সারাবছর নানান দিন পালন হয়, নানান সপ্তাহ। ড্যাডিস ডে থেকে মাম্মি ডে, বন্ধু দিবস থেকে গোলাপ ফুলের দিন, দিন পালনের ছড়াছড়ি। এরই মধ্যে দেশ জুড়ে স্বাধীনতা দিবস পালন হয়, গণতন্ত্র দিবস, সংবিধান দিবস আসে আর যায়৷ এশিয়া মহাদেশে এমন সব দিবস পালনের শীর্ষে ভারতবর্ষ। যে দিন দেশের প্রধানমন্ত্রী অম্বেদকরের মূর্তিতে মালা দেন, সে দিন দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে আদিবাসী তাঁর জমি হারায়, দলিত মহিলা ধর্ষিত হয়। সংবিধান দিবসের দিনেই, সংবিধান হাতে নিয়ে মিছিলের মুখ উমর খালিদ জেলে বসে জামিনের দিন গোনে৷ বিনা বিচারেই জেলে পচে কবি, সাহিত্যিক, সমাজকর্মী, সাংবাদিক। শিশু দিবসে জন্ম নেওয়া শিশু বা তার বাবা মা, জানেনই না যে দেশে জন্ম নেওয়া ১০০০ শিশুর মধ্যে ৩৭ জন, জন্ম নেওয়ার পরেই মরে যাবে। এবং এ সবের মাঝেই দেশের বিকাশ রথ ছুটছে৷ সে বিকাশ ও আবার সবকা সাথ, সবকা বিকাশ।
বিকাশের গণতন্ত্রে পেট্রল, ডিজেল, ভোজ্য তেল বা খাদ্যদ্রব্যের দাম সমান ভাবে বাড়ে৷ নিত্যানন্দ জানা আর মুকেশ আম্বানির জন্য সমানভাবে৷ পেঁয়াজের দাম ৩৫ টাকা কিলো, কখন? যখন মাঠ থেকে পেঁয়াজ উঠছে, মাস আট কি দশ পরেই তা হবে ৭০/৮০/৯০৷ তা হোক, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন৷ মুকেশ আম্বানিও ওই টাকাতেই পেঁয়াজ কিনবেন, আপনিও৷ গণতন্ত্র জিন্দাবাদ। আপাতত আপনি, রণবীর আর আলিয়ার বিয়ের ছবি দেখুন, ডিজাইনার ড্রেসের দামে আপনার পাকা ঘর হয়ে যাবে৷ সেই ওনাদের বিয়ের অভ্যর্থনায় যে পেঁয়াজ কেনা হয়েছে, তাও ৩৫ টাকা কেজি। এই আবহে আপাতত নতুন সপ্তাহ, পোষণ সপ্তাহ, কাগজ খুলুন, মোদিজীর সহাস্য মুখের ছবি, শিশুদের পুষ্টির জন্য এত কোটি টাকা খরচ করেছে এই সরকার, যা শুনে, দেখে, শিশুরা খালি পেটে ঘুমিয়ে পড়বে। পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনে যখন দেশে পুষ্টি সপ্তাহ চলছে, তখন পুষ্টি নিয়েই কিছু কথা বলা যাক।
পুষ্টি কাকে বলে? মানুষের শরীর ঠিক মতো বেড়ে উঠতে যা যা লাগে, সেই সব প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন ইত্যাদি খনিজ, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি যে যে খাবারে থাকে, তা খেলে তার যে নির্যাস, যা শিশুকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে, তাকে পুষ্টি বলে। পুষ্টিকর খাবার কী কী? এইখানেই আমাদের দেশের সমস্যা। কারণ পৃথিবীতে আমিষ আর নিরামিষ, দু ধরণের খাবার আছে৷ দু’ধরণের খাবার থেকেই পুষ্টি সম্ভব৷ যার যা রুচি খাবে, এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আমিষ খাবার থেকে যত কমদামে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস পাওয়া সম্ভব, তা নিরামিষ খাবার থেকে সম্ভব নয়। কেউ বলতেই পারেন যে ডালে প্রোটিন আছে, দুধ সুষম খাবার৷ তাহলে সমস্যা কোথায়? ডালে প্রোটিন আছে, এটা ঠিক। কিন্তু ১০০ গ্রাম ডালে যে প্রোটিন আছে, এবং তা হয়তো ১০০ গ্রাম মুরগির মাংস থেকে একটু বেশিই৷ সমস্যা হল ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসের দাম এই আগুন বাজারেও ১৪/১৫ টাকা৷ ভাঙা মুগ ডালেরও ১০০ গ্রাম এর দাম ওই ১৪/১৫ টাকাই৷ কিন্তু ১০০ গ্রাম মুরগি সহজেই খাওয়া যায়৷ ১০০ গ্রাম ডাল কেউ খায় না৷ এক বাটি রান্না করা ডালে বড়জোর ১৫/২০ গ্রাম ডাল থাকে৷ তারচেয়ে ৫/৬ টাকায় একটা ডিম খাওয়া অনেক উপকারি৷ এইখানে এসেই আমিষ খাবারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
