গাঁয়ে কেউ না মানলেও সে নিজেই নিজেকে মোড়ল ভাবতে চায়। মনোভাব মনেই মহান। কংগ্রেসের হাব ভাব দেখলে সেটাই মালুম হবে। এই সার কথাটুকু মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পর লালুপ্রসাদ যাদব-দুজনেই তাঁদের মতো করে কংগ্রেস সভানেত্রী সানিয়া গান্ধীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু হারানো জমিদারি ঘুচে গেলেও যেমন জমিদার বাবুর রোয়াবি যায় না, বর্তমান কংগ্রেসের দশা অনেকটা সে রকম। তা নাহলে বিহারে দুটি উপনির্বাচনে লড়তে গিয়ে জোট ভেঙে প্রার্থী দেয় !
বিহারের বিগত বিধানসভা ভোটে লালুর আর জে ডির সঙ্গে জোটে ছিল কংগ্রেস। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই জোট ভাঙেনি ঠিক। কিন্তু আগামী শনিবার ওই দুই কেন্দ্রে এনডিএ-র বিরুদ্ধে বিরোধী আর জে ডির পাশাপাশি কংগ্রেসও লড়বে। কংগ্রেসের আবদার ছিল , উপনির্বাচনে তাদের একটি আসনে লড়তে দিতে হবে। লালুর দল তা মানেনি। একতরফা নিজেদের দুই প্রাথীর নাম ঘোষণা করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ কংগ্রেস-পাল্টা প্রার্থী দিয়েছে। দুই শরিকে নাকি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ লড়াই হবে। অর্থাৎ ওই দুই কেন্দ্রে এন ডি এ বিরোধী ভোট বিভাজন অনিবার্য।
গত বিধানসভা ভোটে মহাজোটের শরিক হয়েও কংগ্রেস হালে পানি পায়নি। তবুও সেই গো ধরে বসে কংগ্রেস। তাকে আসন ছাড়তেই হবে। ফলে, বিজেপি তথা এনডিএ কে হারানো নয়, তাদের অগ্রাধিকার স্রেফ দলের স্বার্থ।
বিজেপির বিরুদ্ধে জোট গড়ার চাইতে প্রস্তাবিত সেই মঞ্চের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে সে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত দেশের সর্বপ্রাচীন জাতীয় দল। তাই কেন্দ্রীয় স্তরে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে গড়িমসি আর কাটছে না কংগ্রেসের। নিজেদের ঘর সামলাতে পারছে না। ভোটেও সাফল্যের ভাড়ার প্রায় শূন্য। বিশেষত বিজেপি মোকাবিলায় কংগ্রেস যে খেল দেখাচ্ছে, তাতে বাকি বিরোধীরা ভরসা পাচ্ছে না। তবুও কংগ্রেসকে কেউই বাদ দিতে চাইছে না। তার অন্যতম কারণ গোটা ভারতে দলের কম বেশি হলেও সাংগঠনিক উপস্থিতি রয়েছে। বাস্তবতা অবশ্য বদলে যাচ্ছে। কংগ্রেস কেন্দ্রে বা রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে। একই সময়ে গেরুয়া শিবিরকে ধাক্কা দিয়ে চলেছে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল। স্বভাবতই, সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপিকে রাজ্যস্তরে নাস্তানাবুদ হতে হলেও সেখানে কংগ্রেসের ভূমিকা অনুপস্থিত। গত বছর হওয়া বিহার বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসকে মহাজোটে নিয়েও যে বিশেষ লাভ হয়নি,তা ফলাফলই বলে দিয়েছে। বাংলার দৃষ্টান্ত তো কংগ্রেসের পক্ষে আরও করুণ।সেখানে মমতাকে রুখতে গিয়ে বামেদের হাত ধরে স্বখাত সলিলে ডুবেছে সোনিয়া বাহিনী। বিজেপি পরাক্রম বস্তুত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে এককভাবে রেকর্ড আসন পেয়ে তৃতীয় বার ক্ষমতায় বসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সময় বাংলার সঙ্গে অসম, তামিলনাড়ুতে ভোট ছিল। ঘটনাচক্রে অসমে বিজেপির সম্মুখ লড়াইয়েও পরাজিত কংগ্রেস। অথচ বাংলার পাশাপাশি দক্ষিণেও নরেন্দ্র মোদির দলকে গোহারা হারিয়েছে বিরোধী জোট যার নেতৃত্বে এম কে স্ট্যালিনের ডি এম কে। বিজেপির কাছে কংগ্রেসের এই আত্মসমর্পণ, বিরোধী শিবিরের মনোবল ভাঙার পক্ষে যথেষ্ট। বিজেপির এই আপাত অপ্রতিরোধ্য ছবিটা বদলে দিয়েছে তৃণমূল,ডিএমকে,আপ, জে এম এমের মতো মূলত রাজ্য ভিত্তিক দল।
অবিজেপি শক্তিগুলিকে এক ছাতার তলায় আনার লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন মমতা। বাংলা বিজয়ে হ্যাট্রিকের পর দেশজুড়ে তাঁকে ঘিরে আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। ত্রিপুরা,গোয়ায় বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে জোরদার প্রস্তুতি শুরু করেছে মমতার দল। দেশব্যাপী তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি হলেও নিজেকে বিকল্প জোটের নেত্রী বলে দাবি করেননি তৃণমূল নেত্রী। উল্টে কংগ্রেস সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে বিকল্প মঞ্চ নির্মাণের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তারপর থেকে প্রায় চার মাস কেটে গেলেও সোনিয়াকে এই বিষয়ে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি।
বৃহত্তর রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে দলীয় স্বার্থের সংকীর্ণতা সরিয়ে রেখে এই উদ্যোগ নিতে হবে। সম্প্রতি, তৃণমূল মুখপত্রে নিজের কলামে কংগ্রেসকে এমন স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। প্রায় একই কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন লালু প্রসাদ যাদবও।
আড়াই বছরের বন্দিদশা কাটিয়ে সদ্য সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরেছেন রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সুপ্রিমো লালু প্রসাদ। উপ-নির্বাচনে দলীয় প্রচারে গিয়ে তিনি জোট শরিক কংগ্রেসকে দুষেছেন। তাঁর দাবি, উপ নির্বাচনে কংগ্রেসকে আসন ছাড়লে জামানত রাখতে পারতো না। জানা গিয়েছে, তার পরপরই সোনিয়া লালুকে ফোন করেন। সৌজন্যের খাতিরে ফোনাফুনি হলেও সর্ব ভারতীয় দলের নেত্রীকে তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। মমতার মতো লালুও সম মনোভাবাপন্ন অবিজেপি দলগুলোকে নিয়ে বৈঠক ডাকার আবেদন জানিয়েছেন। যেটা বলেননি লালু,সেটা হলো নিজের ওজন বুঝে চলুন কংগ্রেস সভানেত্রী।