কোনও কোনও ঘটনা হঠাৎই ইতিহাসের গতিপথকে আচমকাই বদলে দেয়। ঘটনা ঘটে চলছিল একই প্রবাহে, হঠাৎ সে তার অভিমুখ বদলে ফেলে, তার গতিপথ বদলে যায়। এমনটা ইতিহাসে বহুবার আমরা দেখেছি। এখনই মনে পড়ছে জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের ঘটনা। তার আগে পর্যন্ত আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কমবেশি এক বাণিজ্যিক সুযোগ হিসেবেই দেখছিল, তারা জার্মানিতেও রফতানি করছে আবার ইউরোপেও, এবং কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া নিয়ে তারা কিছুটা সন্দিহান। কিন্তু জাপান, অক্ষ শক্তির অন্যতম দেশ পার্ল হারবার গুঁড়িয়ে দিল, মাত্র কিছু মিনিটের এক এয়ার অপারেশনে শ্মশান হয়ে গিয়েছিল আমেরিকান ওই বন্দর। ব্যস, আমেরিকা সরাসরি যোগ দিল মিত্র শক্তিতে এবং সেই দিন থেকেই যুদ্ধ আর তার গতিপথ বদলে গিয়েছিল, গোটা লড়াই ক্রমশ ফ্যাসিবাদের পরাজয়, অক্ষ শক্তির পরাজয়কে নিশ্চিত করেছিল, তার একটা সূত্রপাত তো ছিলই ওই পার্ল হারবার আক্রমণ। ইতিহাসে এরকম উদাহরণ অনেক অনেক আছে। ঘটনা প্রবাহের দিকে চোখ রাখুন, নীতীশ কুমারের উদ্যোগে পাটনায় বিরোধীদের বৈঠক, হতেও পারে নাও হতে পারে, যাঁরা আসবেন তাঁরা কতটা মন থেকে আসবেন এসব জল্পনা কল্পনার মধ্যেই প্রথম বৈঠকের শেষে বেঙ্গালুরুতে দ্বিতীয় বৈঠক। সদ্য কর্নাটক জিতেছে কংগ্রেস, কাজেই এক দারুণ ঐক্য আবহে জোট প্রক্রিয়া শুরু, নামও হয়ে গেল, তখন বিজেপির রিঅ্যাকশনটা খেয়াল করুন। পাল্টা বৈঠক ডাকল তারা, তার আগে এনসিপিকে ভেঙেছে, গুচ্ছের চুনোপুঁটিদের নিয়ে স্বয়ং মোদিজি বৈঠকে বসলেন, কতদিন পরে এনডিএ-র বৈঠক হচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা শুরু হল।
এরপর মুম্বইয়ে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক, বোঝা গেল জোটে বহু সমস্যা আছে, এবং জোট ভাঙার প্রথম পদক্ষেপও কিছুদিনের মধ্যেই সামনে এল। নীতীশ কুমারের ঘর ওয়াপসি। কিছুদিনের মধ্যেই আপ-এর ঘোষণা আমরা একাই লড়ব, বাংলায় মমতা জানিয়ে দিলেন রাজ্যে কোনও জোট নেই। একলাই ৪২টা প্রার্থীর ঘোষণা, ওদিকে রাহুল চলেছেন আপন খেয়ালে, কে যেন বলেছে পথে এবার নামো সাথি পথেই হবে এ পথ চেনা। তো রাহুল পথে, পথ চিনেছেন কি না সে প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? কাজেই বিজেপি শিবিরে এক আনন্দের সুপবন বহিতে লাগিল, সারা দেশে বিরোধী শিবিরের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুখ তখন জয়রাম রমেশ বা কে সি বেণুগোপালকে দেখলেই বোঝা যায়। মনেই হচ্ছিল অবকি বার চারশো পার না হলেও তার খুব কম কি কিছু হবে? আমরাও, মানে আমরা এখনও সত্যি বলতে চাওয়া সংখ্যালঘু সাংবাদিকের দল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম বিরোধী শিবিরের অনিবার্য আত্মসমর্পণ। এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছিল কেজরিওয়াল গ্রেফতার হতেই পারেন, সত্যি বলতে কী আমাদের মনে হয়েছিল এটা ভোটের আগে এক বিষম প্রচার, এটা এক ধরনের হাওয়া যা তোলা হবে, যা আম আদমি পার্টির তরফেও তোলা হচ্ছে আবার বিরোধীদের ভয় দেখানোর জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। হঠাৎ বেশ নাটকীয়ভাবেই কেজরিওয়ালকে খুব দ্রুত গ্রেফতার