১৯৭৫-এ একটা ছবি ছিল, ঘোড়ায় চড়ে ডাকাতরা গ্রামে আসতো আর, আরে ও গাঁওবালো, বলে আনাজের বস্তা আর যা কিছু পেত নিয়ে চলে যেত। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, শোলে ছবির গব্বর সিং। তারপর বহু ছবিতে এই তোলাবাজদের দেখা গেছে, কোথাও তারা দাউদ গ্যাংয়ের মেম্বার, কোথাও হপ্তা উসুলি। মোদ্দা কথা হচ্ছে বন্দুকের ডগায় মানুষকে রেখে তাদের কাছ থেকে টাকা তোলা, লুঠতরাজ চালানো। তো সেই গব্বর সিংয়ের রোলে এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আরে ও গাঁওবালো? না, এরকম বলছেন না, অনেক কায়দা আছে, উনি গ্রামের সম্পন্নদের ঘরে ইডি আর সিবিআই পাঠিয়ে দিচ্ছেন, তারপরে টাকা আদায় করছেন। সেই টাকা অকাতরে বিলিয়ে এমএলএ-এমপি কিনছেন, দল ভাঙাচ্ছেন, দল চালাচ্ছেন এবং দেশের এক বিরাট টাকা ওই সম্পন্নদের ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, আবার তার বদলে তাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। হ্যাঁ, চৌকিদার এখন গব্বর সিং, চোর নয় ডাকাত। ২০১৭ সালে এল এই নির্বাচনী বন্ডের কায়দাটা, অরুণ জেটলি তখন অর্থমন্ত্রী, তিনি সংসদে জানালেন যে নির্বাচনে কালো টাকার দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য এই ইলেকশন বন্ড আনা হল, ১০০০ টাকা থেকে ১ কোটি টাকার বন্ড পাওয়া যাবে, ক্যাশ টাকা দিয়ে নয় রীতিমতো অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পাঠিয়ে যত ইচ্ছে কেনা যাবে, কিনে যে দলকে খুশি দিয়ে দেওয়া যাবে, যাকে ইচ্ছে যত খুশি দাও, যেহেতু অ্যাকাউন্ট থেকেই টাকা আসছে অতএব কালো টাকার ব্যাপারই নেই।
তো এই বিল নিয়ে বিরোধীরা সরব হয়েছিল, কিন্তু তেমন সজোরে নয়, একমাত্র বাম দলগুলো এই বিলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরোধ করে এসেছে। বাকিরা বিরোধিতা করলেও ব্যবস্থা লাগু হয়ে যাওয়ার পরে নিজেরাও ওই বন্ডের পয়সা পেয়েছেন, নিয়েছেন, ভাঙিয়েছেন, খরচ করেছেন। তো সেই শুরুর দিকে প্রশ্ন ছিল মূলত একটাই, আমরাও চতূর্থ স্তম্ভে সেই বিরোধিতার কথা বলেছি। সেটা ছিল গোপনীয়তার কথা, কে টাকা দিচ্ছে, কে টাকা পাচ্ছে তা আপাতভাবে গোপন হলেও স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া তো জানতই। আর এসবিআই তো চলে সরকারের নির্দেশে, কাজেই সরকারে থাকা দল তো জানবেই কে কত টাকা দিল, কে কত টাকা পেল। আর টাকা আসছে কাঁড়ি কাঁড়ি, তার তো কিছু একটা বিধিনিষেধ থাকা উচিত, এমনটা আমরাও বলেছিলাম, কেবল ক্যাশে নয় অ্যাকাউন্ট থেকেই আসছে এটা তো যথেষ্ট নয়, কারণ অ্যাকাউন্টেও তো বহু রকমের ঘাপলা হয়, করা যায়। কিন্তু নীতিগতভাবে এর বিরোধিতা করেছিল কেবল বামেরা। তারা বলেছিল দেশের পুঁজিপতি, কর্পোরেটদের হাতে চলে যাবে দেশের নির্বাচন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আমরা ভেবেছিলাম, আলাদা আর আছেটা কী? সেই ১৯৫২ সাল থেকেই তো নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের টাকা, শিল্পপতিদের টাকা খেটেছে। হ্যাঁ তখন কালো টাকায় সেসব পেমেন্ট হত, এখন কালো টাকা সাদা করার হাজার একটা তরিকা সবার জানা, আর যারা ধরবে তারা যদি সরকারেরই লোকজন হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | সিএএ, নাগরিকত্ব বিল লাগু করার পিছনের কারণটা জেনে নিন
যে যেখানে ক্ষমতাতে আছে তারা তাদের ক্ষমতার বদলে, দয়া আর দাক্ষিণ্যের বদলে পয়সা তুলবে, তার জন্যই এই নির্বাচনী বন্ডের ব্যবস্থা করা হল। চুরি হচ্ছিলই, এবারে সেটা সংগঠিত ডাকাতিতে পরিণত হল। জানা যাচ্ছে ওই লটারি কিং সান্টিয়াগো মার্টিন নাকি ৪০০ কোটি টাকার বেশি ডোনেশন করেছেন ডিএমকের ফান্ডে, স্তালিন যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেসও পেয়েছে, এ রাজ্যে তৃণমূলও পেয়েছে। না, এক পয়সার ডোনেশন বামপন্থীরা পাননি। আসছি সে আলোচনাতে। কিন্তু কোথা থেকে গোটা বিষয়টা এত জটিল হয়ে উঠল? তার দুটো মূল জায়গা আছে, প্রথমটা হল এসবিআই জানিয়েছিল যে এই বন্ড কে দিচ্ছে, কাকে দিচ্ছে, কে পাচ্ছে তা জানা সম্ভব নয়, প্রমাণ স্বরূপ তাদের তরফে বন্ডের ছবি দেখানো হয়েছিল, বন্ডে টাকার পরিমাণ আছে, আছে ডেট, মানে কোন দিনে কেনা হয়েছে সেই বন্ড তা জানা যাবে। সাফ জানানো হয়েছিল যে বন্ডে আর কোনও চিহ্ন নেই যা দিয়ে কে কাকে টাকা দিচ্ছে তা জানা যেতে পারে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল, কিছু হুইসল ব্লোয়াররা প্রশ্ন করেছিল যে আর কেউ না জানুক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া তো জানে, তখন বলা হয়েছিল, কে কিনল জানে, কিন্তু কে পেল তা জানা সম্ভব নয়। কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল যে সেটাও সত্যি নয়, মানে ঝড়ের রাতে এক অভাগা মা তাঁর শিশুটিকে চার্চের সামনে রেখে যাচ্ছেন, বিষয়টা তেমনও নয়। ছেলেটির গলায় লকেট ঝুলছে, সেখানে বংশপরিচয় আছে, লকেটের পিছনে বাবা মায়ের ছবিও আছে, সেটা যেমন ক্লাইমেক্সে জানা যায় তেমনই ক্লাইম্যাক্সে এসে জানা গেল ওই বন্ডের উপরে একটা আলফা নিউম্যারিক কোড আছে, তা সাদা চোখে দেখাও যাচ্ছে না কিন্তু যেই সেখানে আলট্রা ভায়োলেট রে পড়ছে, অমনি সেই নম্বর দেখা যাচ্ছে। মানে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ভালো করেই জানে যে কে কত টাকার বন্ড কিনেছে, এবং যাকে দিয়েছে সে ভাঙাতে এলেই ধরা পড়ে যাবে যে টাকা কাকে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টা বাইরে জানাজানি হয়ে গেল, তখন এসবিআই জানাল যে আসলে টাকাটা কোথা থেকে এল আর কোথায় গেল সেই অ্যাকাউন্টিং হিসেবটা রাখার জন্যে এটা জরুরি ছিল, কিন্তু কেন সেটা আগে জানানো হল না? ওনারা তখন মৌনিবাবা, ধ্যানস্থ হয়ে গেলেন।
দ্বিতীয় গন্ডগোলের বিষয়টা কী? সেটা হল একটা নিয়ম, যা আগে ছিল পরে সংশোধিত হয়। নিয়মটা হল একটা কোম্পানি তার লাভের, মানে খাতায় কলমে সে বছরের লাভের ৭.৫ শতাংশ দিতে পারবে। ১০০০ টাকা লাভ হলে ৭৫ টাকা। এই নিয়ম সংশোধন নয়, এক্কেবারে তুলেই দেওয়া হল। তার মানে যে যত পারেন দিন। ফলও হাতেনাতে। গুচ্ছ গুচ্ছ কোম্পানি এমনও আছে যারা তাদের লাভের ৭.৫ শতাংশ তো দূরের কথা ৩৫ শতাংশ, ৪০ শতাংশ, ৭৫ শতাংশ, ৯২ শতাংশ এমনকী ২২৫০ শতাংশ টাকাও দান করেছেন। এমন কোম্পানিও অনেক আছে যাদের পেড আপ ক্যাপিটাল ৫ কোটি, তারা দান করছে ২৫০ কোটি। কী কাণ্ড বলুন তো। এক লটারি কিং, সান্টিয়াগো মার্টিন, তার গল্প আজ নয়, কাল বলব, সে চার বছরে লাভ করেছে ৬৩৫ টাকা, আর নির্বাচনী তহবিলে, আমাদের গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে দান করেছে ১৩৬৮ টাকা। তার দফতরে, বাড়িতে রেডের পর রেড হচ্ছে, তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হচ্ছে, সম্পত্তি অ্যাটাচ করা হচ্ছে, কিন্তু তিনি গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই দানের পর দান করে যাচ্ছেন। হর্ষবর্ধন প্রয়াগের মেলাতে বসে তাঁর শেষ বস্ত্রটিও দান করতেন, এনার শেষ বস্ত্র দেওয়ার পরেও দান আর থামে না। এবং শেষপর্যন্ত আমরা কী দেখলাম? এপ্রিল ২০১৯ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত যত ইলেকশন বন্ড কেনা হয়েছে, বিভিন্ন দলকে দেওয়া হয়েছে তার ৯৬.