পেট খালি রাখুন। দরকার পড়লে দু’দিন না খেয়ে থাকুন! কারণ রবিবার যে বিশ্ব বিরিয়ানি দিবস। হ্যাঁ এই বছরই পালিত হতে চলেছে প্রথম বিশ্ব বিরিয়ানি দিবস(World Biryani Day)। তাই ছুটির দিনটা চেটেপুটে উপভোগ করুন। বন্ধুবান্ধব নিয়ে দিনভর খোশগল্প আর হাড়হাভাতে হ্যাংলার মতো বিরিয়ানি খেয়ে থাকার দিন। বৌঠানরাও এখন থেকে রবিবারের কর্মবিরতি ঘোষণা করে দিন। না-হলে এখন থেকেই মনোসংযোগ শুরু করুন, কাচ্চি না পাক্কি, কোন বিরিয়ানিটা করে ভগ্নিপতিকে খুশি করে বোনের ঈর্ষা কুড়োবেন। কিংবা ননদকে দিয়ে মুখ ফুটে বলাবেন, এরকম বিরিয়ানি আমিও করতে পারি।
এ এক অদ্ভুত দিবস! গরম গরম বিরিয়ানির ভাত যখন মাংস এবং আলুর ভাঙা টুকরোর সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে আপনার টনসিলের গলি কাটিয়ে খাদ্যনালি দিয়ে নীচের দিকে নামতে থাকবে, তখন সত্যিই মনে হবে কি না, আমার শাশুড়ি কত ভালো মানুষ! কিংবা অফিসের বস যেন রঘুপতি রাঘব রাজারাম! জানালার বাইরে তখন যদি আষাঢ়ের ঘন বর্ষার সঙ্গত নেমে আসে, মনে হবে এরপর জীবনে আর কিছু পাওয়ার নেই। এফডিগুলো মিশনকে দিয়ে হালকা করে পাখা চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
খেয়েছেন, রেঁধেছেন, কিন্তু আপনি কি জানেন বিরিয়ানির মাতৃভূমির নাম। কী করে এই নামকরণ হল? বিরিয়ানির ভাই-বোন কটা? বঙ্গসমাজে একে আত্মীয়রূপে বরণ করল কে? যাকে সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায় বলা যায়, একি ভানুমতি! একি ইন্দ্রজাল! তামিল সাহিত্যে ‘ওন সরু’ নামক একপ্রকার খাদ্যের নাম জানা যায়। এই খাবার আসলে ভাত, ঘি, মাংস এবং বিভিন্ন প্রকার মশলা সহযোগে বানানো হতো। এর সময়কাল সম্ভবত দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। এর পরে অবশ্য আরব বণিকদের হাত ধরে দক্ষিণ ভারতে বিরিয়ানির প্রবেশ।
আলবেরুনি সুলতানি আমলে রাজপ্রাসাদের যে খাদ্যের তালিকা দিয়েছেন, সেখানে অবশ্য বিরিয়ানি জাতীয় খাবারের উল্লেখ রয়েছে। তবে তা কতটা বিরিয়ানির কাছাকাছি ছিল, সেই নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। ১৩৯৮ সাল নাগাদ তৈমুর ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। তিনি তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনীর জন্য রাঁধুনিকে ভাত-মাংস সহযোগে এক সুষম খাবার তৈরির নির্দেশ দেন। একটা বিষয় মোটামুটিভাবে পরিষ্কার, তা হল আরব, তুর্কিদের হাত ধরে বিরিয়ানির ভারতে প্রবেশ হয়েছিল।
বিরিয়ানি আদতে সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি খাবার। কেন? তার অনেকগুলি কারণ, বিরিয়ানি একটি পাত্রে রাঁধা যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে ভাঙা কাঠের টুকরো, গাছের শুকনো ডালপালা সুলভে মিলত। তাছাড়া, প্রোটিনের ক্ষেত্রে এতে থাকে, ভাত, ঘি, মাংস, দুধ, জাফরান বা কেশর, নানা ধরনের মশলা (যা শরীরে উত্তেজনা তৈরি করে), ডিম ইত্যাদি। রান্নায় জল কম লাগে। একপাত্রে অনেকে মিলে খাওয়া যায়। রান্নায় সময় কম লাগে। এসব কারণে সেনাদের পুষ্টির জন্য বিরিয়ানি ছিল উপাদেয় খাদ্য।
