প্রীতম বিশ্বাস: বেশ কয়েক প্রজন্মের দর্শক তাঁর ভক্ত। কারোর স্মৃতিতে উজ্জল ‘পলাতক’, কারোর ‘দাদার কীর্তি’, কেউ বা আবার ‘আলো’ বা ‘চাঁদের বাড়ি’র কথা বলবেন। তাঁর ছবি হিন্দিতেও বানিয়েছেন তিনি। এখনকার বাংলা বা হিন্দি ছবি নিয়ে কি বক্তব্য তাঁর?
প্রশ্ন : এককালে বহু বাংলা ছবি হিন্দিতে হয়েছে, আপনি নিজেও করেছেন, গত ২৫ বছরে একটা দুটো ছাড়া সেভাবে হয় না। ভূতের ভবিষ্যত আর রাজকাহিনী ব্যতিক্রম।এর কারণ কি ব্যবসার চরিত্র পাল্টে যাওয়া ?
উত্তর : আমার তা মনে হয় না। বাংলা ছবির জোরই ছিল বাংলা সাহিত্য। তার মানে এই নয় যে সিনেমাকে তার স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে সাহিত্যের দাসত্ব করতে হবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে সাইলেন্ট যুগ থেকেই শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের গল্প সিনেমায় ঠাঁই পেয়েছে। ভালো গল্পকে ভালো প্রযোজক এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এর অন্যতম উদাহরণ নিউ থিয়েটার্স। দেশ স্বাধীন হওয়ার বহু আগেই কলকাতাতে বাংলার পাশাপাশি হিন্দি,উর্দু, এমনকি তেলুগু ছবিও হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই কালো টাকার রমরমা শুরু হয়। সিনেমা তৈরির মনন নষ্ট হয়, বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় সাহিত্যের সঙ্গে। সারা ভারতে বাংলা গল্পের রমরমা শেষ হতে শুরু করে। যদিও পরবর্তীকালে নানা গুণী মানুষ বাংলা থেকে হিন্দি ছবি বানিয়েছেন। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াতে সাহিত্যের কদর আর ফিরে আসেনি সে ভাবে। সত্যজিৎ বাবুর ছবি সাহিত্যভিত্তিক কিন্তু তাঁর ছবি বানানোর মডেল কিন্তু বোম্বের মডেল নয়। তপনবাবুর ক্ষেত্রেও তাই। শুধু সাগিনাই তিনি হিন্দিতে নিজে পরিচালনা করেছেন। বর্তমান সময়ে কিন্তু বোম্বের কিছু প্রযোজক,পরিচালক নিজেদের একটা ধারা তৈরি করতে পেরেছেন যা বাংলা পারে নি। আপনি যদি লাঞ্চবক্স, বাধাই হো দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন। এই ধারা তৈরি হয়েছিল শ্যাম বেনেগালের হাত ধরে।
প্রশ্ন : আপনার বাংলা থেকে হিন্দি ছবি পরিচালনার সূত্রপাত কিভাবে?
উত্তর : এর কৃতিত্ব হেমন্ত বাবুর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমার প্রায় ২৫টি ছবির সুরকার। এই উদাহরণ সিনেমা জগতে খুব বেশী নেই। উনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ইনফর্মাল। এমনও হয়েছে উনি আমার অফিসে এসে বিনা নোটিশে হারমোনিয়াম নিয়ে গান বা গানে সুরারোপের কাজ করতে বসে গেলেন। উনিই বললেন যে পলাতক থেকে রাহগীর করতে চান। হেমন্তবাবু জানতেন যে আমি আমার মত করেই ছবি বানাতে পছন্দ করি, তাই আমিও সহমত হই। সে আলোচনা করতেই আমি বোম্বে আসি। হেমন্তবাবুর পরামর্শেই গুলজার এই ছবিতে কাজ করেন। তখনও গুলজারকে তেমন কেউ চিনত না। এভাবেই হলো রাহগীর।
প্রশ্ন : পরের ছবি বালিকা বধূ। সেটাও কি হেমন্তবাবুরই উদ্যোগ।
উত্তর : ঠিক। উনি বাংলা বালিকা বধূর একটা প্রিন্ট নিয়ে বোম্বে আসেন। সেটা ইন্ডাস্ট্রির অনেককে দেখানোর ব্যবস্থা করেন ফিল্ম সেন্টারে। কিন্তু যে ফ্লোরে দেখানোর ব্যবস্থা হয় তা ছিল মিউজিক রেকর্ডিং রুম। সেখানে গোটা পাঁচেক স্থায়ী আসন ছিল মাত্র। কিন্তু হেমন্তবাবুর ডাকে বোম্বে সিনে জগতের বহু রথী মহারথী হাজির হন। চেয়ার ভাড়া করা হয় কিন্তু তা এসে পৌছোনোর আগেই লতা মঙ্গেশকর বলেন যে মাটিতে কার্পেটে বসেই তো ছবিটি দেখা যেতে পারে। শুধু বলেনই না, নিজে বসেও পড়েন। তাঁর দেখাদেখি মীনাকুমারী,শক্তি সামন্ত ও অন্যান্যরা মাটিতে বসেই ছবিটি দেখেন । এই শক্তি সামন্তই পরে বালিকা বধূ হিন্দিতে প্রযোজনা করেন।
আরও পড়ুন- Tarun Majumder Death: প্রয়াত বাংলা ছায়াছবির ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ তরুণ মজুমদার
প্রশ্ন : বাংলায় সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তিনিই ছবিটি বোম্বেতে দেখানোর ব্যবস্থা করেন কিন্তু হিন্দিতে সুরকার হলেন রাহুল দেব বর্মন। এই পরিবর্তন কি শক্তি সামন্তের পরামর্শে?
উত্তর : একদমই না। হেমন্তবাবুই বলেন যে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে সে সময়ে বড় নাম এমন কাউকে দিয়ে সুর করাতে। তাই আর ডিকে বেছে নেওয়া। হেমন্তবাবু একদম অন্য ধরণের মানুষ ছিলেন। কমার্শিয়াল মেন্টালিটির নন। এমন মানুষ আজ কোথায়?
প্রশ্ন: আজ তো ডিজিটাল মিডিয়ার যুগ, ওয়েব প্ল্যাটফর্মের সময়। বাংলা ছবির ছোটগল্পের সম্ভারও তো সমৃদ্ধ। আপনার ইচ্ছে করে না ওই ধরণের প্ল্যাটফর্মে শর্ট ফিল্ম বানাতে ?
উত্তর : ওইসব ক্ষেত্রে তো রগরগে ছবিরই প্রাধান্য।
প্রশ্ন: আর যদি আপনারই ঘরাণার ছবি বানাতে বলে?
উত্তর : ভেবে দেখব অবশ্যই ।
প্রশ্ন : বাংলা ছবির তিন প্রথম সারির অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, মহুয়া রায় চৌধুরি ও দেবশ্রী রায় এক কথায় বলতে গেলে আপনারই আবিস্কার। কিভাবে খোঁজ পেলেন এনাদের?
উত্তর : মৌসুমীর আসল নাম ইন্দিরা। তখন আমি থাকতাম নিউ থিয়েটার্সের পাশের বাড়িতে। বালিকা বধূ’র জন্য নতুন অল্পবয়সী নায়িকার খোঁজ করছি। আমার বাড়ির পাশেই নৃপেন্দ্রনাথ বালিকা বিদ্যালয়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। এমন সময় দেখলাম একটি মেয়ে সকালের স্কুল ছুটির পরে বাড়ি ফিরছে আর তাঁর পাশে একটা বৃত্ত চলেছে। মানে তাঁকে গোল করে ঘিরে ধরে আরো আট-দশটি বালিকা এগিয়ে চলেছে। মেয়েটি কিন্তু চলতে চলতেই এপাশ ওপাশ ঘুরে কথা বলছে। মেয়েটির সেই উচ্ছ্বল ও সপ্রতিভ রূপ দেখেই আমি নিউ থিয়েটার্সের গার্ডকে বললাম একবার মেয়েটিকে আমার কাছে নিয়ে আসতে। সেভাবেই খুঁজে পেলাম আপনাদের মৌসুমীকে।
প্রশ্ন : মহুয়া রায় চৌধুরিও আপনারই আবিস্কার। ছবির নাম শ্রীমান পৃথ্বীরাজ। তাঁরও কি অন্য নাম ছিল?
উত্তর : নিশ্চয়ই। ওর নাম ছিল সোনালি । আমিই নাম দিই মহুয়া। তবে মহুয়া কিন্তু শ্রীমান পৃথ্বীরাজের প্রথম পছন্দ ছিল না। অন্য একটি মেয়ের ওই চরিত্র করবার কথা ছিল। সবকিছু ঠিক ছিল হঠাৎ মেয়েটির গলা খারাপ হল। সে আর ঠিক হয় না। মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে। এদিকে এসে যাচ্ছে আউটডোর শ্যুটিংয়ের সময়। আমার চেনা এক ডাক্তার দেখে বললেন সারতে ৬ মাস লাগবে। আমি খুব ডিস্টার্বড। স্টুডিওতে বসে কাজ করছি। প্রোডাকশন ম্যানেজারকে বললাম কেউ যেন বিরক্ত না করে। কিছুক্ষণ বাদে দরজায় নক করে একজন বললেন, ভিতরে আসব? আমি বললাম, না এখন আমি ব্যস্ত। ভদ্রলোক ফিরে যাচ্ছেন এমন সময়ই চোখে পড়ল একটা ছোট্ট মেয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে কৌতুহলী চোখ দিয়ে দেখছে। আমার মনে হল এই সেই মেয়ে। আমি পেলাম সোনালি, মানে মহুয়াকে।
প্রশ্ন : দেবশ্রী রায় তো বিখ্যাতই হলেন আপনার ‘দাদার কীর্তি’ তেই ।
উত্তর : দেবশ্রীর পুরো স্টারডমের কৃতিত্ব আমি নিতে পারি না। দাদার কীর্তি’র আগে ও অন্য পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছে। ও শিশু অভিনেত্রী হিসাবে আগেই পরিচিত সিনেমা মহলে। আমার ‘কুহেলি’তেও দেবশ্রী ছিল। তবে তখন ওর নাম ছিল চুমকি । দেবশ্রী নামটাও আমার দেওয়া। কুহেলি’র সময় ও এত ছোট যে আমাদের কোলে চেপেই কাজ করত। আমাদের মানে আমি আর চিত্রগ্রাহক সৌমেন্দু রায়। মাটিতে নামালেই বলত ‘বাড়ি যাব’ (হাসি)।
প্রশ্ন: এত একেবারে একতাল মাটি থেকে প্রতিমা গড়ার কাজ। আপনি কিভাবে এঁদের তৈরি করতেন? এখনকার মত ওয়ার্কশপ করাতেন?
উত্তর : আমাদের সময় চল ছিল রিহার্সালের। ঘন্টার পর ঘন্টা মৌসুমী-মহুয়াদের নিয়ে পড়ে থেকেছি। একবার বালিকা বধূর রিহার্সাল চলার সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হাজির। বেশ কিছুক্ষণ মৌসুমীকে দেখে উনি আমায় বললেন ‘ একে দিয়ে হবে?’ । আমি বললাম ‘ চেষ্টা করতে দোষ কি?’
(একটু থেমে) সেই মৌসুমীই পরে হেমন্তবাবুর পুত্রবধূ হলেন ।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে তরুণ মজুমদারের এই সাক্ষাৎকারটি তাঁর স্মৃতিতে ফের প্রকাশিত হল।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন প্রীতম বিশ্বাস।