ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর বহু দেশেই স্বৈরাচার মাথা তোলে, মানুষের অসতর্ক বিচার আর বোধকে কাজে লাগিয়ে তারা ক্ষমতায় আসে, কিন্তু তা চিরস্থায়ী হয়নি কোনও দিন, ফ্রাঙ্কো পারেনি, হিটলার পারেনি, মোদিজী ও পারবেন না। তাকিয়ে দেখুন ৬৭০ জন শহীদ হা হা হাসছে, হাসছে তাদের পরিবার, তাদের বন্ধুরা হাসছে, আজ পঞ্জাবে অকাল বৈশাখি, আজ তুমুল ভাংড়া নাচ, ফসল গোলায় তোলার আনন্দ, পাকা ধানে সুঘ্রাণ, হেরেছে হেরেছে নরেন্দ্র মোদি হেরেছে। বহু বছর আগে ২১ এ মার্চ, ১৯৭৭ ভোররাতে খবর এল রায়বেরিলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিজেই হেরে গেছে, রাস্তায় মানুষজন নেমে পড়েছিল, এক স্বৈরাচারীর হার, জেলে বন্দী জর্জ ফার্ণান্ডেজ, জেলে বসেই স্লোগান তুলেছিলেন, হিটলরশাহী নহিঁ চলি জব, জেলের বন্দিরা বলেছিল, ইন্দিরা শাহী নঁহি চলেগি, অথচ এই ফল বের হওয়ার কদিন আগেও মনে হয়েছিল, এ অমানিশা আর কাটবে না কোনও দিন। হিটলার অস্ট্রিয়া নিল, চেকোশ্লোভাকিয়া নিল, পোলান্ড নিল, হু হু করে ঢুকে পড়ল রাশিয়াতে, স্তালিনগ্রাদের দরজায় দাঁড়ালো নাৎসী ট্যাংকবাহিনী। প্রতিদিন এগোচ্ছে হিটলার, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস– বিদায় নেবার আগে তাই, ডাক দিয়ে যাই। দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে, প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।
হেরেছিল হিটলার, হেরেছিল, বাঙ্কারে পড়েছিল আধপোড়া মৃতদেহ। ইদি আমিন থেকে পল পট, জিয়াউর রহমান থেকে জিয়াউল হক, প্রত্যেকে হেরেছে, তাদের নির্মম পতন ইতিহাসের শিক্ষা বয়ে এনেছে, স্বৈরাচারই শেষ কথা নয়, নরেন্দ্র মোদী – অমিত শাহই শেষ কথা নয়। আজ আবার প্রমাণিত, বাধ্য হলেন আমাদের চৌকিদার কাম চা-ওয়ালা, নিঃশর্তে ফিরিয়ে নিল তিনটে কৃষি আইন। আসুন কোন প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত, দেখে নেওয়া যাক।
কদিন আগেই বলেছিলাম, বিজেপির প্রতিটা সিদ্ধান্ত, প্রতিটা পদক্ষেপ আপাতত নির্বাচনকে মাথায় রেখেই নেওয়া হচ্ছে, কতদিন? যতদিন না তারা পুরো সংসদীয় ব্যবস্থাকে তাদের কব্জায় আনতে পারছে, যতদিন না তারা এই ব্যবস্থা পালটে তাদের মনের মত এক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা তৈরি করে নিতে পারছে, যে ব্যবস্থা এই আপাত নির্বাচন, এই আপাত গণতন্ত্রেরও চিহ্নমাত্র থাকবে না, সেদিন আর তারা নির্বাচনের ওপর নির্ভরশীল হবে না।
হিটলারের উত্থানের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখুন, তারাও এই সংসদীয় ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েই তাদের স্বৈরাচারকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, আরএসএসএর কর্তারা খুব ভাল করেই জানেন, উত্তরপ্রদেশে হার মানে, আগামিদিনে ভারতবর্ষের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া৷ তাই এই এক পা পেছোনো, কেন এসেছিল এই কৃষি বিল? দেশের কর্পোরেট ফড়েদের ব্যবসার সুবিধে করার জন্য, আমাদের অন্নদাতাদের বলি চড়ানোর জন্য, দেশের নিরন্ন মানুষদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবার জন্য, আমরা সে কথা জানি। আজ তারা কী চাইছে? তাদের ভুল তারা বুঝতে পেরেছে? তারা অনুতপ্ত? এই কৃষি আইন যে আসলে দেশবিরোধী তারা সেটা বুঝতে পেরেছে? এই তিনটে কৃষি আইন যে আমাদের অন্নদাতাদের পথে এনে দাঁড় করাত, তা কি তারা বুঝেছে? একবারের জন্যও যারা এটা ভাববে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। কারণ সাত সকালে, চৌকিদার কাম চা ওয়ালার এই