সিমলাতে আছে, এবার গুজরাটের মোরবিতে৷ ১০৮ ফুট হনুমান মূর্তির উন্মোচন করলেন দেশের পরধান সেবক, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। গল্প এখানেই শেষ নয়, তিনি আগাম জানিয়ে দিলেন যে এরপরে তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে, তারপরে বাংলার কোথাও একটা জায়গায় ১০৮ ফুট হনুমানের মূর্তি স্থাপনা হবে৷ এটা হল ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা৷ দেশের চারদিকে চারটে ১০৮ ফিটের হনুমান মূর্তি তৈরি করে দেশ এগিয়ে চলবে, এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারতের লক্ষ্যে।
৫৯৭ ফুট উঁচু বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি হয়েছে, স্ট্যাচু অফ ইউনিটি৷ দেশের ঐক্য ফিরে এসেছে৷ ১৬১ ফুট উঁচু রাম মন্দির তৈরি চলছে৷ দেশে রাম রাজ্য স্থাপিত হল বলে৷ এইবার বাকি ছিল শ্রেষ্ট ভারত৷ সেটাও অর্জন হবে৷ সেই কথা জানিয়ে দিলেন দেশের পরধান সেবক। পেট্রল ডিজেল ১০০ ছাড়িয়ে রওনা দিয়েছে, সম্ভবত ডাবল সেঞ্চুরির দিকে৷ ভোজ্য তেল ছিল ৮০ টাকা৷ এখন ২০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে ২০২২ এই ১৩% এর বেশি৷ রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে ১০০০ টাকা ছাড়িয়েছে৷ এখন সমস্যা হল, এমন কোনও মূর্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যা তৈরি করলে জিনিষ পত্রের দাম কমবে৷ এটা বিজেপি সরকার বা নরেন্দ্র মোদি সরকারের দোষ নয়৷ ওই মূর্তিটা খুঁজে বের করে ১৫০/৪০০/১০০০ ফুট তৈরি করলেই ব্যস, দাম হু হু করে নিচে নামতে থাকবেষ অপেক্ষা করুন।
১১৬ টা দেশের মধ্যে হাঙ্গার ইনডেক্স, ক্ষুধা তালিকায় ভারতবর্ষ ১০১-এষ মানে আমার স্বদেশের বেশিরভাগ মানুষ ক্ষুধার্ত, রামেশ্বরম আর এই বাংলায় ১০৮ ফিটের হনুমান মূর্তি দূর করে দেবে ক্ষুধাকে, প্রধানমন্ত্রী বলছেন। ৫ বয়সের কম শিশুমৃত্যুর হার ক্রমশ বাড়ছে৷ তাদের শরীরে জন্ম নিচ্ছে নানান ব্যধি৷ তারা জন্মাবধি সুস্থ নয়৷ তাদের প্রোটিন আহার দরকার৷ দুধ দরকার৷ প্রোটিনের সহজলভ্য শ্রোত হল ডিম, মাছ, মাংস৷ কিন্তু নবরাত্রি আছে, বজরঙ্গ দল আছে, হিন্দু জাগরণ সমিতি আছে, তাদের ফতোয়াও আছে। মধ্যপ্রদেশে সরকার মিড ডে মিলে ডিম বন্ধ করে দিয়েছে৷ শিশুরা কদ্দু কি সবজি খাচ্ছে মন দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই, ৩০ কেজি দুধ ঢালছেন শিবলিঙ্গের ওপরে। দুধের প্যাকেটের দাম বেড়ে ৫৭ থেকে ৫৯ টাকা৷ এ শ্রেষ্ঠ ভারতে শিশুরা জন্মেই দেখবে ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি৷ এটাই তো স্বাভাবিক৷ কিন্তু হনুমান মূর্তি হবে ১০৮ ফুটের।
গত তিরিশ দিনে, একদিনও বাদ নেই, যে দিন অন্তত একটা গোমাংস খাবার অভিযোগে পিটিয়ে মারার, মুসলিম নাগরিকদের ঘর জ্বালিয়ে দেবার, নিদেন পক্ষে তাদের ঘরের মা বোনেদের বলাৎকারের হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি৷ না একদিনও নয়, রামনবমীকে ঘিরে দেশের অসংখ্য জায়গায় একই কায়দায়, একই ভাবে দাঙ্গা ছড়িয়েছে৷ প্রথমে হিন্দুদের ধর্মীয় শোভাযাত্রায় ঢিল পড়েছে৷ তারপর মুসলমান পল্লিতে গিয়ে ঘর জ্বালানো, ভাঙচুর করা হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রধানমন্ত্রী তাই নিয়ে চিন্তিত? একটা কথাও বলেছেন? সবকা সাথ সবকা বিকাশের নারা দেনেওয়ালা প্রধান সেবক চুপ করে আছেন৷ বিরোধীরা