বধাই হো বধাই হো, ১০০ করোড় কা ভ্যাক্সিনেশন হো গয়া, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, স্লোগান, আবীর, লাড্ডু। সাংবাদিক গিয়ে সেই ভক্তকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার দুটো ভ্যাক্সিন হয়ে গেছে? উত্তর, নঁহি, একেগো হুয়া হ্যায়, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, দো গজ কা দুরি হ্যায়, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, আরেক ভক্তের গলা জড়িয়ে কি নাচ, দোগজ কি দুরি হ্যায়, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।
তারই বা দোষ কী? তার নেতা ঋষিসুলভ দাড়ি রেখেছেন, বলেছেন ১০০ করোড় কা ভ্যাক্সিনেশন হো গয়া, ইয়ে বহত বড়ি উপলব্ধি হ্যায়। হমনে ১০০ করোড় ফ্রি ভ্যাক্সিনেশন দিয়া, কার বাবার সম্পত্তি? কে কাকে ফ্রি দিল কে জানে? কিন্তু মোদিজী বললেন, ১০০ কোটি ফ্রি ভ্যাক্সিনেশন দেওয়া হল, যারা ভ্যাক্সিন নিয়েছেন, তাঁরা সবাই জানেন দু’ধরনের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে, সরকারি ব্যবস্থায় মানুষকে পয়সা দিতে হয়নি, বেসরকারি ব্যবস্থায় পয়সা দিতে হয়েছে, ৭৫০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত, অবশ্যই যার পয়সা আছে, সে পয়সা দিয়ে ভ্যাক্সিন নিয়েছে, এতে সরকারের দায় নেই।
কিন্তু ১০০ করোড় মুফত ভ্যাক্সিন কথাটা মিথ্যে, নির্জলা মিথ্যে। তার একটা ভাল অংশ বিক্রি হয়েছে, চড়া দামেই বিক্রি হয়েছে। এটা তো গ্যালো প্রথম আপত্তির কথা। পরের কথায় আসি, ফ্রি মানে কী? মুফতে ভ্যাক্সিনেশন? মানে কী? ভারতীয় জনতা পার্টি এই ভ্যাক্সিনেশনের খরচ যুগিয়েছে? তাদের অনেক টাকা, চাইলে আরও অনেক পাবে, তো তারা কি ভ্যাক্সিনেশনের টাকা দিয়েছে? না দেয় নি। তাহলে কি মোদিজী নিজের পকেট থেকে এই টাকাটা দিলেন? হম তো ফকির হ্যায় জি, ঝোলা লেকে চল পড়েঙ্গে বলার পরেও, তিনি প্রতিদিন তিন চার বার জামাকাপড় বদলান, মঁ ব্লাঁর কলম রাখেন, কার্তিয়ের রোদ চশমা পরেন, তো তিনিই কি দিলেন? উত্তর, না।
আরও পড়ুন : টেনিস বলে অনুশীলন অমরিন্দরদের
তাহলে কি টাকাটা তাঁর সেই পি এম কেয়ার ফান্ড থেকে এল? যেখানে তেনার পরিচিত শিল্পপতিরা আছেন? না, সেখান থেকেও আসেনি। তাহলে? ফ্রিটা কিসের? সরকারের টাকা আসে কোথা থেকে? আমার আপনার ট্যাক্সের পয়সা দিয়ে রাজকোষ ভরে, সেখান থেকে কিছুটা নিয়ে এই ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রাম চালানো হচ্ছে, এ দেশে নয়, গোটা পৃথিবীতে, গোটা পৃথিবীর আর কোনও একজন মূর্খ নেতাও কি বলেছেন, ফ্রিতে ভ্যাক্সিনেশন দিলাম? একজনও? না, মোদিজী বলেছেন। সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বিমানে চেপে ঘোরেন, কার পয়সায়? আমাদের পয়সায়। তিনি আমাদের ফ্রিতে ভ্যাক্সিনেশন দিচ্ছেন। ওনার বন্ধুরা, ওই নীরব মোদি, মেহুল চোকসি কতটাকা নিয়ে পালিয়েছে? ১৩ হাজার কোটি টাকা। ভ্যাক্সিনের দাম কত? ২২৫ করে ১০০ কোটি ভ্যাক্সিন, হ্যাঁ ১০০ কোটি মানুষের নয়, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি, ২২৫ টাকা করে ১০০ কোটি ভ্যাক্সিনের দাম ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, নীরব মোদি আর মেহুল চোকসি, যেনাকে আমাদের প্রধান সেবক মোদিজী মেহুল ভাই বলে ডাকেন, তো সেই ভাই দাদাদের কাছ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিলেই তো ভ্যাক্সিনের খরচের অর্ধেক উঠে আসত, তারা বিদেশে জলকেলি করছে, বান্ধবী নিয়ে ঘুরছে, আর আমাদের ট্যাক্সের পয়সা খরচ করে আমাদের ভ্যাক্সিন দিয়ে মোদিজী, ফ্রি ভ্যাক্সিন, মুফত মে ভ্যাক্সিন দেওয়ার কথা বলছেন।
কিংবা প্রজেক্ট ভিস্তা, সংসদ আর প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি বানানোর খরচ? ১৫ হাজার কোটি টাকা। সেটাও আমাদের ট্যাক্সের পয়সায়, তো সেটা না বানিয়ে সেই পয়সায় ভ্যাক্সিনেশন দেওয়াই যেত, যেত না? ৮৪০০ কোটি টাকা রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীর নতুন প্লেন কিনতে খরচ হয়েছে, সেটাও আমাদের পয়সায়, সেটা দিয়ে অন্তত এক তৃতীয়াংশ টাকা পাওয়া যেত।
জওহরলাল থেকে মনমোহন সিংহ, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানেই বিদেশ গেছেন, এনার নিজের প্লেন চাই, ফকির হ্যায় তো, তাই। ঠিক এই অতিমারির সময়ে খেয়াল করে দেখুন, প্রতিদিন ডিজেল পেট্রোল, রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে, প্রতিদিন। আমাদের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা গিয়ে জমা হয়েছে সরকারের ঘরে, আমাদের হার্ড আর্নড মানির এক অংশ ইনকাম ট্যাক্স হিসেবে জমা হয়েছে, দরিদ্রতম মানুষটা যে দেশলাই কিংবা নুন কেনে, তার জি এস টির পয়সা জড়ো হয়েছে সরকারের ঘরে, সেই পয়সা দিয়ে উনি প্লেনে চড়ছেন, ময়ূর খাওয়াচ্ছেন, দেশে বিদেশে ঘুরছেন দাড়ি ট্রিম করাচ্ছেন, মঁ ব্লাঁ কিনছেন, সেই টাকাতেই আমাদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে ফ্রিটা কোথায়? কীসের ফ্রি?
আরও পড়ুন : কড়াকড়ি শুরু হলেও রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছুঁইছুঁই, শীর্ষে কলকাতা
সেই ভ্যাক্সিন নেবার পরে আপনার মোদিজী আপনার সহাস্য মুখ আঁটা সার্টিফিকেট নিয়ে ঘরে ফিরেছি, এই লজ্জা নিয়ে যে, মানুষের অসহায়তাকেও ব্যবহার করে নিজের প্রচার চালাচ্ছেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী। এবার আসুন একটু হিসেবটা দেখা যাক, বলা হচ্ছে ১০০ কোটি ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে, সাধারণ হিসেব বলে, তাহলে দেশের ১৩৪ কোটি মানুষের ৫০ কোটি মানুষ দুটো করে ভ্যাক্সিন পেয়েছেন, কিন্তু এখানেই হিসেবে জল মেশানো আছে, যত মানুষ প্রথম ডোজের ভ্যাক্সিন পেয়েছেন, তার অনেক কম মানুষ দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন, দুটো ভাক্সিন পেয়েছেন এমন মানুষ আসলে দেশের জনসংখ্যার ২৩-২৪% মানুষ দুটো ডোজ পেয়েছেন, ওদিকে সেলিব্রেশন হচ্ছে, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। সরকারি হিসেবে, সাড়ে চার লক্ষের বেশি মানুষ মারা গেছেন এই অতিমারিতে, সব্বাই জানেন এই সংখ্যা সম্ভবত আসল মৃতের সংখ্যার অর্ধেক, আমরা লাশ ভাসতে দেখেছি নদীর জলে, নদীর চরে লাশ পুঁতে ফেলা হয়েছে, এই সেলিব্রেশন কি সেই জন্য? নাকি লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক, তাদের পরিবার সন্তান নিয়ে লকডাউনের সময়ে মাইলের পর মাইল হেঁটেছে, তাদের সেই দুর্দশাকে সেলিব্রেট করা হচ্ছে? কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে, পর্যটন শিল্প এখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না, কোটি কোটি শিশু জানতেই পারল না স্কুল বলে একটা কিছু আছে, আবীর, লাড্ডু, সেলিব্রেশন মোদিজীর কাট আউট, বিরাট বিজ্ঞাপণ, একশো করোড় ভ্যাক্সিনেশন সেলিব্রেশন। এ এক অদ্ভুত সরকার, এক অদ্ভুত দল, যে কোনও ক্রাইসিস-এ চুপ করে বসে থাকবে, একটা কথাও বলবে না, তার কিছুদিন পরে ওই ক্রাইসিসটাকেই নিজেদের প্রচারের কাজে লাগাবে, লাগাতার এই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, ২০১৯ নির্বাচনের আগে জঘন্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য প্রাণ দিল অতজন জওয়ান, অন্য কোনও সরকার হলে তাদের দিকে আঙুল তোলা হত, তাদেরকে দায়ী করা হত, অপদার্থ বলা হত, মোদিজী সেই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে দেশ জুড়ে জঙ্গি জাতীয়তাবাদী শ্লোগান তুলে, ৩০৩ জন সাংসদ নিয়ে ফিরলেন।
একই ভাবে এই অতিমারি, তার সাংঘাতিক সেকেন্ড ওয়েভ, অক্সিজেন নেই, হাসপাতালে বেড নেই, মানুষের লাশ ভাসছে নদীতে, দেশের প্রধানমন্ত্রী কোথায় কেউ জানে না, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোথায় কেউ জানে না, দল আর সরকারের তরফে কোনও কথা নেই। এখন সেই তেনারাই সেলিব্রেশনে মেতেছেন, উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে প্রচার করছেন, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। এখানেই কি শেষ? না, এরপরেও লাগাতার মিথ্যে বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে ২০২১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১০০% ভ্যাক্সিনেশন হয়ে যাবে, এত তীব্র গতিতে কাজ করছে মোদিজীর সরকার, আবার মিথ্যে। যদি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই ১০০% ভ্যাক্সিনেশন করতে হয়, তাহলে এখন প্রতিদিন ১.৫ কোটি ভ্যাক্সিন দিতে হবে, গড়ে কত দেওয়া হচ্ছে? ৩৬/৩৭ লক্ষ। মোদিজীর জন্মদিনে আগের হিসেব জুড়ে, পরের হিসেব জুড়ে দেড় কোটি করা হয়েছিল বটে, কিন্তু গড়ে ৩৬/৩৭ লক্ষের বেশি ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু ডাহা মিথ্যে বলা হচ্ছে।
আসলে গোয়েবলসের শিষ্য এই আরএসএস বিজেপির সরকার এক মিথ্যের পাহাড়, এত বড় মিথ্যে যে সহজে তা ঠাহর করা যায় না, প্রতিটা বিষয়ে মিথ্যে বলেই চলেছে। কর্মসংস্থান নিয়ে মিথ্যের পর মিথ্যে, গত ৪০/৫০ বছরে কর্মসংস্থান, চাকরি বাকরির এরকম দুর্দশা দেখা যায় নি, ওনাদের দাবি সবটা বিরোধীদের মিথ্যে প্রচার, পৃথিবীর বিভিন্ন সংগঠন বলছে ভারতে গণতন্ত্র আক্রান্ত, মোদিজী বলছেন অপপ্রচার, হিসেব বলছে আমরা জিডিপির হিসেবে আমাদের পড়শি দেশের থেকে পিছিয়ে পড়ছি, মোদিজী বলছেন বিরোধীদের অপপ্রচার, বাংলাদেশের পার ক্যাপিটা ইনকাম, মাথা পিছু রোজগার এই মুহূর্তে আমাদের থেকে বেশি, মোদিজীর বক্তব্য ওসব হিসেব ভুল, বিরোধীদের অপপ্রচার। সেই মিথ্যেরই উদযাপন হচ্ছে দেশ জুড়ে, ইভেন্ট ম্যানেজার মোদিজী মুফত মে শ করোড় ভ্যাক্সিনেশনের ইভেন্ট নিয়ে হাজির। তাহলে আমরা কী করবো? আমাদের প্রত্যেকের যে আপনজন মারা গেছে এই কোভিডে, কারও বন্ধু, কারোর স্ত্রী, কারোর স্বামী, কারোর পুত্র বা কন্যা, তাদের স্মৃতিতে আসুন, একটা মোমবাতি জ্বালাই, এই মিথ্যের অন্ধকারকে ভেঙে সত্যি বেরিয়ে আসুক, গোয়েবলসিয় প্রচারের অবসান হোক।