এবার বলবেন, বহু মানুষ আছেন, যাঁরা নিরামিষ খেয়েও ভালো আছে৷ ধরুন হরিয়ানা, নিরামিষভোজীদের তালিকায় এক্কেবারে প্রথম তালিকায়৷ কিন্তু সেখান থেকে অলিম্পিকজয়ী খেলোয়াড়রা বেরিয়ে আসছে, সেখানে তাদের নিরামিষ খাবারের তালিকা দেখলেই তার কারণ বোঝা যাবে, সে তালিকায়, দুধ, ঘি, মাখন, পনির, নানান রকমের ভেজিটেবলস, ডাল। আগেই বলেছিলাম, নিরামিষ খাবারও প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিতেই পারে, কিন্তু তা মূল্যের বিচারে দেখলে বোঝা যাবে, গরিব অথচ নিরামিষভোজীদের পুষ্টি কেন জোটে না। কেন গুজরাতে রিকেটগ্রস্ত, অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগা শিশুর সংখ্যা এত বেশি? এর কারণ লুকিয়ে আছে পুষ্টিকর নিরামিষ খাবারের দামের ওপরে। মিড ডে মিল, কেন চালু হয়েছিল? কেবলমাত্র ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনার জন্য? না, মিড ডে মিল চালু হয়েছিল, দেশের শিশুদের প্রকৃত পোষণ যোগানোর জন্য। এখন সেই কাজ, দুটো মূল কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে, হাঙ্গার ইনডেক্স এর তলার সারি থেকে আরও তলার সারিতে নেমে যাচ্ছে দেশ, কারণ ওই পুষ্টিকর খাবারের দাম বাড়ছে হু হু করে৷ ডিম মাছ, মাংস, দুধ, ঘি, পনির চলে যাচ্ছে গরিব মানুষের সামর্থের বাইরে৷ মিড ডে মিল এ ডিম দিলে ডাল দেওয়া যাচ্ছে না, সয়াবিন দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে৷ কারণ মিড ডে মিলে বরাদ্দ টাকায় কুলোচ্ছে না৷ বাজারের বাড়তে থাকা দাম তার প্রধান কারণ।
দ্বিতীয় কারণ মোদি সরকারের, আর এস এস – বিজেপির প্রকৃত হিন্দু ন্যারেটিভ৷ আমিষ খাবার বর্জন করার ফতোয়া, যে কারণে মধ্য প্রদেশ ছাত্রদের মিড ডে মিল থেকে ডিম বাদ দিয়েছে, ডিম নাকি ক্ষতিকর। ফলাফল চোখের সামনে, অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে৷ ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে বলছে, এন এফ এইচ এস ৪ থেকে এন এফ এইচ এস ৫ এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২২টা রাজ্যের মধ্যে ১৬টা রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে অপুষ্টিজনিত বৃদ্ধি, স্টানিং বা ওয়েস্টিং বেবির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে৷ সে সব রাজ্যের শীর্ষে গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড। গ্রামীণ ভারতের, প্রতি চার জন শিশুর মধ্যে ৩ জনই অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত৷ ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়াতে এই ম্যাল নিউট্রিশনে ভোগা শিশুদের সংখ্যা ৩৮%৷ তার মধ্যে প্রথম দেশ হল আফগানিস্থান, দ্বিতীয় নম্বরে আছে আমার স্বদেশ ভারতবর্ষ৷ যেখানে ২১ % শিশু ম্যালনিউট্রিশনে ভুগছে, যেখানে শ্রীলঙ্কায় এই সংখ্যা ১৫%, বাংলাদেশে ১৪%। হ্যাঁ বাংলাদেশও আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে, যাচ্ছে। এবং এর প্রভাব বিরাট, কারণ এই শিশুরাই আগামী দিনে শ্রমের ভাণ্ডার৷ এই ম্যাল নিউট্রিশনে ভোগা শিশুরা।