বিরোধিতা করবে, এবং আরএসএস – বিজেপি তো এটাই চায়৷ সঙ্গে সঙ্গে আঙুল তুলে বলা যাবে, ওই যে দেখুন, বিরোধী দলের নেতারা আসলে মুসলমান তোষণ করছেন৷ যে কথা বলা হয়েছিল জাতির পিতা গান্ধিজীকে, যে মুসলমান তোষণ, পাকিস্তান প্রেমের অভিযোগ সেদিন সাভারকার, আরএসএস এনেছিল গান্ধীর বিরুদ্ধে৷ হাফ নেকেড ফকিরের বুকে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল বুলেট৷ সেই একই কথা আজও বলে চলেছে তারা৷ লক্ষ্য হিন্দু ভোটের মেরুকরণ৷ হিন্দু জনসংখ্যা ৭৬%, তার ৭০/৮০ % তাদের চাই৷ তাহলেই দেশের ৫০/৬০% ভোট তাদের বাক্সে যাবে৷ এটাই তাঁদের লক্ষ্য। দেশের ঐক্য নয়, দেশের সমৃদ্ধি নয়, দেশের ক্ষুধার্ত মানুষ, ক্ষুধার্ত শিশুকে খাবার দেওয়া নয়, রাম রাজ্য তো নয়ই, তাদের লক্ষ্য গদি৷ তাদের লক্ষ্য সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন৷ এক কিমভুতকিমাকার হিন্দু রাষ্ট্র, যার স্বরূপ ওনারা নিজেই জানেন না, যা তৈরি হবে কিভাবে? যা চলবে কিভাবে? যা হলে মানুষের কোন লাভ হবে, তা নিজেরাই জানেন না। জানলে, বলতেন। কোথাও একটা তো বলতেন। যারা পড়তে লিখতে জানেন, তাঁরা আরএসএস বা বিজেপির যাবতীয় ডকুমেন্ট খুলে দেখুন, কোথাও, কোথাও সেই হিন্দু রাষ্ট্রের রুপরেখা, হিন্দু রাষ্ট্র হলে কী করা হবে? কী কী করা হবে না, সেই হিন্দু রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের অবস্থান কী হবে? ইশ্বরে অবিশ্বাসি নাস্তিকদের অবস্থান কী হবে? একটা কথাও লেখা নেই, বলা নেই। ঠিক এই মূহুর্তে আমাদের দেশ বিশ্বের চতুর্থ গোমাংস রপ্তানিকারক দেশ, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার পরেই ভারতবর্ষের অবস্থান। রপ্তানি থেকে আসা সেই বিরাট পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার কী হবে? তারচেয়েও বড় কথা হল, সেই গরু বা গোমাংসের কী হবে? মোদী সরকারের কাছে তার জবাব আছে? যে সংবিধানের ভিত্তিতে আমাদের দেশ চলছে, তার কী হবে?
সংবিধানের ১৫৩ এ ধারায় পরিষ্কার লেখা আছে, Whoever (a) by words, either spoken or written, or by signs or by visible representations or otherwise, promotes or attempts to promote, on grounds of religion, race, place of birth, residence, language, caste or community or any other ground whatsoever, disharmony or feelings of enmity, hatred or ill-will between different religious, racial, language or regional groups or castes or communities, or (b) commits any act which is prejudicial to the maintenance of harmony between different religious, racial, language or regional groups or castes or communities, and which disturbs or is likely to disturb the public tranquillity, . . . shall be punished with imprisonment which may extend to three years, or with fine, or with both. অন্য ধর্মের মানুষজনেদের ইসারায়, ইঙ্গিতে, কথায়, কোনও ভাবে অপমান করা, তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলা, খারাপ ভাষা প্রয়োগ করা, ধর্মীয় সম্প্রীতি ভঙ্গ করা আইনত অপরাধ৷ তার জন্য তাকে জেলে পাঠানো হবে।
