বিজেপি নাকি দারুণ শৃঙ্খলিত দল। ইংরেজিতে যাকে রেজিমেন্টেড পার্টি বলে। আরএসএসের কঠোর অনুশাসন নাকি মেনে চলতে হয়। এমনও বলা হয়, বিজেপির চালিকা শক্তি হল নাগপুরের আরএসএস।
তো, এ হেন শৃঙ্খলিত দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার শৃঙ্খলা দেখে অবাক হতে হচ্ছে। ভোটের ফল প্রকাশের পর এক মাস যেতে না যেতেই যেভাবে বিজেপির কোন্দল সামনে এসেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, দলটার হাল কতটা শোচনীয়। পাশাপাশি তিন চার মাস আগেও যে সমস্ত তৃণমূল নেতা দম বন্ধ হয়ে আসছিল বলে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেও অনেকে এখন দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এখনই তাঁদের একাংশ যা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে, এখন বিজেপিতেও ওই নেতাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। দম নেওয়ার জন্য ওই দলবদলু নেতারা আবার তৃণমূলে ফিরতে চাইছেন কি না, কে জানে। অবশ্য ফিরতে চাইলেই যে ফেরা যাবে, তাও নয়। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো অনেক আগেই এঁদের সম্পর্কে বলেছেন, গেছে, আপদ বিদায় হয়েছে। তবে বলা যায় না, নেত্রীর মন অতি নরম। তিনি এই দলবদলুদের কাউকে কাউকে ফিরিয়ে নিতেও পারেন। এ ব্যাপারে তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। সেটা ভবিষ্যৎ বলবে।
এখন একটু বিজেপির অন্দরের হালচাল দেখার চেষ্টা করা যাক। ভোটের ফল প্রকাশের আগেই দলের প্রার্থী বাছাই নিয়ে মুখ খুলেছিলেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়। তিনি কয়েকজন তারকা প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ওই প্রবীণ নেতা তারকা প্রার্থীদের নগরীর নটি বলেও কটাক্ষ করেন। আবার ভোটের ফল প্রকাশের পর তথাগত রায় ফের সোশ্যাল মিডিয়ায় দলের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে বসেন। তাঁর ইঙ্গিত ছিল দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়, শিব প্রকাশ এবং অরবিন্দ মেননের দিকে। তথাগত চারজনকে ‘কেএসডিএ’ বলে উল্লেখ করেন সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে। তাঁর অভিযোগ ছিল, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সব ক্ষমতা ছিল এই চারজনেরই হাতে।
এখন যত দিন যাচ্ছে, একের পর এক তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতারা দলের কর্মপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। গত মঙ্গলবার রাজ্য সভাপতি পর্যালোচনা বৈঠক ডেকেছিলেন। তাতে গরহাজির ছিলেন সর্বভারতীয় সহ সভাপতি মুকুল রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীরা। মুকুল রায় সাংবাদিকদের বললেন, সভার ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। তা ছাড়া আমি এখন এ সবের মধ্যে নেই। নিজের যন্ত্রণা নিয়ে আছি আমি। দিলীপ ঘোষ দাবি করলেন, সকলকেই খবর দেওয়া হয়েছিল। ওই সভায় আসেননি রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর আত্মীয় অসুস্থ বলে নাকি তিনি সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। কলকাতায় যখন সভা চলছে, তখন শুভেন্দু অধিকারী দিল্লিতে জে পি নাড্ডা এবং অমিত শাহের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে ব্যস্ত রইলেন। তাঁর অনুপস্থিতি নিয়ে দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, শুভেন্দুর সভায় থাকা উচিত ছিল। আমি জানি না, তিনি দিল্লিতে কেন। দিল্লিতে শুভেন্দু সাংবাদিকদের কাছে দাবি করলেন, রাজ্যের পরিস্থিতি ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের থেকেও খারাপ।
আবার এরই মধ্যে বিতর্ক বাড়িয়েছে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সোশ্যাল মিডিয়ার বক্তব্য। তিনি শুভেন্দুর পাল্টা বললেন, কথায় কথায় দিল্লি আর ৩৫৬ ধারার জুজু দেখালে বাংলার মানুষ ভালোভাবে নেবে না। মানুষের বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আসা নির্বাচিত সরকারের সমালোচনা ও বিরোধিতা করতে গিয়ে যা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। এই মুহূর্তে যশ ও করোনার বিরুদ্ধে রাজনীতি ভুলে একসঙ্গে লড়াই করা দরকার। দলের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট করলেন, মন্ত্রী হতে পারেননি বলে আবার কি পুরনো দলে ফিরতে ইচ্ছে করছে?
এখানেই শেষ নয়। আর এক নেতা সব্যসাচী দত্ত ভোটের প্রচারে অবাঙালি নেতাদের আনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন।
এই হল একটা শৃঙ্খলিত দলের নমুনা! আরও হাস্যকর বিষয় হল, মঙ্গলবারের সভায় তিন সদস্যের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। কীসের কমিটি? কীসের শৃঙ্খলা?
দিল্লিতে গিয়েছিলেন তথাগত রায়। বৃহস্পতিবার কলকাতায় ফিরেই তিনি দাবি করলেন, দলে কোন্দল বলে কিছু নেই। বড় দলের মধ্যে এ সব হয়েই থাকে। এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
একেই বলে শৃঙ্খলাবদ্ধ বা রেজিমেন্টেড পার্টি, তাই না? দিনে দিনে আরও কত অলীক কুনাট্য দেখতে হবে বিজেপিতে, কে জানে।