ঠিক দু’দিন আগে ছিল তাঁর মৃত্যুদিন। ২১ সেপ্টেম্বর। আট দশক আগে ওই দিনেই তাঁকে গুলি করে মারে জার্মান নাৎসি বাহিনী। রোমানভিলের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ফায়ারিং স্কোয়াডে। ইতিহাসে তাঁর কথা লেখা নেই। মিশ্যালট মাধবন। এক অকুতোভয় ভারতীয় কমিউনিস্টের নাম।
তখনও ভারত স্বাধীন হয়নি। দেশ ছেড়ে বহদূরে প্যারিসের রাস্তায় রাতের অন্ধকারে হাঁটছেন মাধবন। পাশেই হাঁটছেন আরও একজন। ভরাদারাজুলু সুব্বাহ্। ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ফরাসি দেশে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। দু’জনে হাঁটছেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে কথা হচ্ছে। কথা হচ্ছে মহাত্মাকে নিয়ে। মালাবার উপকূলের নোনা হাওয়া-বাতাসের মানুষ মাধবন। ফরাসি কলোনিতে বড় হয় ওঠা। পাশাপাশি চার চারটে শহর। মাহি, পুঁদুচেরি, কারিকাল আর ইয়ানাওন। মাহিতে পড়াশোনা শেষ করার পরেই কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন মাধবন। একই সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর কাজকর্মও তাঁকে গরিব পিছিয়ে পড়া মানুষদের কাছাকাছি নিয়ে যায়। হরিজন সেবক সংঘে নাম লেখান মাধবন। এর কিছু দিন পরেই গণিত নিয়ে পড়াশোনা করতে প্যারিসে পাড়ি। যেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে ভরাদারজুলু সুব্বাহ্’র। প্যারিসের রাস্তায় দু’জনে রাতের পর রাত সময় কাটাবেন।
মাধবনের ফিয়াঁসে জাইলেস মোলেট ছবি: ইনটারনেট
আরও পড়ুন: করোনা আবহে ঠাকুর দেখতে মানতে হবে এই নিয়মগুলি
তবে এ কাহিনি শুধুই মিশ্যালট মাধবনের নয়। সঙ্গে রয়েছেন আরও দুই চরিত্র। একজন মাধবনের ফিয়াঁসে জাইসেল মোলেট। আর তাঁদের একজন চিনা বন্ধু তাই তে শেং। অনেকটাই সেই থ্রি মাসকেটিয়ার্সের মত। যাঁদের হাতে হাত ধরে থাকা প্রকৃত কমরেডের জীবন একদিন ভেঙেচুরে যাবে নাৎসি জার্মানির অত্যাচারে। কিন্তু তাঁদের লড়াইয়ের কথা আজও প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায়, শহরের দেওয়ালে লেখা রয়েছে।
আউৎসভিজের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এখানেই ছিলেন মাধবনের ফিয়াঁসে জাইলেস মোলেট। ছবি: ইনটারনেট
গেস্টাপোরা ছিল নাৎসিদের ভাড়া করা গুন্ডাবাহিনী। গুমখুন বা গুপ্তহত্যা করতে ওস্তাদ। নাৎসিরা এদের গুপ্তচর হিসেবেও ব্যবহার করত। মিশ্যালট মাধবন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আলাপ হয়েছে মোলেটের সঙ্গে। জুটেছে আর এক ছাত্র শেং। তিন জনের ভালই জমেছে। কিন্তু পিছনে যে ফেউ ঘুরছে তা বোধহয় কেউই আঁচ করতে পারনেনি। একদিন ধরা পড়ে গেলেন। ধরা পড়ে গেলেন আরও অনেক কমরেড। তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। মাধবন এবং তাঁর সাথিদের রাখা হল রোমানভিলের ক্যাম্পে। মোলেটকে পাঠানো হল কুখ্যাত আউৎসভিজের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।
আরও পড়ুন: মোদির জন্মদিনে টিকাকরণের পরিসংখ্যানে ব্যাপক কারচুপি, টিকা পেয়েছেন ‘মৃত’ মহিলাও
প্যারিসের হোটেলে কাজ করতেন মোলেট। কোনও এক সন্ধেয় আলাপ হয়েছিল মাধবনের সঙ্গে। আর তারপরেই প্রেমে জড়িয়ে পড়লেন দু’জনে। কিন্তু গেস্টাপোরা তাঁদের প্রেমে বারুদ আর বন্দুকের নল ঠুঁসে দিল। ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৪২। রোমানভিলের ফায়ারিং স্কোয়াডের দিকে হেঁটে চলেছেন মাধবন এবং আরও তিরিশ কমরেড। তাঁদের উদাত্ত কন্ঠে তখন ‘লা মারসেলাইজে’। ক্যাম্পের দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে কমরেডদের স্বর। গেস্টাপো বাহিনী ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করাল মাধবনকে। হাত পিছনে বেঁধে দিল। তারপর চোখ না বেঁধেই একের পর এক বন্দুকের গুলি।
ওই ক্যাম্পেরই এক ফরাসি বন্দি পরে লিখেছিলেন মাধবনের কথা। ফরাসি সরকার ওই বন্দিকে সে দেশের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘লিজিয়ঁ অফ অনার’ সম্মাননা দেয়। বলেছিলেন, ক্যাম্প থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল মাধবনের। মাধবন ছিলেন ভারতীয়। এটা যদি তিনি নাৎসিদের জানাতেন তা হলেও ছাড়া পেয়ে যেতেন। কিন্তু কমরেডদের ছাড়তে পারেননি একজন প্রকৃত কমিউনিস্ট। মিশ্যালট মাধবনের মৃত্যুর এক বছর পর আউৎজভিজ ক্যাম্পে নিহত হন জাইসেল মোলেট। আর শেং। তার কী হল? সে আর এক কাহিনি।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: এবার মিডিয়া দখলে আদানি