কথায় আছে কোথাও তেরাত্তির না কাটালে নাকি পুণ্যি হয় না। পুরাণ মতে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য পঞ্চপাণ্ডবরা মহাদেবের কাছে যেতে চেয়েছিলেন৷ পঞ্চপাণ্ডবদের ধরা না দেওয়ার জন্য মহাদেব ছদ্দবেশ ধারণ করেছিলেন৷ শিব বেশধারী ষাঁড় ভীমের গদার আঘাতে মোট পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত হন। কেদারনাথ ছাড়াও বাকী শিবলিঙ্গ গুলি হল – তুঙ্গনাথ, রুন্দ্রনাথ, মদমহেশ্বর, কল্পেশ্বর, যা পঞ্চকেদার নামেও পরিচিত। মদমহেশ্বর মন্দির পঞ্চ কেদার এর একটি অংশ। পঞ্চ কেদার ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত পাঁচটি পবিত্র স্থান। যার সবকটি গাড়োয়াল হিমালয় এ অবস্থিত। শুধু তাই নয়, যারা পঞ্চকেদার তীর্থযাত্রায় পড়ে -তুঙ্গনাথ (যেখানে ভগবান শিবের হাত পড়েছিল), রুদ্রনাথ ( যেখানে ভগবান শিবের মুখ পড়েছিল), মধ্য মহেশ্বর (যেখানে ভগবান শিবের পেট পড়েছিল), এবং কল্পেশ্বর (যেখানে ভগবান শিবের নীচের অংশ পড়েছিল)। মহাদেবের অস্তিত্তের উপর ভর করেই এই তীর্থস্থানগুলি গড়ে উঠেছে বলে মানুষের বিশ্বাস। এই সব মন্দির দর্শনের উদ্দেশে মানুষের পদচারণা বহু যুগ ধরে।
পঞ্চকেদারের দ্বিতীয় কেদার মদমহেশ্বর (Shri Madmaheshwar) বা মধ্যমহেশ্বর। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী গুপ্তকাশীতে যে বৃষরূপী মহাদেবকে জাপটে ধরতে চেয়েছিলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম, তাঁরই পেট ও নাভি এসে পড়েছিল গাড়োয়াল হিমালয়ের এই জায়গায়। কথিত আছে, স্বয়ং ভীমই এই মন্দিরের নির্মাতা ও প্রথম তাঁর হাতেই এখানে আদিদেবের পুজো হয়। কেদারনাথের (Kedarnath) মতো ভিড় নেই মদমহেশ্বরের পথে। তুলনায় বেশ দুর্গম হওয়ায় কেদারনাথ ফেরত হাতে গোনা যাত্রী বা উৎসাহী ট্রেকারসই মধ্যমহেশ্বরের পথে পা বাড়ান।
শীতের সময় কেদারনাথের মতোই মদমহেশ্বরের দেবতার প্রতীক পুজোও হয় উখীমঠের ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে (Omkareshwar Temple)। এখানে দেখা মিলবে মধুগঙ্গার। বানতোলি হল মার্কন্ডেয় গঙ্গা আর সরস্বতী নদীর সঙ্গম স্থল। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে মদমহেশ্বর গঙ্গা বা মধুগঙ্গা।
উত্তর ভারতীয় রীতিতে তৈরি মধ্যমহেশ্বর দেখতে অবিকল প্রথম কেদার ‘কেদারনাথ’ কিংবা তৃতীয় কেদার ‘তুঙ্গনাথের’ মতোই। গর্ভগৃহের কালো পাথরে নির্মিত নাভি আকৃতির শিবলিঙ্গ দর্শন সেরে এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়বে আরও বহু প্রাচীন দুটি মূর্তি। একটি দেবী পার্বতীর ও আরেকটি হল চতুর্ভুজ অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। মাইসোর, কর্ণাটক থেকে শঙ্করাচার্যের তত্ত্বাবধানে আসা লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের দক্ষিণ ভারতীয় পুরোহিতরাই বংশ পরম্পরায় এ মন্দিরের পূজারী। উত্তর-দক্ষিণের সংস্কৃতির এই মেলবন্ধন পঞ্চকেদারের প্রায় সর্বত্রই ঘটেছে।
মদমহেশ্বরের মূল মন্দিরের ডানদিকের ছোটো মন্দিরটিতে রয়েছেন জ্ঞান অধীষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর সুন্দর এক প্রাচীন মার্বেল মূর্তি। স্থানীয় মানুষেরা মন্দিরের সন্ধ্যারতির সময়, বাড়িতে আসা অতিথি-সহ এখানে উপস্থিত থাকেন সবাই। বহু প্রাচীন এই সংস্কার। মন্দির চত্বরেই টিনের তৈরি অস্থায়ী আবাসে মোটামুটি প্রয়োজনীয় পরিষেবায় রাতটা কাটিয়ে, সকালে এখান থেকে আরও দুই কিলোমিটার ওপরে উঠে দেখে নেওয়া যায় বৃদ্ধ মদমহেশ্বর মন্দির। এখানে দেবতার প্রসাদ ভারি মজার – চকোলেট আর বিস্কুট। খুবই ছোটো অথচ বহু প্রাচীন এই মন্দিরে এসে দাঁড়ালেই পিছনে দৃশ্যমান হয় অপূর্ব সুন্দরী চৌখাম্বা, মন্দানী রেঞ্জ। সাদা সবুজে ঘেরা এই অপূর্ব শান্ত, সমাহিত দৃশ্যপটের সামনে একবার দাঁড়ালে তা সারাজীবনে আর ভোলা দুষ্কর।