বলা আছে, সরকার চুপ করে বসে আছে৷ পরের পর হিন্দু ধর্ম সংসদের নামে বিষ ছড়ানো হচ্ছে৷ সরকার চুপ। ১০৮ ফুটের হনুমান তৈরি করে দেশ কে শ্রেষ্ঠ করা যাবে? সেই কবে ১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকে অবতার মনে করে রামনবমী পালন করাকে ‘এক সুরুচিবিরুদ্ধ অপ্রিতীকর প্রথা’ বলেছিলেন। আজ তাঁর ভাষায় সেই সুরুচিবিরুদ্ধ অপ্রিতীকর প্রথাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে দাঙ্গা হচ্ছে, উনি চোলায় চোলায় বাজবে জোয়ের ভেরি ইত্যাদি পর্যন্ত মুখস্ত করেছেন৷ রবিঠাকুর পড়েননি, আত্মস্থ করার প্রশ্নই নেই। এই বাংলার কবি, এই বাংলার ঠাকুর বলেছেন, “ইন্ধনের নিজের মধ্যে আগুন প্রচ্ছন্ন আছে বলিয়াই বাহিরের আগুনের স্পর্শে সে জ্বলিয়া উঠে; পাথরের উপর বাহির হইতে আগুন রাখিলে সে ক্ষণকালের জন্য তাতিয়া উঠে, কিন্তু সে জ্বলে না। বাংলাসাহিত্য বাঙালির মনের মধ্যে সেই ভিতরের আগুনকে সত্য করিয়া তুলিতেছে; ভিতরের দিক হইতে তাহার মনের দাসত্বের জাল ছেদন করিতেছে। একদিন যখন এই আগুন বাহিরের দিকে জ্বলিবে, তখন ঝড়ের ফুৎকারে সে নিবিবে না, বরং বাড়িয়া উঠিবে। এখনই বাংলাদেশে আমরা তাহার প্রমাণ পাইয়াছি, বর্তমান কালের রাষ্ট্রীক আন্দোলনের দিনে মত্ততার তাড়নায় বাঙালি যুবকেরা যদি-বা ব্যর্থতার পথেও গিয়া থাকে, তবু আগুন যদি ভারতবর্ষের কোথাও জ্বলিয়া থাকে সে বাংলাদেশে; কোথাও যদি দলে দলে দুঃসাহসিকেরা দারুণ দুঃখের পথে আত্মহননের দিকে আগ্রহের সহিত ছুটিয়া গিয়া থাকে সে বাংলাদেশে। ইহার অন্যান্য যে-কোনো কারণ থাক্, একটা প্রধান কারণ এই যে, বাঙালির অন্তরের মধ্যে বাংলা সাহিত্য অনেক দিন হইতে অগ্নি-সঞ্চয় করিতেছে– তাহার চিত্তের ভিতরে চিন্তার সাহস আনিয়াছে, তাই কর্মের মধ্যে তাহার নির্ভীকতা স্বভাবতই প্রকাশ পায়। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নহে, তাহার চেয়ে দুঃসাধ্য সমাজক্ষেত্রেও বাঙালিই সকলের চেয়ে কঠোর অধ্যবসায়ে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করিয়াছে। পূর্ণ বয়সে বিবাহ, বিধবাবিবাহ, অসবর্ণবিবাহ, ভোজনপঙ্ক্তির বন্ধনচ্ছেদন, সাম্প্রদায়িক ধর্মের বাধামোচন প্রভৃতি ব্যাপারে বাঙালিই সকলের আগে ও সকলের চেয়ে বেশি করিয়া আপন ধর্মবুদ্ধির স্বাতন্ত্র্যকে জয়যুক্ত করিতে চাহিয়াছে। তাহার চিন্তার জ্যোতির্ময় বাহন সাহিত্যই সর্বদা তাহাকে বল দিয়াছে। সে যদি একমাত্র কৃত্তিবাসের রামায়ণ লইয়াই আবহমান কাল সুর করিয়া পড়িয়া যাইত – মনের উদার সঞ্চরণের জন্য যদি তাহার মুক্ত হাওয়া, মুক্ত আলো, মুক্ত ক্ষেত্র না থাকিত – তবে তাহার মনের অসাড়তাই তাহার পক্ষে সকলের চেয়ে প্রবল বেড়ি হইয়া তাহাকে চিন্তায় ও কর্মে সমান অচল করিয়া রাখিত।’’
হ্যাঁ বাঙালি সুর করে একমাত্র কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়েনি, বাঙালি বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা, এক সারিতে বসে মিলিত ভোজন, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে চিন্তা করেছে, বিভেদ বিষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে লড়েছে, প্রাণ দিয়েছে, তারা গান গেয়েছে একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ। ওই ১০৮ ফিটের হনুমান মূর্তি গড়বেন? গড়ুন। আমরা তার পাশে লালনের মূর্তি গড়বো, সিধু কানুর মূর্্যি গড়বো, রামমোহন, বিদ্যাসাগরম বেগম রোকেয়ার মূর্তি গড়ব, হনুমান দিয়ে এ বাংলাকে ভাগ করার স্বপন ছাড়ুন মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার।