একই সঙ্গে পাবলিক অ্যাফেয়ার ইনডেক্সের ২০২০ র রিপোর্ট বের হল। যা দেশের প্রতিটা রাজ্যের সম্পদ, তার ব্যবহার, মানুষের সেই সম্পদের ওপর অধিকার, মানুষ কতটা পাচ্ছে তার হিসেব নিকেশ পাওয়া গেলো। এদিকে ইউনিয়ন হাউসিং অ্যান্ড আর্বান মিনিস্ট্রি, এই প্রথম স্মার্ট সিটির হিসেব নিকেশ করে জানিয়ে দিল উত্তর প্রদেশ, যোগীজির রাজ্য এক্কেবারে শিখরে, এর আগে এরকম কোনও তকমা আর্বান হাউসিং দফতর থেকে কোনওদিনও দেওয়া হয়নি, এবার হল। যোগীজি প্রত্যেক কাগজে বড় বড় করে, নিজের এবং রাজ্যের এই প্রাপ্তির কথা ছাপালেন। কিন্তু ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের প্রাক্তন প্রধান, কে কস্তুরিরঙ্গনের পাবলিক অ্যাফেয়ার রিপোর্টের কথা কোনও পত্রিকা লিখলই না। লিখলে বিজ্ঞাপণ পাওয়া যায় না। আর কে না জানে এই মুহূর্তে বিজ্ঞাপণ এবং মালিকের ইশারায় চলছে গোদী মিডিয়া। কিসের স্মার্ট সিটি?
নরেন্দ্র মোদী বললেন বধাই হো, অমিত শাহ বললেন শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী আর হয়ে গেলো? সব নোংরা কার্পেটের তলায়, লাশের পচা গন্ধের ওপর অগরু সুগন্ধি ঢেলে শবসাধনা? কিসের স্মার্ট সিটি? যোগীজির শহর গোরখপুর থেকে বেনারস, নরেন্দ্র মোদিজির কন্সটিচুয়েন্সি ১৯৫ কিলোমিটার যেতে কম করে ৮/৯ ঘন্টা সময় লাগে, স্মার্ট সিটি? সাধারণ মানুষ ছেড়ে দিন, সাংবাদিক, প্রতিপত্তিশালী মানুষজনের কথাও বাদ দিলাম, বিজেপি – আরএসএসের ক্যাডার, অক্সিজেনের অভাবে তাঁর মা মারা যাচ্ছেন, তিনি অসহায়ের মত টুইট করে যাচ্ছেন, আমরা দেখিনি? আমরা দেখিনি সেই ছবি? নদীর চরে অগুনতি লাশের ছবি? দানিশ সিদ্দিকির তোলা সেই ছবি, আমরা দেখিনি? হলুদ কাপড় দিয়ে ঢাকা লাশের ছবি? আমরা ভিডিও দেখিনি নদীর জলে লাশ ভাসছে? শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে? দেখিনি? স্মার্ট সিটি? আমরা দেখিনি ব্রিজের ওপর থেকে নদীর জলে লাশ ফেলে দেওয়া হচ্ছে? হাসপাতালের বাইরে রাস্তার ধারে রোগী মরে পড়ে আছে, দেখিনি? নির্বাচন আসছে আর ঘন্টা বাজানো শুরু হয়ে গেলো? কারণ যোগীজী জানেন, মোদিজি জানেন, অমিত শাহও ভাল করেই জানেন, কেবল জেতা নয়, কোনওক্রমে জেতা নয়, বিরাটভাবেই জিততে হবে বিজেপিকে। তা না হলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের হিসেব বিগড়ে যাবে, এবং ২০২৪ তো আছেই। তাই নতুন পুরস্কার ঘোষণা করে, যোগীজির হাতে তুলে দেওয়া হল, স্মার্ট সিটির পুরস্কার। দেশের উন্নয়নের সবকটা প্যারামিটারসে পিছিয়ে থাকা, উত্তরপ্রদেশকে তো স্বাস্থ্যের জন্য পুরস্কার দেওয়া যাবে না, এমন নয় যে প্রচুর চাকরি পেয়েছে ওই রাজ্যের বেকাররা, সেই তালিকাতেও অনেক অনেক নীচে, শিল্প উৎপাদনে বিরাট কিছু হয়েছে? না তাও নয়। তাহলে? স্মার্ট সিটি বানিয়ে দেওয়া হল, স্মার্ট রাজ্য। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সাত সকালে গোরুকে ঘাস খাইয়ে দিনের শুরুয়াত করেন, নীচু জাতির কারোর বাড়িতে গেলে বাসন আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই যোগীজির নেতৃত্বে স্মার্ট রাজ্য, স্মার্ট উত্তর প্রদেশ। ক্ষমতায় এসেই বলেছিলেন, গুন্ডাগর্দি শেষ করবেন, বাহুবলীরা কেউ টিঁকবে না।
সত্যিই হয়েছে, সেদিনের বাহুবলীরা প্রায় কেউই নেই, কিন্তু নতুন বাহুবলী তৈরি হয়েছে, অল্ট নিউজ অ্যানালিসিস বলছে সারা দেশের মধ্যে কাস্টডি ডেথ, হাজতের মধ্যে মৃত্যু উত্তরপ্রদেশে সবথেকে বেশী, মানে ধরে হাজতে পুরে পিটিয়ে মেরে ফেলো, মধ্যযুগীয় বিচারব্যবস্থা। এমন কি হাজতে ধর্ষণের মামলাতেও উত্তরপ্রদেশ সবথেকে স্মার্ট, রক্ষকই সেখানে ভক্ষক, কোনও নিয়ম না মেনে মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সন্ধ্যের পরে, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী যা করা যায় না, তবুও করা হয়েছে। তারপর তাঁকে দলবদ্ধ ভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। ৩/৪ দিন পর নতুন জামা কাপড় পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমনকি মেডিক্যাল টেস্টেও কোনও প্রমাণ নেই। কি স্মার্ট রাজ্য? কী স্মার্ট পুলিশ? পণ সংক্রান্ত মামলা সবচেয়ে বেশি, শুধু তাই নয়, উত্তর প্রদেশে ডাওরি ডেথ, পণ না পেয়ে হত্যাও সবথেকে বেশি। একই জেলার, একই জায়গা থেকে দলিত, অনুসূচিত জাতির মেয়েদের দলবদ্ধ ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হল, ধর্ষণ তো বটেই, কিন্তু ধর্ষককে নিয়ে সেখানকার বিজেপি দলের নেতারা মিছিল করছেন, এমনটা এর আগে কখনও দেখা যায়নি, দেখা যায়নি, ধর্ষণের অভিযোগের পরে ধৃত অভিযুক্তরা বেল পাবার পরে, ধর্ষিতা বালিকার বাবাকে প্রকাশ্যে খুন করছে! এক কথায় জঙ্গলের রাজত্ব চলছে বললে কম বলা হয়। সেই রাজ্যকে দেওয়া হল স্মার্ট রাজ্যের তকমা, আর সেই জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন বধাই হো?
আর দৈনিক ভাস্কর যে পত্রিকা সাহস করে ওই স্মার্ট রাজ্যের নদীতে লাশ ভাসার ছবি ছাপিয়েছিল, তাদের দফতরে দফতরে ইডি চলে গেলো? আসলে আদিত্যনাথ যোগী এই মুখ্যমন্ত্রী সাড়ে পাঁচ বছরে এমন কিছুই করে উঠতে পারেননি, যা নিয়ে রাজ্যের মানুষের সামনে যাওয়া যায়, প্রথমত তিনিও মোদিজির স্টাইলে, গোটা মন্ত্রিসভাকে অচল করে নিজেই কাজ করতে ভালবাসেন। তাঁর ভরসা কিছু পেটোয়া আমলাদের ওপর আর পুলিশ কর্তাদের ওপর। তাঁদের নিয়েই তাঁর প্রশাসন চলছে, তার ছবি পাবলিক অ্যাফেয়ার ইনডেক্সে পরিস্কার, বড় রাজ্যগুলোর সবথেকে ওপরে রয়েছে অন্ধ্র প্রদেশ, তারপর কেরল, তারপর ছত্তিশগড়, তারপর পশ্চিমবঙ্গ, তালিকার একদম তলায় জায়গা হয়েছে উত্তর প্রদেশের। অন্যদলের নয়, বিজেপির এমএলএ, বাইরিয়া বিধানসভার বিজেপি এমএলএ সুরেন্দ্র সিং, সাংবাদিক বৈঠক ডেকে জানালেন, আমলাদের নিয়ে কোভিড সামলানো যায় না। মুখ্যমন্ত্রী এই অবস্থা সামলানোর জন্য যা যা করার তা করেননি, সাধারণ মানুষ তো বাদই দিলাম, এমন কি বিধায়করা পর্যন্ত চিকিৎসা পাচ্ছে না। এগুলো কি মোদি – শাহ জানেন না? আলবত জানেন, জানেন বলেই কিছুদিন আগেই কথা হয়েছিল, এবার নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ পালটে যাবে, মোদিজি তাঁর বিশ্বস্ত গুজরাট ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত আইএএস এ কে শর্মা, এতদিন মোদিজির বেনারস সংসদীয় এলাকা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁকে তুলে আনা হল। মুখোমুখি লড়াই অবধারিত ছিল, কিন্তু যোগিজি তার আগেই বুঝিয়ে দিলেন, তিনি এসব মেনে নেবেন না। আর এই মুহূর্তে যোগীকে বাদ দিয়ে বিজেপি উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে নামবে, তেমন অবস্থাও নেই, যারফলে মোদি শাহকে ঢোঁক গিলতে হল। এ কে শর্মাকে কেবল দলের সহ সভাপতি করা হল। যাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারেও গেলেন না আদিত্যনাথ যোগী। তিনি তৈরি আরও বড়, আরও খোলাখুলি হিন্দুত্বর অ্যাজেন্ডা নিয়ে। তিনি আরও উগ্র হতে জানেন। তিনি আরও সরাসরি সআম্প্রদায়িক কথা বলতে জানেন। জানেন বলেই তিনি কেবল উত্তরপ্রদেশেই আবদ্ধ থাকতেও চান না। তাঁর নজরে দিল্লির মসনদ। এটাও ঘটনা, এবার যদি আবার আগের মতন বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসেন আদিত্যনাথ যোগী, তাহলে ২০২৪ না হলেও ২০২৯ এ উনিই হবেন গদির দাবিদার, কাছাকাছি মানুষের কাছ থেকে শোনা, উনি নাকি হাসতে হাসতেই বলেন, কেবল তন্দুরস্তির ওপর জোর দিলেই চলবে, আর কিচ্ছু না করলেও তিনিই বসবেন দিল্লির গদিতে। মানে বয়স বাড়তে থাকা মোদিজি আর মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়া অমিত শাহের উল্টোদিকে, ক্রিজে টিঁকে থাকাটাই তাঁর আপাতত স্ট্রাটেজি। আচ্ছা এটা কি মোদি শাহ জানেন না? আলবত জানেন, কিন্তু তাঁরা এটাও জানেন যে তাঁরা বাঘের পিঠে সওয়ারি করছেন। মাঝপথে নামতে গেলে বাঘেই সাবড়ে দেবে, অতএব বধাই হো বধাই হো বলে নেত্য করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
ইউপির মানুষ ক্ষুব্ধ, ক্রাইম বাড়ছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সাধারণভাবে এই অবস্থায় রাজ্যের ক্ষমতাশীন দলের হেরে যাবারই কথা, একমাত্র বাঁচোয়া, রাজ্যের বিভক্ত বিরোধী শিবির আর তাদের ভোট কাটাকাটি। বিএসপি কী চাইছে কেউ জানে না, তাদেরকে যোগীজি কতটা কাজে লাগাতে পারবেন কেউ জানে না। কিন্তু বিএসপিকে বাদ দিলেও যে বিরাট বিরোধী ভোট, তা যদি এক জায়গায় আসে, কৃষক আন্দোলনের ফলে গতবারের পাওয়া জাঠ ভোট, যদি বিজেপির কাছ থাকে চলে যায়, তাহলে ছবি পাল্টাবেই। এটা মাথায় রেখেই স্মার্ট রাজ্যের পুরস্কার করেই ক্ষান্ত হলেন না মোদীজি, মঙ্গলবার উজ্জ্বলা যোজনা ২ এর ঘোষণা করলেন। উত্তর প্রদেশের নাহোবা থেকে, পাশে বসালেন ফ্রাঙ্কেস্টাইন আদিত্যনাথ যোগীকে।