বিজেপি এমনিতেই জ্যাঠামশাইয়ের রোলে বহুদিন ধরেই অভিনয় করে, নাগপুরের জ্যাঠামশাইরা জানিয়ে দেন, এটা খাওয়া যাবে, ওটা খাওয়া যাবে না, এখানে খাওয়া যেতে পারে, ওখানে খেলে পিটিয়ে মেরে ফেলবো, ফ্রিজে এই মাংস রাখলে জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারবো, এই পোশাক পরা যাবে, ওটা পরলে রাস্তায় হেনস্থা করবো। সরস্বতী পুজোতে হাত ধরে ঘোরা যাবে, ভ্যালেন্টাইন ডেতে ঘুরলে পিঠে লাঠির ঘা, শোয়েব আখতার ভাল বল করে বললে, বা পাকিস্থান দারুণ খেলে জিতেছে বললে চলবে না, বলতে হবে জোচ্চুরি করে জিতেছে, নইলে দেশদ্রোহী বলে জেলে পচিয়ে মারবো, মহিলাদের সংস্কারি হতে হবে, এখন এই সংস্কারি কথাটা বাঙালি মহিলারা আবার জানেনই না, সংস্কারি মানে হল বিয়ের পর শ্বশুরের পা টেপা, দেড় হাত ঘোমটা টেনে রাখা, ভাসুরের নাম না ধরে ভাববাচ্যে কথা বলা, পুরনো হিন্দি সিনেমা দেখে নেবেন, তখন নিরূপা রায় বৌ এর রোলে থাকতেন, তারপর থেকে তো সে সব গেছে, আহা রে।
এখন বৌমা শর্টস পরে সিঁড়ি দিয়ে নামছে, নাগপুরের ভক্ত চেটেপুটে দেখে বেরিয়ে বলল, এই ছবি আমাদের রীতি, নীতি ঐতিহ্যের বিরোধী। এ সব জ্যাঠামি একটা সময়ে আমরা বাংলা ছবিতে দেখেছি, কমল মিত্রকে দেখেছি, গাউন পরে ব্যারিটোন ভয়েজে, ছেলে, ভাইপোকে কী করিতে হইবে, তা বলতেন, বিজেপি সেই রোলে বহুদিন।
আবার তাদের দেখলাম বাংলার বিধানসভায়, মদের দাম কেন কমানো হইল? শুভেন্দু অধিকারীর, মানে আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর কি রাগ! মদ খেলে চরিত্র ঠিক থাকে না, চিত্ত বৈকল্য দেখা যায়, মনের মধ্যে তামসিক গুণগুলো কিলবিল করে উঠতে থাকে, অতএব বাংলার সরকার জবাব দাও, মদের দাম কমানো হল কেন? বাংলার যুবকদের চরিত্রের অধঃপতনের জন্য দায়ী এই রাজ্য সরকার নিপাত যাক, স্লোগান দিলেন বিজেপি বিধায়করা। এসব থেকে দুটো জিনিস বেরিয়ে এল, এক মদ খেলে চিত্ত বৈকল্য হয়, চরিত্র খারাপ হয়, মনের তামসিক গুণগুলো বেরিয়ে আসে, সেই মানুষ তখন অন্যায় কাজ করতে পারে, মানুষ খুন করতে পারে ইত্যাদি।
দুই বাংলার সরকার এভাবে দাম কমিয়ে রাজ্যের যুবকদের বিপথগামী করে তুলেছে, এই কথাই আমাদের কাঁথির খোকাবাবু বললেন বিধানসভায়, বিজেপি বিধায়করাও বললেন। এসব বলতে গিয়ে কাঁথির খোকাবাবু বললেন, বিজেপির রাজ্যে, যোগিজীর রাজ্যে ১৩৫ টাকাতে ভোজ্য তেল পাওয়া যাচ্ছে, বিহারে ১৬৫ টাকায় ভোজ্য তেল পাওয়া যাচ্ছে, এ রাজ্যে ভোজ্য তেল বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, কেন? কেন? কেন? মেগা সিরিয়াল। তো আমরা ভাবলাম সত্যিই তো, এরকমটা হবে কেন? লখনউয়ের মানুষ জন ধারা তেল কিনবে ১৩৫এ, সানফ্লাওয়ার অয়েল কিনবে ১৩৫ টাকায়, কেন জানিনা বিহারের মানুষজন সেই তেল কিনবেন ৩০ টাকা বেশি দিয়ে, আর বাংলার মানুষ, পদ্মার ইলিশ যখন আবার ঢুকছে তখন সেই তেল কিনবে ৬৫ টাকা বেশি দিয়ে, ২০০ টাকা খরচ করে? তো খোঁজ লাগালাম। কী পেলাম দেখুন।
আমাদের রাজ্যে শহর কলকাতায়, সাউথ সিটি স্পেন্সরসে ধারা পিওর সানফ্লাওয়ার ওয়েলের ৫ লিটার জারের দাম ৮৫০ টাকা, মানে লিটার প্রতি ১৭৫ টাকা, পাড়ার মোড়ের দোকানে এর চেয়ে দু-চার টাকা কম হতে পারে, এবং লখনউতে ওয়ান অবধ মলে সানড্রপ হার্টের ৩ লিটারের জার ৫৯৯ টাকা, মানে লিটার প্রতি ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, এটাও ঠিক যে ওখানেও পাড়ার মোড়ের দোকানে, এই একই তেল দু-চার টাকা কমেই পাওয়া যাবে, কিন্তু সে তো অন্য গল্প। তাহলে বিধান সভায় বসে কাঁথির খোকাবাবু, ক্যামেরার সামনে বসে মিথ্যে বললেন?