৯ শতাংশ এসেছে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে, তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে, আর ব্যক্তিগত দান এসেছে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে। আর কিছু না হোক এই তথ্য বলে দেয় আমাদের দেশের গণতন্ত্র আসলে কর্পোরেট পুঁজির কাছে বিকিয়ে গেছে সেই কবেই, এখন তা আরও শক্তপোক্ত চেহারা নিচ্ছে, এক প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিচ্ছে। এবং এই বিরাট তালিকাতে আপনি দেশের পরিচিত কর্পোরেট হাউসগুলোর নাম সরাসরি পাচ্ছেনই না, মানে ধরুন আদানির নাম নেই, সে ভাবে মুকেশ আম্বানির নাম নেই, টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, ডালমিয়া, গোদরেজ, না কারও নাম নেই। তার মানে কী? ওনারা রাজনৈতিক চাঁদা দেন না? না কি সেখানে আরও বড় খেলা চলে, ওনারা এমার্জেন্সি ফান্ড চালাচ্ছেন, এখনই এমএলএ কিনতে লাগবে ৮০০ কোটি টাকা, সেই জরুরি অবস্থার সামাল দিতেই কি তাঁরা আছেন? এই তালিকাতে তাঁরা নেই মানে তাঁরা টাকা দিচ্ছেন না এটা ভাবার তো কোনও কারণ নেই। স্বাধীনতার পরে এত বড় লুঠতরাজের খবর এর আগে দেশের মানুষ পায়নি, অবাধে লুঠ চালানোর এতবড় লুঠেরাদের সরকার এর আগে ক্ষমতাতে কখনও আসেনি। আগে ব্যবসায়ীদের কালো টাকা বেআইনিভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আসত। এখন সেই বেআইনি কালো টাকাকে সাফ করে ফেক কোম্পানি, শেল কোম্পানি তৈরি করে টাকা আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। ইলেকশন বন্ড আসার পরে ৯টা এমন কোম্পানি তৈরি হয়েছে যাদের কাজকর্মেরও কোনও হদিশ নেই, এরা কেবল নির্বাচনের বন্ড কেনা আর তা দান করার জন্যেই জন্ম নিয়েছে।
আর এই লুটমারে প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল অল্পবিস্তর জড়িত। বিজেপি ৫০ শতাংশ পেয়েছে, কিন্তু গতকালের হিসেব অনুযায়ী তার পরেই আছে কংগ্রেস, তার পরেই আছে তৃণমূল, ডিএমকে আপ থেকে শুরু করে আর জেডি, বিজেডি, জগন রেড্ডির দল, প্রত্যেকে। যে যেখানে সরকারে আছে, সে সেখানে বসেই হপ্তা উসুলি করেছে। বিজেপি এই খেলায় মাহির, তারা এই খেলায় মাস্টার, তাই তারা শুরু করেছে এবং অনেকটা এগিয়ে, কিন্তু বাকিরাও তো আছে। এবং এখন তো সবটাই জানা গেল। বামেরা কি বলছে যে আমরা ওই ডিএমকের সঙ্গে জোটে যাব না? বলছে না। কারণ জোটে না গেলে আপাতত সাকুল্যে ৩ জন সাংসদের মধ্যে দুজন তো ডিএমকের সমর্থনে জিতেছেন, সে নাম দুটো কাটা যাবে। এ রাজ্যে তৃণমূল দল তো নির্বাচনী বন্ড নিয়েছে, সম্ভবত কেভেন্টার্সের টাকা তাদের ঘরে ঢুকেছে, কিছু টাকা ওই সান্টিয়াগো মার্টিনের কাছ থেকেও এসে থাকতে পারে। কিন্তু কমরেড সেলিম যখন সাংবাদিক সম্মেলনে বসে নির্বাচনী বন্ডের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের কথা বলেন, এবং এক বিনয়ী ভাদ্র বউয়ের মতো কংগ্রেস বা ডিএমকের নাম নেন না, তখন বোঝা যায়, এই ব্যবস্থায় তাঁদের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ সায় আছে বইকী। আমাদের দেশে গণতন্ত্র বহু কারণেই বিপন্ন ছিল, ফ্রিডম ইনডেক্স নামছিল বছরে বছরে, এখন জানা গেল বিকিয়ে গেছে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও। দেশ এখন তোলাবাজদের দখলে, সেই চোরের মায়ের বড় গলা শুভেন্দু যখন এ রাজ্যে তোলাবাজি নিয়ে কথা বলে তখন বিবমিষা জাগে বইকী। হ্যাঁ, বিবমিষা মানে বমি করার ইচ্ছে, বমি করতে ইচ্ছে হয়।