করা হল। কিন্তু এই গ্রেফতারির পরেই হঠাৎ ইন্ডিয়া জোট তার গতি ফিরে পাচ্ছে। ইন্ডিয়া জোটের নেতারা একসঙ্গে চলে গেলেন নির্বাচন কমিশনারের কাছে, দিল্লিতে সমাবেশ ডাকা হয়েছে, মজার কথা হল নির্বাচন কমিশনের কাছে ডেলিগেশনে থাকলেন সীতারাম ইয়েচুরি, এবং তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন, মমতা কড়া ভাষায় নিন্দা করলেন, সিপিএম এই গ্রেফতারির নিন্দা করল, যোগেন্দ্র যাদব থেকে কেজরিওয়ালকে ছেড়ে যাওয়া আপ নেতারাও এই গ্রেফতারির বিরুদ্ধে সরব, হঠাৎই বিরোধী শিবিরে এক অন্য হাওয়া। দিল্লির সমাবেশে তৃণমূল সিপিএম থেকে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নেতাদের থাকাটা এখন অনিবার্য।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | রং মাখুন, রং মাখান, রংবাজদের রুখে দিন
কেজরিওয়ালকে কেন্দ্র করে বিরোধী ঐক্য আবার খানিক হলেও ফ্রন্টফুটে। সেদিন নির্বাচন কমিশনারের কাছে দেওয়া ডেপুটেশনে দেশের বিরোধী নেতারা কী জানিয়েছেন? তাঁরা কেবল কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির বিরোধিতা করেছেন এমনও নয়। সেখানে দেশজুড়ে তৃণমূল, আরজেডি সমেত বিভিন্ন দলের নেতাদের জেলে পোরার যে চেষ্টা চলছে তা নিয়েও কথা বলছেন। বলেছেন যে এগুলো আসলে বিরোধীদের জেলে পোরার পরিকল্পনা চলছে তা না হলে যে লোকটা নিজেই অভিযুক্ত, তাকে রাজসাক্ষী করে, তার বয়ানের ভিত্তিতে একজনকে এরকমভাবে জেলে পোরা বা তার ওপরে দুর্নীতির অভিযোগ আনা তো যায় না। এবং সেটা বলতে গিয়ে তৃণমূল সমেত বাকি বহু দলের কথা বলা হয়েছে সেই ডেপুটেশনে যাতে সই করেছেন সীতারাম ইয়েচুরি থেকে ডেরেক ও’ব্রায়েন। দিল্লিতে আপ কংগ্রেস জোট আরও পোক্ত হল শীলা দীক্ষিতের পুত্র সন্দীপ দীক্ষিত যিনি নাকি কিছুদিন আগেও কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির দাবি জানিয়েছিলেন তিনি কেজরিওয়ালের বাড়িতে গিয়ে বলে এসেছেন চিন্তা করবেন না আমরা একসঙ্গে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ব। এই শীলা দীক্ষিতকেই হারিয়ে কেজরিওয়াল দিল্লির ক্ষমতায় এসেছিলেন। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন থেকে মমতা ব্যানার্জি, করুণানিধি পুত্র স্তালিন থেকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী একসঙ্গে কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি বা হেমন্ত সোরেনের গ্রেফতারির বিরোধিতা করেছেন। অর্থাৎ প্রায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন ইন্ডিয়া জোট আবার একটা আকার নিতে চলেছে। হ্যাঁ, এটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ওদিকে নির্বাচনী বন্ড নিয়ে বিজেপি বহু প্রশ্নের মুখোমুখি, এক তোলাবাজের চেহারা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, দক্ষিণে এখনও পা রাখার জায়গা পাচ্ছে না বিজেপি, কর্নাটকে বিজেপি নেতা ইশ্বরৈয়া চলে এলেন কংগ্রেসে, আরও বেশ কিছু নেতা কংগ্রেসে আসছেন, কর্নাটক বিজেপি সমর্থক আর জেডিএ সমর্থকরা টুমকুরে লড়ে যাচ্ছে, মহারাষ্ট্রে এখনও আসন ভাগাভাগির ফর্মুলা বের হয়নি, বিহারে লোক জনশক্তি নেতা পারসনাথ, রামবিলাস পাসোয়ানের ভাই বেঁকে বসেছে, বিজু জনতা দল ওড়িশাতে সমঝোতা করছে না, বাংলাতে এখনও চারটে আসনে প্রার্থীর নামই ঘোষণা করতে পারল না বিজেপি। উত্তর পূর্বাঞ্চলে ক্যান্ডিডেট দিচ্ছে না বিজেপি, তারা জানে মণিপুরের পরে তারা উত্তর পূর্বাঞ্চলে নিজেরা দাঁড়ালেই হারবে। সব মিলিয়ে খুব স্বস্তিতে আছে বিজেপি? একদম নয়। কেকওয়াক তো ছেড়ে দিন বিভিন্ন রাজ্যে উপর থেকে যা মনে হয়েছিল এখন গ্রাউন্ড রিয়েলিটি আলাদা বলেই খবর আসছে। বরুণ গান্ধীকে পিলভিতে টিকিট দেওয়া হয়নি, তিনি সম্ভবত নির্দল হয়ে দাঁড়াবেন, বিরোধীরা সমর্থন করবেন, বিহার, মহারাষ্ট্র, বাংলা, তেলঙ্গানা, কর্নাটক থেকে বিজেপি কম করে ৪৫-৫০টা আসন হারাতে চলেছে। আর তাই যদি হয় ৩৭০-এর টার্গেট তো বাদই দিলাম ২৭৩-এ বিজেপি পৌঁছবে কি না তা নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ আর ক’দিনের মধ্যেই গাঢ় হয়ে উঠবে। এবং কেজরিওয়ালের গ্রেফতার আমাদের দেশের ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের এক টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াবে। এই জন্যে নয় যে কেজরিওয়াল অন্যায় করতেই পারে না, এই জন্যেও নয় যে আপ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনও ভিত্তিই নেই এবং সেটা প্রমাণিত, না তা নয়। অভিযোগ আছে, তার তদন্ত হওয়া উচিত, কিন্তু সেই তদন্তের জন্য একটা নির্বাচিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে এখনই, নির্বাচনের ক’দিন আগেই গ্রেফতার করে জেলে পুরে রাখতে হবে এটা মানুষকে বোঝানো খুউউব খুউব কঠিন। মানুষ বরং উল্টে বিশ্বাস করছে যে এজেন্সিগুলোকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি দেশের বিরোধী নেতাদের জেলে পুরে এক বিরোধীহীন রাজনৈতিক পরিসর পেতে চাইছে।
তার মানে সাততাড়াতাড়ি হেমন্ত সোরেন বা কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করার পরে দুটো জিনিস হল। এক, দেশের তাবৎ বিরোধী দল এবং নেতা আবার এক টেবিলে এসে বসলেন, দেশের বিরোধী নেতারা সম্মিলিতভাবে বিজেপিকে আটকানোর একটা মরিয়া চেষ্টায় নামবেন। দিল্লির জনসভার দিকে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে, সেই অর্থে এটাই ইন্ডিয়ার প্রথম জনসভা যেখানে প্রত্যেক বিরোধী দলের নেতারা হাজির থাকবেন, কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির ফলেই এটা সম্ভব হল। দুই, মানুষের সামনে এটা এখন পরিষ্কার যে বিজেপি তার বিকাশ বা রামমন্দির ইত্যাদি নিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাবে এমনটা ভাবছে না, আর ভাবছে না বলেই বিরোধী নেতাদের জেলে পুরে এক অসমান জমিতে নেমে লড়ার পরিকল্পনা করছে বিজেপি। শোনা যাচ্ছে দিল্লির জনসভাতে ২০০৪ ফিরিয়ে আনার স্লোগান দেওয়া হবে যে নির্বাচনে ইন্ডিয়া শাইনিং ইত্যাদি বলার পরে প্রায় নিশ্চিত জয় এসেই গেছে ভেবে নেওয়া বিজেপি হেরেছিল। সারা দেশে যদি সত্যিই বিরোধী দলের নেতারা নতুন উদ্যমে এই ইস্যুকে সামনে রেখে তাঁদের ভুল শুধরে মাঠে নামতে পারেন, তাহলে ইতিহাসের গতিপথ? হ্যাঁ, বদলাতেও পারে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে থাকে উত্তেজনা, হঠাৎ সব ছক ভেঙে এক নতুন ইতিহাস তৈরি হয়েছে বার বার, আমাদের দেশ তেমন এক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে।