দুটো তথ্যকে সামনে রেখে আজকের আলোচনা শুরু করবো। প্রথম তথ্য, মোহন ভাগবত, আরএসএস সর-সংঘচালক, বাংলায় আরএসএসের প্রধান, তিনি গতকাল সংঘের সংখ্যালঘু মঞ্চে ভাষণ দিতে এসে বললেন, জয় শ্রীরাম বলানোর জন্য গণধোলাই দিয়ে খুন করছে যারা, তারা প্রকৃত হিন্দু নয়, তার সঙ্গেই জুড়েছেন আর একটা কথা, বলেছেন যে, সবসময় এই ধরণের অভিযোগ অবশ্য সত্যিও নয়। যাইহোক অন্তত এই কথা, যে গণপিটুনিতে জড়িতরা প্রকৃত হিন্দু নয়, এটাও ওনার মুখ থেকে এতদিন শোনা যায়নি, যখন একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছিল, তখনও শোনা যায়নি। আজ হঠাৎ তাঁর মুখে এই কথা শুনে অনেকেই অবাক, অনেকে নন।
কারণ সেই গুজরাট, উত্তরাখন্ড, থেকে ইউপি, বিহার, এম পি, কর্ণাটকে দলের মধ্যে কোন্দল বাড়ছে, বাড়ছে নব্য বিজেপিদের আমদানি, আর সবাই তো শুভেন্দু অধিকারী নন, যিনি ক্লাস ফোর থেকে আরএসএস করে কেবল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার জন্য তৃণমূল করতেন, সময় বুঝে ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফিরে গেছেন! অনেক নব্যরা, যাদেরকে মূলত কংগ্রেস বা বিজেপি বিরোধী দলগুলো থেকে ভাঙিয়ে আনা হচ্ছে, তাদের সকলে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করার জন্য নয়, রাজনৈতিক কেরিয়ারের কথা ভেবেই বিজেপিতে আসছেন, জিতিন প্রসাদ থেকে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া তো আরএসএস করতে রাজনীতিতে আসেননি, তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা নিয়েই এসেছেন, এসে তাঁদের ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, সেই বেসুমার উচ্চাকাঙ্খার ফলে বিজেপির সংগঠন নড়বড় করছে, তিনবার মুখ্যমন্ত্রী বদলে গেলো উত্তরাখন্ডে, কর্ণাটকে এইচ বিশ্বনাথ নিয়ম করে রোজ মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরিয়াপ্পার বিরুদ্ধে বলে চলেছেন, গুজরাটে রূপানি ভদোদরায় স্টেজে উঠে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, চাপ এতটাই বেড়েছে, উত্তরপ্রদেশে তো যোগীর উল্টোদিকে স্বয়ং মোদি – শাহ। এই টালমাটাল সময়ে এটা পরিস্কার যে, বিজেপির কোর ভোটার সরে যাচ্ছে, কেবল হিন্দু ভোটার দিয়ে নির্বাচন জেতা যাবে না। কিছুদিন আগে কাঁথির খোকাবাবু বলেছিলেন না, ওরা ৩০ নিয়েই থাকুক, আমরা ৭০ এর পুরোটাই পাব, তো খোকাবাবু শুভেন্দুর অঙ্কের হিসেব মেলেনি, ৭০ এর ৫০/৫১% পেয়েই খুশি থাকতে হয়েছে, হাত থেকে ফসকে গেছে মুখ্যমন্ত্রীত্বের গদি, এই হিসেব আরএসএসেরও চোখে পড়েছে, পড়েছে বলেই তারা জানে কেবল হিন্দু গরিষ্ঠাংশের ভোটও তাঁরা পাবেন না, যা পাবেন তাই দিয়ে আবার ফিরে আসা অসম্ভব। তার ওপরে জাঠ, তপশিলিজাতি বা উপজাতিভুক্ত মানুষের ভোটও তাঁরা পাচ্ছেন না, মুসলিম ভোট তো দূরের কথা। সেটা মগজে ঢুকেছে বলেই মেরামতিতে নেমেছেন, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত, তিনি জানেন এবার ক্ষমতা চলে গেলে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ চিরকালের জন্য অধরাই থেকে যাবে, তাই হঠাৎ মন্থরার মুখে মিষ্টি কথা, তিনি বলছেন, জয় শ্রীরাম বলে যারা গণ পিটুনি দিচ্ছে, তারা নাকি হিন্দু নয়, কেবল মুসলিম বলে একজনকে গায়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মেরে ফেলার পর জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসলে, তাকে সম্বর্ধনা দেয় যে দল, সেই দলের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মাথা আজ বেসুরো। মুসলমানও নয়, নিচু জাত বলে বেঁধে পেটানো হল মাত্র গত পরশু, মধ্যপ্রদেশের সেই ভয়ঙ্কর ভিডিও আপনারা দেখেছেন? কারা চালায় মধ্যপ্রদেশ? আদিত্যনাথ যোগী প্রকাশ্য জনসভায় বলে হিন্দু আর মুসলমান দুটো আলাদা জাতি, তারা একসঙ্গে থাকতে পারে না, কোন দলের মুখ্যমন্ত্রী এই আদিত্যনাথ যোগী? এই বাংলার নব্য কাক্কেশ্বর, নতুন কাকে কী যেন বেশী খায়, তো সেই নতুন কাক যখন ৭০ আর তিরিশের গল্প বলছিল রাজ্য জুড়ে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বেগম বলে ব্যঙ্গ করছিল? তখন কোথায় ছিলেন মোহন ভাগবত? বাংলা দখল করতে পারলে এসব অমৃত বাক্য তাঁর মুখে শোনা যেত? যেত না। এরই নাম ফান্দে পড়িয়া বগায় কান্দে, আরএসএস সর-সংঘচালক আপাতত ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন, সেকুলার ভোটে থাবা মারার বাজে প্রচেষ্টা!
এবার আসুন দ্বিতীয় তথ্যটা দেখি, পিউ রিসার্চ সেন্টার, এদের কথা আগেও বলেছি, এক আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা দেশে দেশে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করে, সেই তথ্য সবার সামনে রাখে, তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সমীক্ষা করেছেন, আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষজনদের নিয়ে। তাঁদের সমীক্ষা বলছে, আমাদের শেষ জনগণনা, ২০১১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী, হিন্দু জনসংখ্যা ৮১%, মুসলমান ১২.৯%, খ্রিস্টান ২.৪%, শিখ ১.৯%, বৌদ্ধ ০.৭%, জৈন ০.৪% এবং অন্যান্য ০.৬%। এদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের ৩০ হাজার মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে, এই সমীক্ষা করা হয়েছে। তাতে খুব উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্য উঠে আসছে। বলা হয়েছে, ১০০ জনের মধ্যে গড়ে ৮৪ জন বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করা উচিত বলে মনে করেন। ৯১% মানুষ মনে করেন, তাঁরা তাঁদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারছেন। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে ৬৬% মানুষ মনে করেন, তাঁদের ধর্ম মুসলমানদের সঙ্গে মেলে না, ৫৯% মনে করেন তাঁদের ধর্ম খ্রিস্টানদের সঙ্গে মেলে না, আবার মুসলমানদের ৬৪ % মনে করেন, তাঁদের ধর্ম হিন্দুদের সঙ্গে মেলে না, ৫৪% মনে করেন মুসলমান ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে মেলে না। খ্রিস্টানদেরও ৫৮% মনে করেন যে হিন্দু ধর্ম একেবারেই আলাদা, ৬২% মনে করেন মুসলমান ধর্মও একেবারেই আলাদা। হিন্দুদের ৬৭% তাদের ঘরের নারীদের মুসলমান বিয়ে করলে আটকানোর চেষ্টা করবেন, ৬৫ % তাদের ঘরের পুরুষদের মুসলমান নারী বিয়ে করলে আটকাবেন, অন্যদিকে মুসলমানদের ৮০ % হিন্দু মহিলা বিয়ে করলে আটকাবেন, ৭৬ % হিন্দু যুবকের সঙ্গে তাদের ছেলেদের বিয়ে দিতে