আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা
ছায়ার সাথে কুস্তি ক’রে গাত্র হ’ল ব্যথা !
ছায়া ধরার ব্যবসা করি, তাও জানোনা বুঝি,
রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি !
সেই কবে সুকুমার রায়, বিজেপির ছক, বিজেপির প্ল্যানের কথা লিখে গেছেন, বিস্তারিত বর্ণনা। এক কল্পিত ছায়া যুদ্ধতে মশগুল করে রাখো দেশের জনগণকে, যে যার মত হাতিয়ার বের করুক, যুদ্ধ চলুক দেশ জুড়ে, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধে সত্ত্যি সত্যিই মারা যাবে কিছু মানুষ, কিছু লাশ পড়বে, তা পড়ুক, কিন্তু সেই মানুষেরা ভুলে যাবে সত্যিকারের লড়াই, চিনেই উঠতে পারবে না তাদের শত্রুদের, যারা তাদের অভুক্ত রাখছে, যারা তাদের সন্তান, আত্মজদের নিখাদ বেকার করে রাখছে, যারা তাদের স্বাস্থ, শিক্ষা, বাসস্থান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, এক নরক গুলজার তৈরি করেছে যারা, যে নরকে কেবল মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাচ্ছে, ওম স্বাহা। দেশের ঐতিহ্য সেই যজ্ঞের আগুনে পুড়ছে, দেশের সম্প্রিতী, ভাইচারা সেই একই আগুনে পুড়ে ছাই। পুড়ুক, দেশ চুলোর দোরে যাক, এক কল্পিত শত্রুকে চিহ্নিত করে ছায়ার সঙ্গে লড়াই নিয়ে ব্যস্ত থাকুক দেশের মানুষ, এটাই আর এস এস – বিজেপি চায়, এটাই তাদের পরিকল্পনা, এটাই তাদের পুঁজি। আজ সেই ছায়ার সঙ্গে লড়াই এর গল্প শোনাবো আপনাদের।
প্রথম গল্পের শুরুয়াত ভুজিয়াওলার দোকানে, হলদিরাম ভুজিয়াওলা, ইদানিং বড় নাম, বিরাট ব্যবসা, যে ফুচকা এখনও ১০ টাকায় ৭ টা কি ৬ টা পাওয়া যায়, সেটাই ওখানে চারটের দাম ৪০ টাকা, ফাউ বলতে এক চামচ দই আর এক চামচ ভুজিয়া। ঐ হলদিরামেই ১০ গ্রাম মশলা মাখানো ছোলার দাম ৫ টাকা, বাজারে ছোলার কেজি ৭০-৮০ টাকা, রমরমে ব্যবসা, দেশের সর্বত্র এদের আউটলেট আছে, এখন বিদেশেও তাদের চানা, ভুজিয়া, চিপস রপ্তানি হচ্ছে, ব্যবসার শুরুয়াত অবশ্য কলকাতা থেকেই। অন্যতম মালিক প্রভু শংকর আগরওয়াল হত্যা এবং হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন, সেখানেও ভুজিয়া তৈরি করা শিখিয়েছেন, আপাতত জামিনে মুক্ত।
তো সেই হলদি রাম ভুজিয়াওলার এক আউটলেটে গল্পের শুরুয়াত। সুদর্শন নামে এক নিউজ চ্যানেল আছে, ডিজিটাল চ্যানেল, কোনও রাখঢাক নেই, এনারা ১০০% বিজেপি, আর এস এস – বিজেপির হয়ে কাজ করেন, সেই কাজ করতে গিয়ে কোনও লুকোছাপা করেন না, এনারা প্রায় ১০ দিন ধরে ক্যাম্পেন চালিয়েছিলেন যে মমতা মুসলমানদের খুশি করার জন্য দূর্গাপুজো বন্ধ করে দিয়েছেন, উত্তর ভারতে এই প্রচারের জবরদস্ত প্রভাব এখনো বরকরার।
তো সেই সুদর্শন চ্যানেলের এক মহিলা, কী করে যে একে সাংবাদিক বলি? নিজেরই তো লজ্জা লাগছে, ইনি যদি সাংবাদিক হন, তাহলে আমরা কী? তো যাই হোক, অর্ণবের মানসপুত্রী এই মহিলা হলদিরামের আউটলেটে হাজির হন, তারপর যাকে বলে তুলকালাম, মাইক বাগিয়ে তিনি চিৎকার করছেন, কেউ থামাতে পারছে না। বক্তব্য হল, নবরাত্রি স্পেশাল যে ফলাহারের প্যাকেট, সেগুলোতে উর্দুতে কী লেখা আছে? কী এমন লেখা আছে যা উর্দুতে লিখতে হল? এই ভুজিয়াতে যে তেল দেওয়া হয়েছে তা কি গরুর চর্বি? তাকে যত বলা হচ্ছে, আপনি যা পড়তে পারেন না তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? ওখানে তো ইংরিজিতেও লেখা আছে, সেটা পড়ে নিন, কেনার হয় কিনুন, না কেনার হলে চলে যান। কে শোনে কার কথা, তিনি মাইক বাগিয়ে এলোকেশী হয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছেন।
