ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, বা কংগ্রেস মানে কী? এটা কি শুধু একটা রাজনৈতিক দল? এক রাজনৈতিক দল যারা দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকতে চায়? দেশের অর্থনীতি চালাতে চায়? দেশের প্রশাসন চালাতে চায়? এক অর্থে নিশ্চই তাই৷ দেশে শিল্প তৈরি হবে, দারিদ্র দূর হবে, শিক্ষা স্বাস্থ রাস্তাঘাট, রোজগারের উন্নতি হবে৷ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা হবে ইত্যাদির লক্ষ্য নিয়ে চলা এক রাজনৈতিক দলের নাম কংগ্রেস৷ কিন্তু এই একই লক্ষ্য কি বিজেপির নয়? কমিউনিস্ট পার্টির নয়? লক্ষ্য তো একই, কিন্তু তারা আলাদা কোথায়? আলাদা হল তাদের আদর্শে, তাদের চিন্তায়, তাদের দর্শনে। সাভারকর, গোলওয়ালকর, হেডগাওকার লিখেছিলেন হিন্দু রাষ্ট্রের কথা৷ এক কেন্দ্র শাসিত রাষ্ট্রের কথা, হিন্দু শাসিত রাষ্ট্রের কথা, অখন্ড ভারতবর্ষের কথা, এসব লেখা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, ঠিক সেই পথ ধরে গড়ে উঠেছে আরএসএস – বিজেপি, হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ৷ খুলে দেখুন তাঁদের সংবিধান, কর্মসূচি৷ তাঁদের ৪৯ সালের কর্মসূচিতে যা যা বলা আছে, সেটাই তারা এখন করছে, নতুন কিছু করছে না৷ আগামী দিনে কী করবে বিজেপি সরকার, তা জানার জন্য ওই কর্মসূচিতেই চোখ বোলালেই হবে৷ পেয়ে যাবেন৷ তাঁদের এরপরের ধাপ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড। পরে মিলিয়ে নেবেন।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো লিখেছেন মার্ক্স, এঞ্জেলস৷ ১৮৪৮ এ৷ বলা হয়েছে শ্রমিক রাষ্ট্রের কথা, সমাজতন্ত্রের কথা, সম্পদের সমান বিতরণের কথা, সম্পদ আর সম্পত্তির রাষ্ট্রীয়করণ, সামাজিকরণের কথা। এরপর দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছে, ভারতেও, অবশ্য তাঁরা যে তাঁদের কর্মসূচি মেনে চলছেন, এটা তাঁদের শত্রুরাও বলবে না৷ ফলও হাতে নাতে৷ সবাই জানেন। কিন্তু কংগ্রেস? এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে অবসর নিয়েছেন, অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম, এক চিঠি লিখলেন ১৮৮৩ সালে, কাকে? চিঠিটা এক খোলা চিঠি ছিল৷ এই বাংলার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে৷ এরপর ১৮৮৫ সালে মুম্বইয়ে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হল৷ সভাপতি হলেন এই বাংলার উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দেশের তৎকালীন ভাইসরয়, লর্ড আরউইন এই সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন৷ কারা এসেছিলেন এই সম্মেলনে? আর এক আইসিএস অফিসার উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন, দাদাভাই নৌরজি, ফিরোজ শাহ মেহতা, সাংবাদিক, সম্পাদক গোপাল কৃষ্ণ আগারকর, বিচারপতি কে টি তেলঙ্গ, এন জি চন্দ্রভারকর, দিন শ ওয়াচা, সাংবাদিক গুটি কেশভ পিল্লাই এর মত লোকজন৷ একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম যেখান থেকে ইংরেজ সরকারের কাছে দেশের মানুষের, অধিকারের কথা বলা যাবে৷ ব্রিটিশ আইনে যা যা সুবিধা ব্রিটিশরা পায়, সেগুলো দেশের মানুষজনও পাক, এইসব দাবি নিয়ে তারা দেশের ব্রিটিশ সরকারকে আবেদন, নিবেদন করবে৷ এই ছিল লক্ষ্য। উদার, শিক্ষিত মানুষজন চাইছিলেন উচ্চশিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, সমান আইন, সংবেদনশীল প্রশাসন ইত্যাদি। তার মানে ওই এক উদারপন্থা ছাড়া কোনও আদর্শ ছিল না৷
এরপরে কংগ্রেসে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এলেন৷ অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদী বাল গঙ্গাধর তিলক, যিনি হিন্দু হেজিমনির কথা বলতেন৷ এলেন জিন্নাহ, যিনি তখন হিন্দু মুসলমান ঐক্যের কথা বলতেন৷ লালা লাজপত রাই, বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিন চন্দ্র পাল, লাল বাল পাল কেবল স্বাধীনতাই নয় স্বাধীনতার জন্য লড়াই এর কথা বলতে থাকলেন৷ কংগ্রেসের মধ্যে জন্ম নিল নরম পন্থা, চরম পন্থা। কংগ্রেসের মধ্যেই হিন্দুত্ববাদ, রাষ্ট্রীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারবাদ একই সময়ে একই ভাবে দানা বাঁধতে থাকলো, এবং ক্রমশ দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলা শুরু হল৷ সভাপতি হলেন সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাঁর সময়ে এই স্বাধীনতার দাবি আরও জোরালো ভাবে উঠে এল৷ ততদিনে বঙ্গভঙ্গের ফরমান জারি হয়ে গিয়েছে৷ স্বদেশী আন্দোলনও শুরু হয়ে গিয়েছে। তখনও কেউ যদি কংগ্রেসের আদর্শ নিয়ে লিখতে বসত, তাহলে সে কোনও কিনারা পেত না৷ কারণ একটা কোনও দৃঢ় আদর্শ বলতে যা বোঝায়, তখনও তা তৈরি হয়েই ওঠেনি৷ তখনও দানা বাঁধছিল। ওধারে দক্ষিণ আফ্রিকায় অহিংসা আর সত্যাগ্রহের প্রথম প্রয়োগশালা শেষ করে, গান্ধিজী ফিরে এলেন ভারতে৷ শুরু হল কংগ্রেসের নীতি আর লক্ষ্যের তত্ত্বায়ন। ইতিহাসের পাতা ওল্টান, ১৯১৭ চম্পারণ সত্যাগ্রহ, এবার শুধু অহিংসা আর সত্যাগ্রহই নয়, দেশের কৃষির রূপরেখা কী হবে, তাও সামনে এল, এরপর খেড়া সত্যাগ্রহ, আবার কৃষকদের আন্দোলন, নেতৃত্বে প্যাটেল গান্ধী। মানে কংগ্রেস তার এলিট, সমাজের ওপরের স্তরের চাহিদা আর প্রভাবের বাইরে এসে, আম আদমির রোজকার লড়াই এ সামিল হচ্ছে, কেবল তাই নয়, এরই সঙ্গে রচিত হচ্ছে আগামী ভারতের অর্থনীতির রূপরেখা, গ্রাম স্বরাজের দর্শন৷ এই সময় থেকেই গান্ধিজী চিন্তায় আসে, এরপরেই ১৯১৯ এ খিলাফত আন্দোলন, এক ধাক্কায় কংগ্রেসের হিন্দু হেজিমনি ভেঙে চুরমার৷ সামনে এলো ধর্মনিরপেক্ষতা৷ তার আগেই বাংলায় বাংলার বিভাজন নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে৷ হিন্দু মুসলমান ঐক্যের কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং এরপর থেকে দ্রুত গড়ে উঠতে থাকল স্বাধীনতার আন্দোলন, ডমিনিয়ান স্ট্যাটাস, স্বায়ত্ত শাসন থেকে পূর্ণ স্বরাজের কথা, কংগ্রেসের অধিবেশনে সেই স্বরাজের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হতে থাকল৷ কৃষি নির্ভর ভারতবর্ষের অর্থনীতির সঙ্গেই শিল্পায়নের তত্ত্বও নিয়ে হাজির হলেন জহরলাল নেহরু৷ কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণাও এল৷ আবার গান্ধীজির স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতিও আলোচিত হল৷ স্বাধীন দেশের সংবিধান কেমন হবে, তা নিয়েও আলোচনা হতে থাকল৷ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, স্বাধীনতার কথাও এলো৷
তখন বামপন্থীরা, কমিউনিস্টরা, সহিংস বিপ্লববাদীরাও কংগ্রেসেই৷ কংগ্রেসের মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক ব্লক গড়ে উঠল৷ এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই মুসলিম মৌলবাদী, হিন্দু মৌলবাদীরা বুঝে ফেললেন, কংগ্রেস তাদের জায়গা নয়৷ তাঁরা আলাদা হতে থাকলেন৷ পাকিস্তানের কথা বললেন জিন্নাহ৷ দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা বললেন সাভারকর৷ সুযোগমত তাদের ব্যবহার করতে থাকল ইংরেজ প্রশাসন৷ এইসবের মধ্যে স্বাধীনতা এল ভারতবর্ষকে দুভাগ করে৷ গান্ধী হত্যা হল৷ আবার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই, ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপক্ষে জোরদার আওয়াজ তুলল কংগ্রেস৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজের কথা বললেন৷ রাষ্ট্রের উদ্যোগে ভারি শিল্প গড়ে তোলার কথা বললেন৷ ভিলাই, ভাখরা নাঙ্গল ড্যাম গড়ে উঠল, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হল৷ ওদিকে নন অ্যালায়েনমেন্ট, নির্জোট আন্দোলনও গড়ে তুললেন, যা আমাদের বিদেশনীতিকে এক দিশা দিল৷
পরবর্তীকালে সমাজতন্ত্র শব্দটা লেখা হল দেশের সংবিধানের ভূমিকায়৷ কয়লাখনি আর ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হল৷ প্রিভি পার্স, রাজন্য ভাতার বিলোপ হল। এই সব কিছু ধীরে ধীরে কংগ্রেসের দর্শন, চিন্তা, আইডিয়া হয়ে উঠল৷ এবং এই সবকিছুই ছিল উল্টোদিকে দেশের দক্ষিণপন্থী, আরএসএস, জনসঙ্ঘ, পরে বিজেপির দর্শন চিন্তা, আইডিয়ার এক্কেবারে উল্টোদিকের কথা। এই আইডিয়া কেউ একজন লিপিবদ্ধ করার পর কংগ্রেস গড়ে ওঠেনি৷ বরং বহু বছর, বহু আলোচনা, বহু আন্দোলনের মধ্য দিয়েই কংগ্রেসের এই দর্শন গড়ে উঠেছে৷ এর প্রাথমিক উদারবাদ এসেছে এক্কেবারেই শুরুতে৷ গান্ধিজী আসার পরে অহিংসা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গ্রাম স্বরাজের কথা এসেছে৷ নেহরুর হাত ধরে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, বিশ্ব রাজনীতিতে নির্জোট অবস্থানের কথা এসেছে৷ এইভাবে এক দর্শন গড়ে উঠেছে, যাকে কংগ্রেসের মতবাদ বলা হয়৷ তা কেবল গান্ধীবাদের ওপর গড়ে উঠেছে বললে ভুল হবে৷ যদিও গান্ধিজীই ছিলেন সেই অর্থে পথপ্রদর্শক।
গতকাল আলোচনা করছিলাম, কংগ্রেসের পুনরুত্থান নিয়ে৷ রিভাইভাল অফ কংগ্রেস, কীভাবে হবে? সাংগঠনিক কাঠামো তো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চিত, কিন্তু দলের দর্শন, দলের আদর্শ? সেটা সব থেকে জরুরি। যে আদর্শ থেকে কংগ্রেস ক্রমশ দূরে সরে এসেছে৷ তার গ্রাম স্বরাজ, তার সমাজতন্ত্র রাজীব গান্ধীর সময় থেকেই গিয়েছে চুলোর দোরে৷ হঠাৎ বিশ্বায়ন, ভুবনায়নের চক্করে বিলগ্নীকরণের পথ দেখিয়েছেন নরসিনহা, মনমোহন৷ কল্যাণকামী রাষ্ট্র ক্রমশঃ নিস্পৃহ হয়েছে৷ গরীবস্য গরিবদের ভরসা হারিয়েছে৷ অর্থনীতিতে হঠাৎ উলটো চাকা ঘোরাতে গিয়েও এসেছে বিপর্যয়৷ এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাও কখনও সখনও ব্যাক সিটে চলে গিয়েছে৷ শাহ বানো মামলা বা বাবরি মসজিদের দরজা খোলার কথাই ভাবুন না৷ একবার মুসলিম তোষণ, অন্যবার হিন্দু ভোটের খেলা, এবং এইভাবে স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে হতে, আজকের কংগ্রেসের আমও গেছে ছালাও গেছে, দল এখন না ঘরকা, না ঘাটকা।
সেই দলের নেতাদের আপাতত মনে হচ্ছে, বিজেপির বিরুদ্ধে মুসলমানরা তো আমাদের ভোট দেবেই৷ কাজেই তাদের স্বপক্ষে, তাদের কাছাকাছি গিয়ে হিন্দু ভোট হারাব কেন? কাজেই মন্দিরে মন্দিরে যাওয়া যাক, পৈতে দেখিয়ে নিজের ব্রাহ্মণত্ব প্রমাণ করছেন রাহুল গান্ধী৷ একে বলে অন্যের কোর্টে গিয়ে খেলার চেষ্টা৷ বিজেপি এই খেলার সব থেকে বড় খেলোয়াড়৷ চেষ্টা করলেও রাহুল গান্ধী বিজেপির মত হিন্দু হতে পারবেন না৷ কিন্তু সেটারই চেষ্টা চলছে৷ জাহাঙ্গিরপুরীর ঘটনা দেখুন৷ ঘটনাস্থলে রাহুল, প্রিয়াঙ্কা গেলেনই না, মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছে, মুসলিম সমস্যার কথা বেশি বললে, হিন্দু ভোট চলে যাবে। দেখুন গান্ধিজীকে, দেশ বিভাজনের পর দিল্লিতে যে সব মুসলমান সম্পত্তি, মসজিদ দখল করেছিল হিন্দুরা, তিনি সরকারকে, প্রশাসনকে অবিলম্বে তা ফেরত দিতে বলেছিলেন৷ আবার অনশনে বসার কথা বলেছিলেন৷ খুব ভালো করে জানতেন যে হিন্দুত্ববাদীরা এর তীব্র বিরোধিতা করবে৷ তার আগেই তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা ধরাও পড়েছে৷ তিনি সেটা নিয়ে ভাবেননি৷ আবার তাঁর হিন্দু জীবনযাত্রায়ও কোথাও ছেদ পড়েনি৷ নিরামিষভোজী, নিষ্ঠাবান হিন্দু হয়েই থেকে গিয়েছেন চিরটা কাল৷ পৈতে দেখাতে হয়নি। আজ সেই কংগ্রেসের পুনরুত্থানের কথা বলা হচ্ছে৷ কংগ্রেসকে ভাবতেই হবে তার শিকড়ের কথা৷ ১৩৭ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা তার দর্শন, আইডিয়া আর চিন্তার কথা, সেটা কে ফিরিয়ে আনবেন? এক পিকে? প্রশান্ত কিশোর? যিনি তাঁর প্রেজেন্টেশনের প্রথমেই দিয়েছেন নটরাজের ছবি? সেই শিব, যিনি ধ্বংস এবং সৃষ্টির প্রতীক? আদর্শে ঘুণ ধরে যাবার পর, সেই সংগঠন কে ঘুরে দাঁড়াতে হলে তার কোর আইডিয়া, তার মূল আদর্শের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে, কংগ্রেসের পক্ষে সেটা করা সম্ভব? আরও বড় প্রশ্ন, একজন ইলেকশন ডেটা অ্যানালিস্ট, স্ট্রাটেজিস্ট এর পক্ষে সেটা করা সম্ভব?