ওয়েব ডেস্ক: দুর্গাপুজো (Durga Puja) এলেই বাংলার কোণায় কোণায় জেগে ওঠে কিছু ঘুমন্ত ইতিহাস। দেবীর আরাধনায় আমরা আবার ফিরে যাই প্রাচীনকালের ঠাকুর-দালানে। বাঁকুড়া (Bankura) জেলার পাত্রসায়ের থানার হদল–নারায়ণপুর (History Of Hodol Narayanpur Durga Puja) অঞ্চলেও রয়েছে এমন এক জীবন্ত ইতিহাসের নিদর্শন। রাঢ়বঙ্গের প্রান্তভূমিতে আজও টিকে আছে প্রায় ৩৫০ বছরের ঐতিহ্য। মুচিরাম ঘোষের ভাগ্য অন্বেষণ, মল্ল রাজাদের আশীর্বাদ, জলদস্যুদের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ এবং দেবীর প্রতি মানতের সূত্রে গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ জমিদারি ও দুর্গাপুজোর ইতিহাস (History Of Durga Puja) এই অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
প্রায় সাড়ে তিন শতাব্দী আগে বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে আসেন মুচিরাম ঘোষ। ঘুরে ঘুরে এসে তিনি পৌঁছন বোদাই নদীর তীরে। ক্লান্ত শরীরে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর পরিচয় হয় গণিত আচার্য শুভঙ্কর রায়ের সঙ্গে। তিনিই মুচিরামকে নিয়ে আসেন মল্ল রাজার দরবারে। মল্লরাজ গোপাল সিংহ তাঁর দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দামোদরের উপনদী বোদাইয়ের তীরে বিশাল জমিদারি দান করেন। পরে ব্রিটিশ শাসনের সময় মণ্ডল পরিবার সাতটি নীলকুঠির ইজারা নিয়ে নীল ব্যবসায়ে সফলতা অর্জন করে। নীল বোঝাই বজরা নিয়ে দূরবর্তী বাজারে যাতায়াত ছিল তাদের অর্থনীতির মূল ভরকেন্দ্র।
আরও পড়ুন: এখানে দেবী ব্যাঘ্রবাহিনী, বৈচিত্র্যময় অযোধ্যার জমিদার বাড়ির পুজো
কিন্তু সমৃদ্ধির সঙ্গে বিপদও নেমে এল মণ্ডল পরিবারের উপর। কথিত আছে, একবার নীল বোঝাই বজরা নিয়ে ফেরার পথে জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হন মণ্ডল পরিবারের পূর্বপুরুষরা। সেই সময় দুই বিশ্বস্ত লাঠিয়াল—দামু ও কামু প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে জমিদারকে প্রাণে বাঁচান। প্রাণ ও সম্পদ ফিরে পেয়ে জমিদার দেবী দুর্গার নামে মানত করেন। সুস্থ ফিরে এসে তিনি বজরায় থাকা সমগ্র সম্পদ দেবত্তর সম্পত্তি হিসেবে উৎসর্গ করেন। সেই অর্থে নির্মিত হয় বিশাল দুর্গা মন্দির, রাস মঞ্চ, রথ মন্দির, নাট মন্দির এবং নহবতখানা। জমি ও পুকুর ক্রয় করে দেবীর নামে দান করেন, যাতে বংশ পরম্পরায় পুজো অব্যাহত থাকে।
সে সময়ের দুর্গাপূজা ছিল জমিদারির ঐশ্বর্যের এক অনন্য প্রদর্শনী। সাত দিন ধরে নহবত বাজত, বেলজিয়ামের কাঁচের ঝাড়বাতিতে আলো ছড়াত মন্দির প্রাঙ্গণে। পুতুলনাচ, যাত্রাপালা এবং তোপধ্বনির মাধ্যমে পুজোর প্রতিটি কর্মসূচি ঘোষণা হত। দূর-দূরান্তের মানুষ জমিদারবাড়িতে ছুটে আসত উৎসবে অংশ নিতে।
আজ নীলকুঠির আড়ম্বর কিংবা জমিদারির ঐশ্বর্য ফিকে হয়েছে, তবু মণ্ডল পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছেন। দেবত্তর সম্পত্তির আয়ে আজও নিয়মিত দুর্গাপূজা হয়। ধুলো ঝেড়ে টাঙ্গানো হয় পুরোনো ঝাড়বাতি, নহবতখানা থেকে বাজে সানাই, আর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা ছুটে আসে ইতিহাসের সাক্ষী হতে। অতীতের গৌরব, দেবীর প্রতি ভক্তি আর সামাজিক ঐক্যের এই উৎসব আজও হদল নারায়ণপুরের মানুষের গর্ব।
দেখুন আরও খবর: