কোনও কিন্তু, যদি, আসলে, ইত্যাদি দিয়ে বাক্য শুরু না করে, রামপুরহাটে বগটুই এর হত্যাকান্ডকে নারকীয়, জঘন্য, অমার্জনীয় অপরাধ বলাটাই প্রথম কাজ, অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করা হোক, বিচার হোক, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, এটা প্রথমেই বলা দরকার। এটাও বলা দরকার যে কোনও শর্ট সার্কিট নয়, কোনও দুর্ঘটনাও নয়, এটা এক পরিকল্পিত খুন, জঘন্য অপরাধ। এর পেছনে ষড়যন্ত্রও আছে, একাধিক মানুষ জড়িত, তাদের খুঁজে বার করার দাবীও জানাচ্ছি।
এবার আসুন কী ঘটেছিল দেখা যাক, সোমবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ, তৃণমূল অঞ্চল উপপ্রধান ভাদু শেখকে কিছু দুস্কৃতি বোমা মেরে খুন করে, তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। রাত সাড়ে নটা নাগাদ থেকে বগটুই গ্রামে বেশকিছু ঘরে আগুন দেওয়া হয়, বোম পড়তে থাকে মূহুর্মুহ, রামপুরহাট মেডিক্যালে ভোরবেলায় ৪ জন আগুনে পোড়া মানুষকে ভর্তি করা হয়, ঐ ভোরেই সাড়ে তিনটে নাগাদ ঐ গ্রামেরই সোনা শেখের বাড়ি থেকে, ৭ টা পোড়া মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মংগলবারেই থানার ওসিকে ক্লোজ করা হয়, এস ডি পি ও কে সরিয়ে দেওয়া হয়, গ্রেপ্তারি চলতে থাকে, বুধবারে আদালতে মোট ২০ জন সন্দেহভাজন অপরাধীকে পেশ করা হয়, অধিকাংশ অপরাধীকেই পুলিশ হেপাজতে নেওয়া হয়, মংগলবারেই এলাকায় হাজির হন মন্ত্রী ফিরাদ হাকিম, বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডল, লাভপুরের বিধায়ক রানা সিংহ।
সি পি আই এম এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, নেতা বিমান বসু, আর এস পি নেতা মনোজ ভট্টাচার্য ঘটনাস্থলে হাজির হন। গিয়ে পৌঁছেছিলেন বিজেপির এক বিরাট প্রতিনিধিদল, ছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, শুভেন্দু অধিকারি। আজ ঐ বগটুই এ গেলেন, বিজেপির এক প্রতিনিধিদল। বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, লোকসভা সাংসদ সত্যপাল সিং, রাজ্যসভার সাংসদ ব্রজলাল, কে সি ভারতী, দলের জাতীয় মুখপাত্র ভারতী ঘোষ। মাথায় রাখুন, ঐ সুকান্ত মজুমদার ছাড়া বাকি চারজনই প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ছিলেন। এবং আজই বগটুই এ হাজির থাকলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেবল এ রাজ্যে নয়, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে এ ধরণের গণহত্যা, খুন, পরিকল্পিত হত্যা, অপরাধের ঘটনা ঘটেছে আগেও, পশ্চিমবঙ্গতো সেই তালিকায় একটু এগিয়েই আছে বলাই যায়। মুর্শিদাবাদে মালোপাড়ার গণহত্যা, ২০০০ এ এই বীরভূমের সূচপুরের গণহত্যায় মারা গিয়েছিলেন ১১ জন, ছোট আঙারিয়ায় ২০০১ এ ৫ জনকে ঘরে আটকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, নন্দীগ্রামের ঘটনা সবাই জানেন, নেতাই এ ২০১১,৭ জানুয়ারিতে গুলি করে মারা হয় ৯ জনকে, এরকম আরও অসংখ্য আছে।
কেন ঘটে এমন ঘটনা? এই বাংলাতেই এমন ঘটনা বেশি ঘটে কেন? আলোচনা করবো, কিন্তু তার আগে এই বাংলায় ঘটে যাওয়া আগের ঘটনাগুলোর থেকে গত সোমবারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবেই আলাদা, কোথায় আলাদা সেটা বলাটা দরকার। সূচপুর, ছোট আঙারিয়া, নন্দীগ্রাম, নেতাই এর ঘটনাও ছিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই, তাহলে আলাদাটা কোথায়?
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: দ্য কাশ্মীর ফাইলস (পর্ব-১)
প্রথম ফারাকটা হল ঘটনার পরেই স্থানীয় থানার ওসিকে ক্লোজ করা, এস ডি পি ওকে সরিয়ে দেওয়া, ঘটনার পরের দিন মন্ত্রীসভার অন্যতম মন্ত্রীর ঘটনাস্থলে হাজির থাকা, প্রত্যেক বিরোধী দলের নেতাদের অবাধে ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া, এবং ঘটনার তিন দিনের মাথায় স্বয়ং মূখ্যমন্ত্রীর ঘটনাস্থলে হাজির হওয়া, এর প্রত্যেকটাই নজীরবিহীন, এর আগে বিরোধী দলের নেতাদের যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে, পুলিশ কন্সটেবলকেও সরানো হয় নি, ওসি এস ডিপিও তো দুরের কথা, এবং মূখ্যমন্ত্রী? না তিনি সূচপুর, ছোট আঙারিয়া, নন্দীগ্রাম বা নেতাই কোনও ঘটনাস্থলেই যাবার হিম্মত দেখান নি, যাবার প্রয়োজনই মনে করেন নি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক অডিও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নন্দীগ্রামের ঘটনার পরে দিল্লিতে বঙ্গভবনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, নন্দীগ্রামে যান, হাত জোড় করে ক্ষমা চান, মানুষ নিশ্চই ক্ষমা করে দেবে, কিন্তু উনি শুনলেন না।
হ্যাঁ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজে যান নি, যাবার কথা ভাবেন নি, এমনকি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মত মানুষের অনুরোধেও কান দেন নি, আর ঠিক এইখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আলাদা, তিনি হাজির হলেন, পরিবারের মানুষজনের সঙ্গে কথা বললেন, এলাকার পুলিশ প্রশাসনকে বলে এলেন, একজনকেও ছাড় নয়, দল দেখবেন না, গ্রেপ্তার করুন। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য?
কি ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভূমিকা? ২০১১ র নেতাই ঘটনায় দলের লোকজনদের ভূমিকার কথা জানতেন, ভালভাবেই জানতেন, স্বীকার করলেন কবে? ২০১৪, ২ ফেব্রুয়ারি মেদিনীপুরের এক জনসভায় বুদ্ধবাবু বললেন, নেতাই আমাদের ভুল ছিল। সেদিন যে দীপক সরকার, সুশান্ত ঘোষের দিকে ইশারা করেছিলেন, সেই সুশান্ত ঘোষ এখন পশ্চিম মেদিনীপুরের দলের জেলা সম্পাদক, হ্যাঁ এইখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আলাদা, এইখানেই রামপুরহাটের বগটুই এর ঘটনা সূচপুর, ছোট আঙারিয়া, নন্দীগ্রাম বা নেতাই এর থেকে আলাদা।
এবারে আসুন, আরও গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় বিষয়টার দিকে নজর দেওয়া যাক, এই বাংলাতেই কেন এত রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটে, কেন এত রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা ঘটে? কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যুক্ত থাকেন সরাসরি, এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে? আসলে বাংলার রাজনীতি এক দীর্ঘ সময় ধরে অত্যন্ত সংগঠিত ক্যাডার বাহিনীর হাতে গেছে, এক দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই এর জন্য দায়ী, কেবল নির্বাচন নয়, বছরের ৩৬৫ দিন রাজনৈতিক মেরুকরণের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কেউ সিপিএম, কেউ তৃণমূল, কেউ কংগ্রেসী, কেউ বিজেপি হয়ে উঠেছে, এবং সেই হয়ে ওঠাও কেবল ব্যক্তির মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা পরিবার এবং কোনও কোনও জায়গায় অঞ্চল বা গ্রামের আকার নিয়েছে, যার ফলে ঐ ঘোষেরা তো সিপিএম, ঐ বোসেরা তো তৃণমূল, ঐ দাসেরা তো বিজেপি, ঐ গ্রাম তো কংগ্রেসী, ঐ পাড়া তো সিপিএম ইত্যাদির আকার নিয়েছে।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: দ্য কাশ্মীর ফাইলস (পর্ব-২)
এমনটা আমাদের দেশে এক কেরালা বাদ দিলে অন্য কোথাও নেই, সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডার বেসড সংগঠন আর তার বিপরীতে রাজনীতি করতে আসা, অন্যান্য দলেরও একই চরিত্র তৈরি হয়েছে, দীর্ঘ এক প্রক্রিয়ার মধ্যেই তা হয়েছে। এবং মজার কথা হল, তা কিন্তু কোনও দর্শনের ভিত্তিতেও হয় নি, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতেই হয়েছে, আমি এই দলের সমর্থক, সে দল যাই করুক না কেন, বা অন্য দল যদি ভালো কিছুও করে, তাহলেও আমি এই দলের সমর্থক হিসেবেই ঐ দলের বিরোধিতা করবো, এটাই মোদ্দা কথা, এখানে গান্ধীবাদও নেই, হিন্দু রাষ্ট্রবাদও নেই, মার্কসবাদও নেই। তাহলে এই দলীয় আনুগত্যটা কিসের?