নারাজ, খ্রিস্টানরা তুলনামূলক ভাবে কম গোঁড়া, তাদের ৩৭ জন ঘরের মেয়েকে অন্য ধর্মে বিয়ে দিতে নারাজ, ৩৫ জন তাদের ঘরের ছেলেকে অন্য ধর্মে বিয়ে করলে আটকানোর চেষ্টা করবেন। হিন্দু জনসংখ্যার ৩৬% মুসলমানদের তাদের পড়শি হিসেবে চান না, মুসলমানদের ১৬ % হিন্দুদের তাদের পড়শি হিসেবে চান না, এই ছবি উত্তর আর দক্ষিণে অনেকটাই আলাদা। এবার আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ভারতবাসী হিসেবে হিন্দু জনসংখ্যার ৬৪ জন মনে করেন, সত্যিকারের ভারতীয় হবার জন্য হিন্দু হওয়াটা খুব জরুরি, এদের মধ্যেই ৫৯ জন মনে করেন সত্যিকারের ভারতবাসী হবার জন্য, হিন্দি বলা বা জানাটা খুবই জরুরি। এইখানে এসে যাবতীয় হিসেবের বেড়া ভেঙে গেলো, এই তথ্যই বলে দিচ্ছে ঠিক কিসের ওপর ভিত্তি করে বিজেপি মাঠে নেমেছে, তাদের ভোট ব্যাঙ্কটা কোথায়? হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান যাদের শ্লোগান, তারা ঠিক এই জনগোষ্ঠী, এই জনসংখ্যাটাকেই বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, গড়ে ৫১% হিন্দু মনে করে ভারতীয় হবার জন্য হিন্দু হওয়া এবং হিন্দি বলতে পারা, দুটোই অত্যন্ত জরুরি। অন্যদিকে ২০১৯ এর নির্বাচনের তথ্য বলছে, হিন্দু জনসংখ্যার ৪৯% বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, তারাই বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক। মানে দেশের ৮১ % হিন্দু মানুষ জনের মধ্যে যারা ভোট দিয়েছে, তাদের ৪৯%, প্রায় অর্ধেক বিজেপির সমর্থক। আর সম্প্রতি হয়ে যাওয়া বাংলা, কেরল, তামিলনাডু, অসমের নির্বাচন জানাচ্ছে যে সেই সংখ্যা বাড়েতো নিই, বরং কমছে, বাংলায় সে সংখ্যা ৪১%, মানে এ বাংলার হিন্দু ভোটারদের ৫৯% হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের ভোট দেয়নি। অসমেও তাই, কেরল, তামিলনাড়ুতে আরও খারাপ অবস্থা। কাজেই জেতার জন্য কেবল গোঁড়া হিন্দু ভোট হলেই চলবে না, হিন্দুদের মধ্যেও যারা উদার, অন্য ধর্মের ভোটারদের ভোটও চাই।
হ্যাঁ জনসংখ্যার ৮৪% মানুষ এখনও মনে করেন যে অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করা উচিত, তারা ধর্মের, কেবল ধর্মের ভিত্তিতেই এক রাষ্ট্র তৈরি করার স্বপ্ন দেখে না। তাদের মধ্যে যে ৫৯% সত্যিকারের ভারতীয় হওয়ার জন্য হিন্দু হওয়া আর হিন্দি বলাকে আবশ্যিক মনে করেন, এই সংখ্যাও বিজেপির নির্বাচনের তরী পার করার জন্য যথেষ্ট নয়, কারণ উত্তর আর দক্ষিণের বিরাট তফাত, এই ৫৯% এর ৮০ % এসেছে উত্তরভারতের গো-বলয় থেকে, এবং এর উল্টোদিকে জড় হচ্ছে ৪১% হিন্দু মানুষজন, তাদের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষদের যোগ করলে বিজেপির হিসেবে গ্যামাক্সিন পড়বেই, ঠিক সেই জন্যই মাঠে নেমেছেন মোহন ভাগবত, যাঁর নেতারা খুল্লমখুল্লা হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান, হিন্দুরাষ্ট্রের শ্লোগান দেন, দিয়েছেন, তিনি আজ মাঠে সেকুলার মুখোশ পরে নামছেন, কাক ময়ূরের পালক খুঁজে পেয়েছে বটে, কিন্তু তা পেছনে গুঁজে নিলেই কাক ময়ূর হয়ে যাবে না, এ কথা বলাই বাহুল্য। অতএব মোহন ভাগবতজি, এসব বলার দিন পার হয়ে গেছে, মানুষ আপনাদের আসল চেহারা জেনে গেছে।