ভাষণ ছিল নেহাতই ঠেলার নাম বাবাজী, গর্তে পড়ার পরে ওপরে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা। আজ সকালে যখন ট্রিম করা দাড়ি নিয়ে, প্রশান্ত মুখে, স্মিত হাসি মুখে রেখে ঘোষণা করলেন তিনটে কৃষি আইন, আগামী সংসদ অধিবেশনে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। ১৭ মিনিত ৪৪ সেকেন্ডের ভাষণে, ১৩ মিনিট ৩০ সেকেন্ড তিনি বা তাঁর সরকার, কৃষকদের জন্য কী কী করেছেন, কৃষি আইন কত ভালো, কৃষকদের কত উন্নতি হত এসব বলার পর তিনি দু লাইনে আইন ফেরত নেবার কথা বললেন, এবং ভালো করে খেয়াল করে দেখুন, তিনি শেষ করলেন এই বলে যে এবার একটা কমিটি তৈরি হবে, সেই কমিটি নাকি কৃষকদের জন্য, তাদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কী করা উচিত, তা নির্ধারণ করবে, তার মানে আবার ঘুরপথে চেষ্টা চালাবে মোদি সরকার, উনি আপাতত পিছু হটলেন, এটা কিছুটা স্ট্রাটেজিক পিছু হটা, যাকে গ্লোরিয়াস রিট্রিত বলা হয়, কিন্তু সুযোগ পেলেই আবার বিষদাঁত দেখাবে, এটা পরিস্কার।
কী করেছে এই সরকার কৃষকদের জন্য? এই নরেন্দ্র মোদি বলেননি? কৃষকদের আয় দ্বিগুন করে দেবেন? আম্বানির আয় ২০০ গুণ বেড়েছে, আদানির আয় বেড়েছে ২৫০ গুণের বেশি, কৃষকদের আয় কতটা বেড়েছে? গত ৫০ কি ৬০ বছরে কৃষকদের আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ, এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে কতটা উন্নতি হয়েছে আমাদের অন্নদাতাদের। সারের ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয়েছে, সেচ এখনও অধরা, চাষ এখনও মেঘের ভরসায়, ব্যাঙ্কের লোন অমিল, বাজার এখনো ফড়েদের হাতেই, সবজির দাম আকাশ ছুঁলেও চাষির ঘরে অন্ন নেই। প্রধান সেবকের জুমলা বাজি ছিল, কৃষকের আয় নাকি দ্বিগুণ করা হবে, দ্বিগুণ হওয়া তো দুরস্থান, তাদের আয় প্রকৃত পক্ষে কমেছে। অথচ তাকিয়ে দেখুন, একমাত্র এই কৃষি ক্ষেত্র লাগাতার আমাদের জিডিপিতে পজিটিভ গ্রোথ দিয়ে যাচ্ছে৷ এবং সেই কৃষকরাই ৫৬ ইঞ্চির অহঙ্কার চূর্ণ করে, এক বছর ধরে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে গেল, যার সামনে আজ ৫৬ ইঞ্চিকে হাজার কথা বলার পরেও পিছু হটতে হল, নিজের ডায়রিতে এই গ্লোরিয়াস রিট্রিট লিখে রাখলেও ভারতের ইতিহাস একে, এক স্বৈরাচারীর পরাজয় হিসেবেই মনে রাখবে।
কোথায় গেল সেই অর্বাচীনরা? যারা এই কৃষক আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আড্ডা বলে চালানোর চেষ্টা চালিয়ে ছিল? কোথায় গেল সেই দেশ ভক্তের দল? যারা দেশের অন্নদাতাদের দেশদ্রোহী বলেছিল? তাদের সমর্থনে যারা কথা বলার চেষ্টা করেছে তাদের দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালিয়েছিল? সিঙ্ঘু টিকরি বর্ডারে কপালে গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে হামলা চালানেওয়ালা, গেরুয়া বাহিনী কোথায়? গাজিপুর বর্ডারে টিকায়েতের জমায়েতে যে বিজেপি এমএলএ গুন্ডা নিয়ে গিয়ে হামলা চালিয়েছিল, তারাই বা কোথায়? আজ অন্নদাতাদের কথা মনে পড়ছে দেশের চৌকিদারের? সেদিন কোথায় ছিলেন তিনি? যখন তাদের রাস্তার ওপরে লোহার পেরেক দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছিল? পুলিশের জলকামান ওই তীব্র শীতে জল ছড়াচ্ছিল আমাদের অন্নদাতাদের সর্বাঙ্গে, কোথায় ছিলেন তিনি? এখন নৌটঙ্কি? এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুটো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আর তিনটে কুখ্যাত বিল (যা পরে আইনে পরিণত হয়) আনা হয়েছে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আটকানো যায় না, আটকানো যায়নি, ডিমনিটাইজেশন আর জি এস টি, এখনও দেশের মানুষ তার বোঝা বয়ে চলেছে।