বাংলার রাজনীতি সেই কবে থেকেই এক্কেবারে নিচু স্তরেও রুজি রোজগারের সংগে জুড়ে গেছে, জোড়া হয়েছে, তুমি আমার দলের হলে ১০০ দিনের কাজ পাবে, পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধে পাবে, মিউনিসিপালিটির সুযোগ সুবিধে পাবে, দলের না হলে পাবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত, মিউনিসিপালিটি তৈরি হল, তা মানুষের হাতে যাবার বদলে ৭৮/৭৯/৮০ থেকেই দলের হাতে যাওয়া শুরু করে, ৯৬/৯৭/৯৮ নাগাদ সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় সর্বত্রই, প্রান্তিক মানুষের রুজি রুটির সঙ্গে জুড়ে যায় রাজনৈতিক আনুগত্য, দলীয় আনুগত্য।
তারমানে যারা ক্ষমতায় তারা এই মধুভান্ডের ভাগ বাটোয়ারা করতে থাকে, যারা বিরোধী তারা এই ভাগ বাটোয়ারার মালিকানার জন্য লড়তে থাকে, এ লড়াই রাজ্যের উন্নয়ন, দেশের উন্নয়ন, জিডিপি, অর্থনীতি, মার্ক্সবাদ, গান্ধিবাদ বা হিন্দুরাষ্ট্রবাদের তোয়াক্কাও করে না, এখানে একটা অটোর পারমিট, বাজারে একটা দোকানের জায়গা, বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধে, আর স্থানীয় রোজগারের কেন্দ্রে দখলদারির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, আজ নয় বহুদিন ধরেই, তাই গ্রামের মাটির বাড়ির পাশেই ডালিম পান্ডের দোতলা বাড়ি হয়, নন্দীগ্রামে পেল্লাই প্রাসাদ হয় শেখ সুফিয়ানের, একইভাবে বগটুই এ ভাদু শেখের। এ কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে পড়েনি? নিশ্চই পড়েছে, বিভিন্ন সময়ে তিনি দলীয় সমর্থক, এমন কি সাংবাদিকদের সামনেও বলেছেন, আমি জানি কারা কারা কী ভাবে রোজগার করছে, বলেছেন, কত টাকা দরকার? টাকা কি চিবিয়ে খাবে? ইত্যাদি।
এই বিশাল মধুভান্ড একদিনে বা খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে ফেলা অসম্ভব, সম্ভবত সেই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকল্পগুলোকে জেলা বা স্থানীয় প্রশাসনের হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন, সরাসরি ডিএম, বিডিওদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে জিজ্ঞেস করছেন কতজন টাকা পেল? কতজন পেল না? কতজন কোন কোন সুবিধে পেল? সঙ্গে বসাচ্ছেন জন প্রতিনিধিদের যাতে দলীয় আনুগত্যের সঙ্গে রুজিরুটির শেকড়টা ছেঁড়া যায়, কিছুটা সফল, কিন্তু অনেকটা বাকিও আছে, কারণ সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। কিন্তু এটা তো বলাই যায় যে দলীয় আনুগত্যের সঙ্গে, রুজি রুটি জুড়ে থাকলে এধরণের ঘটনা ঘটবে, অন্তত চট করে বন্ধ হবে না।
কিন্তু ঘটনা ঘটে গেলে? আমরা তো চাইবই রাজধর্ম পালন হোক, পুলিশ কে স্বাধীনতা দেওয়া হোক, অপরাধীদের খুঁজে বের করা হোক, প্রশাসন, প্রশাসনের মাথায় বসে থাকা মুখ্যমন্ত্রীর মানবিক হাত থাকুক অত্যাচারিতদের মাথায়, রামপুরহাটের বগটুই এর ঘটনা এই দিক থেকেই আলাদা, অন্তত আগের গণহত্যাগুলোর সঙ্গে এক তালিকায় রাখা যাবে না।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : দ্য কাশ্মীর ফাইলস – ৩
এবার শেষ কথায় আসি, বগটুই এ মারা গেলেন ৮ জন না ৯ জন? দোষিদের কতজন ধরা পড়ল? কতজন পড়েনি? এ সব প্রশ্নের মাঝেই বাস্তবটা হল, ৭০/৮০ ডিগ্রি বার্ন নিয়ে এখনও কয়েকজন মানুষ হাসপাতালে, বাবা তার ছেলেকে হারিয়েছে, স্বামী হারিয়েছে তার স্ত্রীকে, পুত্রকে, তাদের চোখের জল শুকোয় নি, কান্না আর চোখের জলে ভারি হয়ে আছে বগতুই গ্রাম, পাশের ধানক্ষেতে সবুজ ধানে টান ধরছে, শ্যালো চালানোর লোক নেই, বাড়ি পুড়েছে, মানুষ নিরাশ্রয়, কান্না আছে, রাগ আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃত প্রিয়জনদের জিনিষপত্র, ছাই উড়ছে এদিক সেদিক, মানুষের মাংস পোড়ার গন্ধ ভাসছে বাতাসে, সেটাই সরেজমিনে দেখতে গেলেন বিজেপির প্রতিনিধীরা, কলকাতা থেকে রামপুরহাট, হুটার বাজিয়ে ঘন্টা চার কি সাড়ে চার এর রাস্তা, তারই মধ্যে শক্তিগড়ে দাঁড়ালেন তাঁরা, প্রসিদ্ধ ল্যাংচা খেতে, খেলেনও। রইল তার ছবি।
মানুষ হলে নিশ্চই গন্ধ পেতেন, পোড়া মাংসের গন্ধ, পেয়েছেন কি?