এন এফ এইচ এস ৫ এর রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-২০২১ এর মধ্যে ৩৫.৫%, ৫ বছরের কম শিশু স্টান্ট, মানে তাদের জন্মের সময় থেকে তাদের মস্তিষ্কে প্রয়োজনের তুলনায় কম অক্সিজেন যাচ্ছে৷ তারা খানিক জড়, খানিক অসুস্থ, ৩২.১% শিশু আন্ডারওয়েট, তাদের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম। এ দিকে কাগজের বিজ্ঞাপন বলছে, পোষণ সপ্তাহ চলছে। সরকারের কাছে দিবস পালন, সপ্তাহ পালন, বছর পালন হয়ে উঠছে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ দেশ অমৃত কালে ঢুকে পড়েছে৷ আজাদির অমৃতকাল উদযাপন হচ্ছে৷ শিশু দিবস পালন করা হচ্ছে৷ পোষণ সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এবং এইখানে এসে, একটা প্রশ্ন তো ওঠেই যে এ তো বহু বছরের জমা পাপ৷ ৪৭ সাল থেকেই এই অবহেলা তো চলেছে, নরেন্দ্র মোদি নতুন আর কী করছেন? এটা সত্যি যে স্বাধীনতার পর থেকেই এই বিষয়ে অবহেলা ছিল, সরকারের যা করার, তা সরকার করেনি৷ একটা দেশের সবল শিশু, সুস্থ শিশু তার সম্পদ, সেই হিউম্যান রিসোর্স, মানবিক সম্পদকে অবহেলা করা হয়েছে৷ যার প্রভাব সুদুরপ্রসারী৷ কিন্তু, কিন্তু কিছু তো হচ্ছিল৷ যার ফলে সামান্য হলেও কিছুটা উন্নতি হচ্ছিল৷
ধরুন মিড ডে মিল চালু করা, সন্তান হবে এমন মায়েদের কিছু পুষ্টিকর খাবার দেওয়া, কিছু মিনারেল, ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছিল৷ ডিমের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, মুরগিরও৷ দেশের পশ্চিমাঞ্চলে দুধের উৎপাদন বেড়েছে৷ হোয়াইট রেভেলিউশন, এসবই হয়েছে ওই ৮০ র দশক থেকে৷ ফলে কিছুটা হলেও অবস্থার উন্নতি শুরু হয়েছিল৷ হঠাৎই সবকা সাথ, সবকা বিকাশ এসে হাজির৷ না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা৷ দেশ ক্ষুধার্ত, অর্থনীতির ডামাডোল অবস্থা, একের পর এক অশিক্ষিত, অর্থহীন সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে তুলছে৷ জিনিষপত্রের দাম বাড়ছে৷ পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ছে৷ স্বাভাবিকভাবেই অন্য সমস্ত কিছুরই দাম বাড়ছে৷ ওদিকে বেকারত্ব গত ৫০/৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙে নিত্য নতুন রেকর্ড গড়ছে৷ সরকার রামমন্দির নিয়ে ব্যস্ত, দেশের নাগরিকদের নাগরিকত্ব নিয়ে ব্যস্ত, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা নিয়ে ব্যস্ত৷ কোথাও প্যাটেল, কোথাও হনুমানের মূর্তি তৈরি হচ্ছে। নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হচ্ছে, কখনও রামনবমী, কখনও হিজাব, কখনও বোরখা, কখনও গোমাংস, আর সেই নিয়েই চলছে দেশ। দেশের শিশুরা খাবার চায়, পুষ্টি চায়, সুস্থ শরীর চায়, এবং এই চাহিদা তো সেই শিশুর অধিকার, সেই অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে এক দুর্বল দেশ তৈরি করার লক্ষ্য অবিচল এই মোদিজীর সরকার৷ সেই দেশ যেখানে একধারে থাকবে প্রাচুর্য, অঢেল দুধ, ঘি, পনির, মাশরুম, মাছ, মাংস, ডিম। অন্যদিকে কদ্দু কা সবজি আর হনুমানের মূর্তি।