বাদুড়িয়া: হিমন মণ্ডল৷ শীর্ণকায় চেহারা৷ বয়স ২৪ বছর৷ উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ার নারিকেল বেড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা৷ গত ১৭ অক্টোবর রবিবার রাতে তিনি মারা গিয়েছেন৷ দুঃস্থ পরিবার৷ সম্বল বলতে রইলেন একমাত্র বুড়ি মা, করুণা মণ্ডল৷ বাবা অনেক দিন আগেই চলে গেছেন৷ বাকি দুই দিদি, বিবাহিত৷ কেউ নেই আর৷ কীভাবে হবে হিমনের সৎকার? খবর পেয়ে বৃষ্টির মধ্যেই গভীর রাতে হিমনের মা’য়ের পাশে দাঁড়ালেন পড়শি আট-দশজন মুসলিম যুবক৷ কাকিমা চিন্তা করবেন না৷ আমরা আছি! আশ্বাস শুনে ছেলে হারানো মা কিছুটা শান্ত্বনা পেয়েছিলেন৷ চিকিৎসায় সুস্থ না করতে পারলেও শেষ যাত্রা তো ঠিকঠাক হবে!
দেহ কাঁধে শ্মশানমুখী গ্রামবাসীরা৷ নিজস্ব চিত্র৷
রবিবার সকালে আলো ফুটতেই এগিয়ে এলেন গ্রামেরই আরও ৩০-৪০ জন যুবক৷ তাঁরা সকলেই মুসলিম সম্প্রদায়ের৷ ফলে, চিন্তা হচ্ছিল কীভাবে হিন্দুরীতি মেনে হিমনের সৎকার হবে? কে বা কারা দু-আড়াই কিমি দূরের শ্মশানে নিয়ে যাবে? কিন্তু না৷ সবই সুষ্ঠভাবে হিন্দুরীতি মেনে সম্পন্ন হয়েছে৷ হিমনের জামাইবাবুদের থেকে শুনে বাঁশকারা থেকে খড় গোছনোর কাজ সারলেন মুসলিম যুবকরাই৷ দেহ কাঁধে চাপিয়ে ‘বলো হরি, হরি বোল…’ বলতে বলতে শ্মশানে নিয়েও গেলেন তাঁরা৷ এক অন্য সম্প্রীতির গল্প বুনল বারাসাত বিদ্রোহের নায়ক মীর নিশার আলি ওরফে তিতুমীরের গ্রাম নারিকেল বেড়িয়া৷
আরও পড়ুন-গেরুয়া শিবিরের আক্রমণের মুখে ‘জশন-ই-রিওয়াজ’ প্রোমো সরাল ফ্যাব ইন্ডিয়া
শ্মশান চত্বরে গ্রামবাসীরা৷ নিজস্ব চিত্র৷
এই গ্রামে প্রায় দু’হাজার মানুষের বাস৷ হাতে গোনা তিন-চারটি হিন্দু পরিবার৷ বাকি সকলেই মুসলিম সম্প্রদায়ের৷ কিন্তু, কোনও দিনই কোনও প্রকার ধর্মীয় ঝামেলা কিংবা হিংসা হয়নি৷ সকলেই একে-অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সামিল হন৷ যেমন হিমনের সৎকারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এসেছেন। গ্রামবাসীদের দাবি, তিতুমীরই তো ভেদাভেদ ভুলিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে শিখিয়ে ছিলেন৷ সেই রেওয়াজ আজও বজায় আছে৷
আরও পড়ুন-সীমান্ত পাহারায় আরও বেশি ক্ষমতা বিএসএফের হাতে, বাংলা-পঞ্জাবকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা?
যুবক ছেলে হিমনের মৃত্যু কারণ কী? স্থানীয় সূত্রে খবর, মানসিক অবসাদে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধেয় বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন হিমন৷ পড়শিরা জানতে পেরে তাঁকে স্থানীয় ব্লক হাসপাতাল রুদ্রপুরে নিয়ে যায়৷ কিন্তু, প্রাথমিক চিকিৎসার পরে বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়৷ সেখানকার চিকিৎসকরাও ঝুঁকি নিতে চাননি৷ তাঁকে কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরের কথা বলেন৷ হিমনকে ফের কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়৷ দিন পনেরো সেখানেই চিকিৎসা হয় হিমনের৷ কিন্তু, হিমন বাঁচবে, একথা সেখানকার চিকিৎসকরাও দিতে পারেননি৷ বরং, বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন৷
আরও পড়ুন-হিন্দুদের উপর হামলায় জড়িতদের কড়া শাস্তি দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ হাসিনার
১৬ তারিখ সন্ধেয় হিমনকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়৷ বাড়িতে ফিরে অক্সিজেন ছাড়ায় দিব্যি ছিলেন হিমন৷ হিমনের মুখ থেকে ‘কোনও রকম অসুবিধা হবে না’ শুনে মুসলিম পড়শিরা যে যার বাড়ি ফেরেন৷ তার ঘণ্টা দেড়েক পরে হিমনের মৃত্যুর খবর পেয়ে ফের এগিয়ে আসান তাঁরা৷ বাকিটা হিন্দু রীতিনীতি মেনেই সম্পন্ন করা হয়৷ কয়েক দিনের মধ্যে রীতিমেনে গ্রামের লোক হিমনের আত্মার শান্তি কামনায় দান-ধ্যান ও অতিথিভোজন অনুষ্ঠান করবে৷ সব মিলিয়ে পড়শি বাংলাদেশে যখন ‘হিংসা’র ঘটনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে কাটাছেড়া চলছে, তখন ইছামতী পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে নারিকেল বেড়িয়ার ‘সম্প্রীতি’র গল্প নতুন করে ভাবতে শেখায়৷