LIC-র টাকা আদানিকে, আর BSNL-এর টাকা আম্বানিকে, উঠছে অভিযোগ। গদিতে বসে মোদি, দেশ চলছে বেশ!
কী বলব একে? ক্রাইম থ্রিলার? নাকি, নেটফ্লিক্সের কোনও সিরিজ? সত্যিটা হল এসব বললে ব্যাপারটাকে হালকা করে দেখা হবে। এ এমন এক ঘটনা, যার ফলে লাভ করবে দুএকজন আর তার দায়ভার বর্তাবে দেশের মানুষের উপর। বুঝতেই পারছেন, টাকা নয়ছয়ের কথা বলছি। এখানে টাকা মানে যে সরকারি টাকা তা নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার দরকার নেই আর দেশের মানুষ তো এখন এসবে অভ্যস্ত। মানুষ মেনেই নিয়েছে, ওসব একটু আধটু হয়েই থাকে। নেতারা রাজনীতি করবে আর একটু আধটু টাকা চুরি করবে না তা কী হয়? নেতা বলে কী শখ আহ্লাদ নেই? আ ওয়েডনেসডে সিনেমাটার কথা মনে আছে তো? যেখানে কমন ম্যান নাসিরুদ্দিন শাহ, পুলিশ কমিশনার অনুপম খেরকে বলেছিলেন, “আমাদের ঘর চালাতে হয়। তাই আমরা ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করি।” হ্যাঁ, এটাই তো কথা। সাধারণ মানুষকে, জনতাকে সরকার চালাতে হয়, ছেলেমেয়ের কথা ভাবতে হয় আর তাই তো, জনগণ সরকার নির্বাচন করে। সেই সরকার যদি তারপর একটু আধটু চুরিও করে তাই নিয়ে মানুষ আর মাথা ঘামায় না। কী করবে? সংসারের দায় আছে না?
কিন্তু এরকম অভিযোগ যদি হয় যে, টাকার অঙ্কটা ৩০ হাজার কোটি, তাহলে তো একটা ধাক্কা লাগেই তাই না? ওয়াশিংটন পোস্টের এক রিপোর্ট বলছে, মোদি সরকার গোপনে ৩.৯ বিলিয়ন ডলারের একটি পরিকল্পনা তৈরী করেছিল, ধারদেনায় ডুবে যাওয়া আদানি গ্রুপকে বাঁচানোর জন্য। সেই ডুবতে থাকা জাহাজকে পয়সা জোগালো কারা? রাষ্ট্রায়ত্ব লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া বা এলআইসি।
অভিযোগ এরকমই, ২০২৫-এর মে মাসে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক, ডিপার্টমেন্ট অফ ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস, এলআইসি এবং নীতি আয়োগ যৌথভাবে একটি বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরী করে, যার মাধ্যমে আদানি গ্রুপের বন্ড ও ইক্যুয়িটিতে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়। ঐসময় পুরোনো ধার শোধ করতে আদানির দরকার ছিল প্রায় ৫৮৫ মিলিয়ন ডলার। এলআইসি এর পুরোটা একাই ফাইনান্স করে। ওয়াশিংটন পোস্ট একে সরকারি অর্থের অপব্যবহার বলে দাবি করলেও সরকারি নথিতে কী বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে, এই পরিকল্পনার লক্ষ্য, আদানির উপর আস্থা প্রদর্শন এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা। মজাটা দেখুন, ঐসময়ে আদানির ধারদেনা কিন্তু আরও ২০ পার্সেন্ট বেড়ে গিয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মামলা চলছিল। আর এখনও চলছে। তাহলে, জালিয়াতির মামলায় অভিযুক্ত একজনকে দেখিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চাইছে যে সরকার, তাকে কী বলার আছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের SEC ও ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস আদানি ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বহু বিলিয়ন ডলারের ঘুষ ও জালিয়াতির অভিযোগ এনেছে। যেখানে তারা দাবি করেছে, এসব কাজে প্রায় আড়াইশো বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ভারত সরকার এখনও পর্যন্ত মার্কিন কর্তৃপক্ষের আদানিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করার অনুরোধে সাড়া দেয়নি। এর সঙ্গে রয়েছে ২০২৩ সালের হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট। যেখানে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শেয়ার কেলেঙ্কারি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এরকমটাই চলছে অভিযোগের পর অভিযোগ তারপর আবার অভিযোগ। মোদি সরকার ফিরেও দেখে না। বিরোধীরা জানতে চায় মোদি সরকার কাদের সরকার? দেশের মানুষের না আদানি আম্বানির? জানতে চাইবে নাই বা কেন? আদানির গল্পটা তো বললামই, এবার আম্বানির গল্পটা বলা যাক। ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বা CAG তাদের রিপোর্টে অভিযোগ করেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিএসএনএল তাদের টাওয়ারের মত টেলিকম ইনফার্স্টাকচর ব্যবহারের জন্য রিলায়েন্স জিওকে ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ অবধি এই দশ বছরে কোনও বিল পাঠায়নি। যার ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১,৭৫৭.৭৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে বকেয়া সুদ তো রয়েইছে।
বিএসএনএল যদিও বলছে এই ক্ষতির পরিমাণ ভুলভাবে বেশি করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু CAG-র অভিযোগটাতো থেকেই যাচ্ছে, তাই না? মাঝখানে অন্য একটা গন্ডগোল ঢুকে পড়ায় এর সঙ্গে আরো একটা প্রশ্ন উঠেছে। ঘটনাটা কোলকাতার। হাইকোর্টে বিএসএনএলের বিল বাকি থাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যহত হয়েছে। এই ঘটনা ঘিরে কোর্ট অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। এখন প্রশ্ন এই, যে সংস্থা বিল জমা না পড়লে হাইকোর্টের ইন্টারনেট লাইন কেটে দিতে পারে, সেই তাদেরই বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা ১০ বছর আম্বানিকে কোনও বিলই পাঠায়নি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এশিয়ান সামিটে গরহাজির, ট্রাম্পের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছেন মোদি?
ভাবুন এবার। এই তো কিছুদিন আগেই তৃণমূল নেতা সুজিত বসুর বাড়িতে তদন্ত চালালো ইডি। তেরোটি জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার দল ৪৫ লক্ষ টাকা। অর্থাত গড়ে একেকটা জায়গা থেকে পাওয়া গেছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। এর জন্য ইডির মাথাব্যাথার শেষ নেই। কিন্তু আদানি আম্বানির দল যখন হাজার হাজার কোটি কোটি লুঠে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে, তখনও কী একটা তদন্ত করানোর হিম্মত নেই সরকারের? না, কোনও তদন্ত হবে না উল্টে বলা হবে, সব ঠিকই আছে, রিপোর্টের বদলে পাল্টা রিপোর্ট পেশ হবে। রিপোর্ট পে রিপোর্ট, রিপোর্ট পে রিপোর্ট ব্যাস খেলা শেষ। মানুষ ভুলেও যাবে, তার ফাঁকেই ভোট এসে যাবে আবার।
বিরোধী নেতারা কিন্তু এসবের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র অভিযোগ করেছেন, সরকার করদাতাদের তিরিশ হাজার কোটি টাকা আদানির ব্যাক্তিগত বন্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, এলআইসি একদিনে ৭৮৫০ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। তিনি একে মোদি+আদানি= মোদানি মেগা স্ক্যাম বলে উল্লেখ করেছেন। LIC এই অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন মিথ্যে বলে দাবি করেছে, আদানিরা বলেছে মোদির আগে থেকেই তারা ব্যাবসা করছে। বিএসএনএল বলছে তাদের নামে বেশি বেশি করে বলা হচ্ছে। কিন্তু কোটি কোটি টাকার গরমিল নিয়ে এই অভিযোগ, তার কী হবে? গদিতে বসে মোদি, দেশ চলছে বেশ।