এবার আসুন তিনটে বিলের কথায়৷ প্রথম বিল জম্মু কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করে দু টুকরো করে দেওয়া৷ তাকিয়ে দেখুন বছর ঘুরে গেছে, সেখানকার সমস্যা রোজ জটিল থেকে জটিলতর হয়েই চলেছে, কাশ্মিরী মানুষ আরও বিচ্ছিন্ন মনে করছে, উগ্রপন্থা থামার লক্ষণও নেই। এখন কথা চলছে তাদের রাজ্যের স্ট্যাটাস ফিরিয়ে দেবার, অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে তার আগেই। বিল এসেছে নাগরিকত্বের, সিএএ আর এনআরসি নিয়ে৷ দেশ জোড়া প্রতিবাদ হয়েছে, সেখানেও লাঠি চলেছে, জলকামান চলেছে, মানুষ রাজপথে নেমেছে সংবিধান হাতে নিয়ে। কবে? ১২ ডিসেম্বার নাগরিকত্ব বিলে সই করলেন রাষ্ট্রপতি, এখনো এনআরসি শুরু করার ধক নেই সরকারের, তারা জানে মানুষ আবার পথে নামবে। তৃতীয় বিল এই কৃষি বিল, মিথ্যে কথা, আবার মিথ্যে কথা বললেন দেশের প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে, দেশবাশীর সামনে মিথ্যে বলা অবশ্য এই প্রথম নয়, বরং সত্যি কথা বলবেন এটাও অনেকেই আশাও করেন না, তিনি বললেন, সংসদে অনেক আলোচনার পরে বিল পাশ হয়েছে, আদতে আলোচনার কোনও সুযোগ না দিয়েই এই বিল পাশ করানো হয়েছে৷ তিনি বললেন আন্দোলনরত কৃষকদের আন্দোলনের কথা মাথায় রেখেই এই আইন সরকার ফেরত নিচ্ছে৷ তাই নাকি? এই মুহূর্তে ৩৭ টা ইউএপিএ মামলা ঝুলছে ওই আন্দোলনরত কৃষকদের ওপরে, দেশদ্রোহের মামলা। কারা করেছিল সে সব মামলা? কেন করেছিল?
৬৩ বছরের শুকদেব সিং, সিঙ্ঘু বর্ডার থেকে ফেরেনি, তার লাশ ফিরেছিল, তার ছেলে সেদিন বলেছিল, দেখে নেবেন, এই আইন সরকারকে ফেরত নিতে হবে, আজ তার বাড়িতে লাড্ডু বিতরণ হচ্ছে। প্রায় ৬৭০ জনের বেশি কৃষক মারা গেছেন, এই আন্দোলন চলাকালীন, কে নেবে তার দায়? ৫৬ ইঞ্চির প্রধানমন্ত্রী?
তবে আজকের এই জয় মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জয়, দেশের মানুষ আরেকবার বুঝিয়ে দিল, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ওসব দমন আইন, পুলিশ, ধর্ম বিভাজনের চক্রান্ত, কিছুই কাজ করে না। আজকের জয় আগামী দিনে ফাসিস্তদের আরও বড় পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেবে, কারণ প্রতিটা পদক্ষেপে আমরা বলেছিলাম। হম দেখেঙ্গে,
আমরা দেখবো, মনে রেখো, আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো
অনিবার্য সেই আগামী ভবিষ্যৎ, যা আমাদের,
সেই দিন ও আমরা দেখবো
আমরা দেখবো, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো
যখন তোমাদের সব অত্যাচার সব ফতোয়া তুলোর মত উড়ে যাবে
আম আদমির পায়ের চাপে এই পৃথিবী থর থর করে কাঁপবে
আকাশের থেকে বাজ পড়বে তোমাদের মাথায় ওহে শাসকের দল
আমরা দেখবো, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো
যখন মহাকালের সেই দুনিয়া থেকে
নিজেদের ভগবান মনে করা মানুষগুলো উবে যাবে কপ্পুরের মত
যখন মানুষ দখল নেবে তার হৃত সাম্রাজ্য কল কারখানা জল জমিন
সব মুকুট ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে
সব সিংহাসন ভেঙে দেওয়া হবে
আমরা দেখবো, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো
নাম থাকবে কেবল তাঁর, যিনি আছেন অথবা নেই
যিনি দ্রষ্টা এবং দৃষ্টি,
আমিই সত্য এই আওয়াজ উঠবে দিকে দিগন্তরে
যে সত্য তুমি, যে সত্য আমি
ক্ষমতা দখল করবেই অমৃতের পুত্ররা
সেই আমি সেই তুমি, আমরা।
আমরা দেখবো, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়বো,
আমরা সব দেখবো।