চিকেন বিরিয়ানি
মুঘল আমলের আগে বিরিয়ানির রকমফের থাকলেও কেউ বলেন বাবরের সময় থেকে ভারতে বিরিয়ানির প্রবেশ ঘটে। আবার একটি গল্প প্রচলিত আছে, সেটা হল— বিরিয়ানির সঙ্গে মমতাজেরও এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মুঘল সেনাবাহিনীর হাল হকিকত জানার জন্য একদা মমতাজ সেনাবাহিনীর হেঁসেলে ঢুকে পড়লেন। হেঁসেলের শোচনীয় অবস্থা দেখে বিস্মিত মমতাজ মুঘল বাবুর্চিকে সেনাবাহিনীর জন্য ভাত, মাংস, মশলা সহযোগে এক সুস্বাদু খাবার তৈরির নির্দেশ দিলেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী রাঁধুনি যেটা বানিয়ে ফেললেন সেটা আজকের বিরিয়ানির চেহারা নিল।
কলকাতায় প্রবেশের কাহিনি
‘হাম ছোড় চলে লখনউ নগরী’। সিপাহি বিদ্রোহের আগে ৬ মে ১৮৫৬ সালে লখনউয়ের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতা এসে পৌঁছলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নির্বাসন দিয়েছিল। অওয়ধ বা অযোধ্যা বা লখনউ ছেড়ে তিন কলকাতায় চলে আসেন। তাঁর সব সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ওয়াজিদ আলি চেয়েছিলেন কলকাতা হয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হবেন রানির কাছে আবেদনের জন্য। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাঁর লন্ডন যাওয়া হয়নি। তিনি কলকাতার উপকণ্ঠে মেটিয়াবুরুজে পাকাপাকিভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। লখনউ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল নবাবের খাস রাঁধুনিদের। এদের রান্নার জাদুতেই এ শহর কলকাতা প্রথমবারের মতো বিরিয়ানির গন্ধ পেল। কিন্তু, সমস্যা বাধল অর্থে। ওয়াজেদ আলি শাহের তখন ভয়্ঙ্কর অর্থ সংকট চলছে। সবসময় মাংস জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। বাবুর্চি তারও ব্যবস্থা করলেন ডিম-আলু দিয়ে বিরিয়ানি। এরই নাম কলকাতা বিরিয়ানি।
এখন আমরা দু’পা এগোলেই দেখতে পাই হাজি বিরিয়ানি লেখা দোকান। কিন্তু এর আসল রহস্য কি জানেন? মোঘল আমলেরই ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি, ঢাকাইয়া হাজি বিরিয়ানি। ঢাকার বাসিন্দা হাজি মোহম্মদ হোসেন চালু করেছিলেন এই বিরিয়ানী। এর বিশেষত্ব হল, গোরুর মাংসের পরিবর্তে শুধু খাসির মাংস এবং ঘি বা মাখনের পরিবর্তে সরষের তেল ব্যবহার করা। বাকি সব মশলাই ব্যবহার করা হয় এই বিরিয়ানিতে।
কলকাতার বিরিয়ানি সঙ্গে এক টুকরো আলু আর আধখানা ডিম
হায়দরাবাদি বিরিয়ানি বাসমতী চাল, মশলা এবং ছাগলের মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়। ছাগলের মাংসের পরিবর্তে মুরগি ব্যবহারও করেন কেউ কেউ। দুধ দিয়ে তৈরি করা এই বিরিয়ানি অন্য জায়গা করে নিয়েছে খাদ্যরসিকদের মনে। মাংসের টুকরোগুলি প্রথমে দুধে রান্না করা হয়, তার পর যাবতীয় মশলা মিশিয়ে একটি পাত্রে দম দিয়ে এই বিরিয়ানি বানানো হয়।
সুতরাং, আর দেরি কেন, বিরিয়ানি দিবস আপনার ঘরের কোণেও হয়ে উঠুক এক নতুন ধরনের প্রেম দিবস। ঘরের মানুষকে রেঁধে খাওয়ানোর মধ্যেও প্রেমেরই মশলা লাগে।
ধোঁয়া ওঠা হায়দরাবাদী মাটন বিরিয়ানি