শুভেন্দুবাবুর মিথ্যে বলা তো এই প্রথম নয়, উনি তো তৃণমূল দলে বসেই বিজেপি করতেন, সে অনৈতিক কাজের কথা তো উনি নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন, আজকে একটা বোতাম টিপে প্রতিটা শহরের যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়, একথা অতিমুর্খও জানে, শুভেন্দু অধিকারি জানেন না।
সেই শুভেন্দু বাবুর দাবি, তাঁর দলের বিধায়কদের দাবি, মদ খেলে চরিত্র নষ্ট হয়, বাংলার যুবকদের বিপথগামী করে তোলা হচ্ছে। কি আশ্চর্য, ওদিকে এনারাই নাকি হিন্দু ঐতিহ্যের কথা বলেন, যে ঐতিহ্য বনবাসী ঋষি মুনিদের এনে যাগ যজ্ঞের কথা বলে, যে যজ্ঞ আবার সোমরস ছাড়া, মানে অত্যন্ত উচ্চমানের মদ ছাড়া হতই না, হিন্দু পুরাণ কাহিনীতে লেখা আছে যে সোমরস পান করতেন দেবতারা কেবল নয়, দেবীরাও। স্বর্গের অপ্সরারাও, সোমরস খেয়ে নৃত্য করতেন, ইন্দ্রদেব নিজেও সোমরস খেতে খেতেই তা উপভোগ করতেন, বলরাম ভাং খেতেন, কিন্তু কৃষ্ণ? তিনি মদিরা কেবল খেতেন না, অর্জুন সখাকে নিয়ে বসে খেতেন, দ্রৌপদী পরিবেশন করতেন।
পুরানের সে সব লেখায়, মদিরা বানানোর জটিল কিন্তু বিশদ প্রক্রিয়াও লেখা রয়েছে, সেসব পড়াশুনো করা তো কাঁথির খোকাবাবুদের বারণ, ওনাদের স্লোগান, যে যত পড়ে, সে তত জানে আর তত কম মানে। পড়াশুনো করলে তো ভক্ত হওয়া যায় না, সভ্য যে কোনও দেশে মাত্রা বজায় রেখে মদ্যপানের প্রচলন আছে, আর মদটা যে খুব খারাপ কিছু নয়, তা তো কৈলাশ বিজয়বর্গীয়র কাছ থেকে জেনে নিলেই হয়, কিন্তু ওই যে মুর্খদের জানতে বড় ভয়, তারা কুঁয়োর ব্যাং হয়ে থাকতে ভালবাসে।
এবারে আসুন অন্য বিষয়টাতে, বিজেপি বিধায়ক আর কাঁথির খোকাবাবুদের দাবি, বাংলার সরকার মদের দাম কমিয়ে বাংলার যুবসমাজকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে, আচ্ছা অন্য রাজ্যতো ছেড়েই দিলাম, উত্তরপ্রদেশ কী করছে? সে তো এখন হিন্দুত্ববাদের ফ্যাক্টরি, ওখান থেকেই তো অগামার্কা হিন্দু বের হওয়ার কথা, যেখানে আদিত্যনাথ যোগী, নিজেকে নিজেই শিবের বংশধর বলেন, যেখানে তাঁর স্লোগান, বচ্চা বচ্চা রাম কা। তো সেখানে মদের দাম কত? কবে বাড়ল? কবে কমল? ঠিক যেদিন আমাদের কাঁথির খোকাবাবুরা বিধানসভায় নৌটঙ্কি করতে নামলেন, তার আগের দিন, ১৬ নভেম্বর, আদিত্যনাথ যোগীর ক্যাবিনেট বৈঠকে, তাঁর উপস্থিতিতেই নয়া এক্সাইজ নীতির ঘোষণা করে, সেখানে বিভিন্ন ব্রান্ডের ভারতে তৈরি বিদেশী মদ ও বিয়ারের দাম, উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়, বলা হয় এর ফলে রাজ্যের রাজস্ব এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়বে, কত? ৬০০০ কোটি টাকা থেকে ৩৪৫০০ কোটি টাকা হবে, মানে ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত কামাই, হ্যাঁ উত্তরপ্রদেশ সরকারের কোষাগারে এই পরিমাণ টাকা যাবে বলে, আদিত্যনাথ যোগিজী আশা করছে। এই নয়া এক্সাইজ নীতিতে, নতুন মদের নতুন প্রাইস লিস্ট ঘোষণা করা হয়েছে, একই ঘোষণা আমাদের রাজ্যেও করা হয়েছে, যার বিরোধিতা করছেন খোকাবাবু। আসুন একটু কম্পেয়ার করে দেখা যাক, কাঁথির খোকাবাবু অ্যান্ড কোম্পানি এসব দাম জানেন না, তা তো নয়, বিলক্ষণ জানেন। আপনাদেরই জানাই, অন্তত বুঝতে তো পারবেন, এরা কত বড় হিপোক্রাট।
হুইস্কি দিয়ে শুরু করি, স্বয়ং কবিগুরুর গান আছে, খাও হুইস্কি সোডা আর মুর্গি মটন, লোকজন নাকি খুব পছন্দ করে ব্লেন্ডারস প্রাইড। আমাদের রাজ্যে, সেই মদের ৭৫০ মিলি লিটারের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৯২০ টাকাতে, যোগিজীর রাজ্যে? ৭৭০ টাকা। ১৫০ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ঐ ব্রান্ডের রিজার্ভ কলেকশন হুইস্কি, আমাদের রাজ্যের দাম ১১১০ টাকা, যোগীজির রাজ্যে ৯১৫ টাকা। মানে ১৯৫ টাকা কমে। হান্ড্রেড পাইপারস টুয়েলভ ইয়ার, আমাদের রাজ্যে ৭৫০ মিলি লিটারের দাম ২৩৪০ টাকা, যোগিজী বিক্রি করছেন ২০৮৫ টাকায়, ২৫৫ টাকা কম দামে। আসুন একটু ভোদকার দিকে চোখ রাখা যাক, ম্যাজিক মোমেন্টস প্রিমিয়াম ভোদকা আমদের রাজ্যে দাম ৭৭০ টাকা ৭৫০ মিলি লিটারের, যোগিজী বিক্রি করছেন ৬১৫ টাকায়, মানে ১৫৫ টাকা কম দামে। দেখেশুনে আমাদের রাজ্যের রসেবসে থাকা মানুষজন ইউপিতেই গিয়ে থাকতে চাইবে, এতটাই দাম কমিয়েছেন হিন্দু হৃদয় সম্রাট, আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর আপাতত আইডল আদিত্যনাথ যোগী, কিন্তু তাঁরা বিধানসভাতে গলার শির তুলে চিৎকার করছেন, জবাব চাইছেন, সরকার কেন মদের দাম কমালো?
আসলে সেই প্যান্ডেমিকের সময়ে যখন আবার মদ বিক্রি শুরু হল, তখনই আমাদের রাজ্যের মদের দাম ৩০% বাড়ানো হয়েছিল, অবস্থা স্বাভাবিক হচ্ছে, রাজস্ব বাড়াতে হবে, বিভিন্ন প্রকল্পের খরচ মেটাতে এছাড়া আর অন্য কোনও গতিও নেই, অগত্যা সেই ৩০ শতাংশ দাম যা বাড়ানো হয়েছিল, তা কমানো হয়েছে, যখন বাড়ানো হয়েছিল, তখন শুভেন্দু ইত্যাদিরা দলবদলে ব্যস্ত ছিলেন, তখন গোপনে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। তারপর ঘটি হারিয়েছে, এখন চিৎকার করছেন। যদি একটু নেট ঘাঁটেন তাহলে দেখবেন, এখনও আমাদের রাজ্যে মদের দাম অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি, মিথ্যে কথা বলা অভ্যেস হয়ে গেছে খোকাবাবুর, আর সেসব মিথ্যে ধরাও পড়ে যাচ্ছে। আমার এক বন্ধু বলেছিল, মাতালরা মিথ্যে বলে না, আসলে তাদের মিথ্যে বলার মত ক্ষমতাও থাকে না, তাই বলি কি, যোগিজীর রাজ্যে তো মদের দাম অনেকটাই কম, সেখানেই যান, খান, কিছু দিন অন্তত মিথ্যে কথা বলা তো বন্ধ হবে।