দোলন উঠে যায়। সেই আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন তাঁদের পোশাক দেশে চিনতে। তাঁর দলের নেতা মন্ত্রীরা বলেছিলেন, ওই আন্দোলনকারীরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে ধর্ষণ করবে। বিরোধিতাকে নরেন্দ্র মোদির সরকার এই চোখেই দেখেন। তবুও মনে রাখতে হবে সিএএ নিয়েও সরকার সাময়িক পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এই দুটি আন্দোলনের মধ্যে মিল হল, দুটিই সত্যাগ্রহ। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।
দেখা যাচ্ছে, ভাঙচুর, আগুনের আন্দোলনের থেকে আজকের ভারতে সত্যাগ্রহ বেশি কার্যকর হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীরা এর থেকে কি শিক্ষা নেন তার উপর নির্ভর করছে আগামী দিনে দেশের বিরোধী শক্তির বিকাশ।