বলুন, বলুন, বলতেই হবে, উর্দুতে লিখে কোন তথ্য লোকাতে চাইছেন আপনারা? নিশ্চই এটাতে নিষিদ্ধ কিছু আছে, যা আপনা পাবলিককে জানাতে চান না।
বিরতির আগে যা বলছিলাম, শেষমেষ ওই সাংবাদিক একতরফা রায় দিলেন, দেখেছেন, হলদিরাম ভুজিয়াওলা হিন্দুদের জাত মেরে দিতে চায়, আপনারাই বিচার করুন, হলদিরাম থেকে আর জিনিষপত্র কিনবেন কিনা। আসলে প্যাকেটের গায়ে ইনগ্রেডিয়েন্টস লেখা থাকে, বিভিন্ন ভাষায় লেখা থাকে, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের জন্য, যেমনটা আমাদের টাকাতেও লেখা থাকে। এবং সবথেকে মজার কথা হল ওখানে যা লেখা ছিল, তা উর্দুতে নয়, আরবিতে লেখা ছিল, ঐ গন্ডমূর্খ আর্ণব গোস্বামীর মানসপুত্রীকে কে বোঝাবে যে উর্দু ভারতবর্ষ এবং পাকিস্থানের ভাষা, তার লিপি পার্সিয়ান – আরবিক। এখানে লেখার লিপি শুধু নয়, ভাষাও আরবিক, উনি পার্সিয়ান বা আরবিক লিপি, কোনওটাই জানেন না, ওনার কাছে সবটাই মুসলমান, ওনার জানাও নেই যে সারে জঁহা সে অচ্ছার কবি ইকবাল থেকে শুরু করে জাভেদ আখতর সমেত আমাদের দেশে বহু কবি উর্দুতেই শায়রি, গীত, লিখেছেন, উনি উর্দু বলতে মুসলমান বোঝেন আর মুসলমান বলতে গরু, এবং এই বুদ্ধি নিয়ে সাংবাদিকতায় নেমে পড়েছেন।
আপনাদের জন্য আমরা ঐ হলদিরাম ভুজিয়াওলার ৫ টাকা দামের মশলা চানা কিনেছি, তার গায়ে দেখুন কেবল ইংরিজী আর আরবি নয়, ফ্রেঞ্চ ভাষাতেও চানাতে কোন কোন মশলা দেওয়া আছে, সবটা লেখা আছে, খাবারের প্যাকেটে এই উল্লেখ না থাকাটা আইনত অপরাধ, না থাকলে এফ এস এস এ আই, মানে ফুড সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না।
এইভাবেই কল্পিত শত্রু তৈরি করা হচ্ছে, দেখুন এটা উর্দু, আর উর্দু মানেই মুসলমান আর মুসলমান মানেই বিফ, অতএব আপনার জাত মারা যাচ্ছে, অতএব মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি ইত্যাদি ছোটখাট জিনিষ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই, আপনাদের লড়তে হবে এই অনাচারের বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয় ঘটনা আমাদের দেশের রাজধানী দিল্লি সমেত উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে, এক্কেবারে প্রশাসন থেকে সার্কুলার দিয়ে নবরাত্রির এই ৯ কি ১০ দিন কোনও রকম মাংসের দোকান খোলা যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ব্যস, হনুমানের দল জে এন ইউ তেও পৌঁছে গ্যালো, সেখানে কেন মাংস খাওয়া হচ্ছে? মারধর করা হল, ভাঙ্গচুর করা হল, আহত হলেন ছাত্র ছাত্রীরা, রক্ত ঝরল। ছো্ট মোটাভাই চুপ, পুলিশ চুপ, তার মানে নবরাত্রি যারা পালন করবেন, তাঁরা নিরামিষ খাবেন তো বটেই, যারা পালন করবেন না, যাদের পালন করার কোনও প্রশ্নই নেই, তাদেরও পালন করতে হবে?
আচ্ছা দেশের কত মানুষ নিরামিষ খান বা নিরামিষ ভোজী? ন্যাশনাল হেলথ সার্ভের রিপোর্ট বলছে, দেশের পুরো উত্তর পূর্বাঞ্চল, বাংলা, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কেরালা এবং গোয়ার ৯০% এর বেশি মানুষ আমিষ খান, মাত্র ১০ % বা তার কম মানুষ নিরামিষ ভোজী, বিহার ছত্তিশগড়, কর্ণাটক আর জম্মু কাশ্মীরের ৭০ থেকে ৯০% মানুষ আমিষ খেয়ে থাকেন, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল, উত্তরাখন্ড আর মহারাষ্ট্রের ৫০ থেকে ৭৫% মানুষ আমিষ খান, পঞ্জাব আর হরিয়ানার ২৫ থেকে ৫০% মানুষ আমিষ খান, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান আর গুজরাটের ২৫% বা তার কিছু কম মানুষ আমিষ খেয়ে থাকেন, মানে কি দাঁড়ালো? দেশের ৭৫ থেকে ৮০% মানুষ নিরামিষ নয়, আমিষ খাবার পছন্দ করেন, দেশের মানুষ মানে? হিন্দু, মুসলমান, ক্রিস্টান সব্বাইকে মিলিয়েই এই হিসেব, আমার নয় সরকারের।
১৬ টা এমন রাজ্য আছে যেখানে ৯০% এর বেশি মানুষ আমিষ খান। আচ্ছা, অনেকেই বলতে পারেন, নবরাত্রির সময়ে আমিষ খান না, এমন মানুষও তো অনেক আছে, যারা অন্য সময়ে আমিষ খান। হতেই পারে, তাতে কী? আমাদের প্রত্যেকের ঘরেই দু একজন থাকেন, আছেন যিনি আমিষ খান না, কেউ ডিম খান মাংস খান না, কেউ মাছ খান মাংস খান না, কেউ মাটন খান, মুর্গি খান না, তো? আমরা তো একসঙ্গেই থাকি, একসঙ্গেই খেতে বসি, উনি মাছ খাচ্ছেন, আমি মুর্গি, বিয়ে বাড়িতে হয় না? আর হিন্দুরা নিরামিষভোজী? এই তত্ত্বই বা কোথাকার? যিনি বলেছিলেন গর্বের সঙ্গে বল, আমি হিন্দু, তিনি দু বেলা, হ্যাঁ দু বেলা মাছ মাংস খেতেন, আমিষ না থাকলে বিরক্ত হতেন, এক্কেবারে শেষের দিন, নিজে হাতে ইলিশ মাছ রেঁধে, গুরুভাইদের খাইয়েছিলেন।
সনাতন ধর্ম? সনাতন ধর্মের মুনিঋষিরা যজ্ঞে গোবৎস আহুতি দিতেন, সেই মাংস খাওয়া হত? উত্তর ভারতের কিছু ব্রাহ্মণ, কিছু মানুষ নিরামিষ খান, বেশ তো, আপ রুচি খানা, খান আলু করেলার সবজি, কে মানা করেছে, কিন্তু সেইজন্য অন্যরা কি খাবে সেটাও ঠিক করে দেবেন তাঁরা? যিনি ধোকলা, রোটলা, পোটলা খান, তিনি আরামসে খান, কে মানা করেছে? কিন্তু তারজন্য রেস্তোর্যা ন্টে আমিষ খাবার থাকবে না, এ কেমন ফতোয়া?
বিবেকানন্দের, রামকৃষ্ণের আদর্শে গড়ে ওঠা রামকৃষ্ণ মিশনে যান, প্রতি শনিবার মুর্গি রান্না হয়, এই শনিবারও হয়েছে। আসলে এটা হিন্দু ধর্মের বিষয় নয়, এটা নবরাত্রিরও বিষয় নয়, আবার সেই এক কল্পিত শত্রু তৈরি করার ব্যাপার, আমিষ মানে মাংস, মাংস মানেই বিফ, আর বিফ মানে গোমাতা, কারা খায়, মুসলমানরা, অতএব ভুলে যান আপনার মাইনে কমে যাচ্ছে, ভুলে যান রোজ পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ছে, ভুলে যান আপনার ছেলে মেয়ে চাকরি পাচ্ছে না, ভুলে যান দেশের অর্থনীতি বিপন্ন, আপনার লড়াই হোক নবরাত্রি আর আমিষ খাওয়া নিয়ে, এটাই চায় আর এস এস আর বিজেপি, আমরা চুপ করে থাকলে, এই শক্তি আরও জোরদার হবে, এখনও রুখে না দাঁড়ালে এই কল্পিত শত্রুদের নিয়েই কেটে যাবে জীবন। রুখে দাঁড়ান।