এই চরম দুর্দিনেও বঙ্গ সিপিএম একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার পরে এই প্রথম বঙ্গ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক করা হল কোনও সংখ্যালঘু মুখকে। বঙ্গ সিপিএম শুধু ব্যানার্জি, চ্যাটার্জিদের পার্টি, এই প্রচার থেকে বেরিয়ে এল তারা প্রায় সাড়ে ছয় দশক পরে। অনেক ভাষায় বলিয়ে কইয়ে, তুখোড় বক্তা, স্মার্ট, ঝকঝকে সেলিম রাজ্য পার্টিকে কতটা ঘুরে দাঁড় করাতে পারবেন, সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে বঙ্গ সিপিএমের বৃদ্ধতন্ত্রে একটা ঝাকুনি তো লাগল। নতুন রাজ্য কমিটিতে অনেক তরুণ মুখকেও আনা হয়েছে এবার। কেন তরুণদের নেতৃত্বে তুলে আনা হচ্ছে না, তা নিয়ে দলের ভিতরে বাইরে বিস্তর কথা হচ্ছিল বহু বছর ধরে।
এই প্রসঙ্গেই আর একটি বিষয় নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে দেশের রাজনৈতিক মহলে। মাত্র সাড়ে ছয় দশকের পার্টি সিপিএম যখন বাংলায় নেতৃত্ব বদলের ঝুঁকি নিতে পারল, তখন প্রায় দেড়শো বছরের প্রাচীন দল কংগ্রেস কেন সেই ঝুঁকি নিতে পারছে না, প্রশ্ন উঠেছে তাই নিয়ে। বাংলার সিপিএম বহু বছর ধরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নেক নজরে ছিল। একটা সময় তো কেন্দ্রীয় কমিটি কিংবা পলিট ব্যুরোতে শেষ কথা বলতেন বাংলার সিপিএম নেতারা। তখন ছিল জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতির্ময় বসুদের সময়। সেটা ছিল সিপিএমের স্বর্ণযুগ।
সে যাক। অতীত খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। বরং একটু কথা হোক প্রায় দেড়শো বছর হতে চলা কংগ্রেস দলটাকে নিয়ে। এই দলটা যে এখন কোন পথে চলছে বা চলতে চায়, সেটাই বোঝা দুষ্কর। পাঁচ রাজ্যের সাম্প্রতিক ভোটে সোনিয়া গান্ধীর দল একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তার পরেও দলের ওয়ার্কিং কমিটি সোনিয়া তথা গান্ধী পরিবারের উপরেই আস্থা রেখেছে। গত রবিবার ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ঠিক হয়েছে, দলের সাংগঠনিক নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সোনিয়া গান্ধীই সভানেত্রী থাকবেন।
ওই বৈঠকের শুরুতেই সোনিয়া গান্ধী আবেগমথিত ভাষায় বলেছেন, দল চাইলে তাঁরা (সোনিয়া, রাহুল, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী) এখনই নেতৃত্ব থেকে ইস্তফা দিতে রাজি। তবে সেদিন আর কোনও নেতা সাহস করে বলেননি, ঠিক আছে। আপনারা ইস্তফা দিন। এমনকী জি২৩ গোষ্ঠীর বিক্ষুব্ধ কোনও নেতাও তখন গান্ধী পরিবারের ইস্তফা চাননি।
বিক্ষুব্ধ কেউ কেউ মুখ খুলেছেন তার পরে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট আইনজীবী কপিল সিব্বল ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পরের দিন এক সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে গান্ধী পরিবারের ইস্তফা দাবি করে বলেছেন, নতুনদের নেতৃত্বের সুযোগ দেওয়া উচিত। কপিল সিব্বল রাহুল গান্ধীরও তীব্র সমালোচনা করেছেন।
কে এই কপিল সিব্বল? মনমোহন জমানায় তিনি মন্ত্রী ছিলেন। আইনজীবী হিসেবে খুব নামডাক। কিন্তু তিনি কোনও দিনই সাংগঠনিক নেতা নন। তৃণমূলের সঙ্গে যখন কংগ্রেসের সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত, তখনও তিনি তৃণমূলের হয়ে একাধিক মামলা লড়ে কংগ্রেস নেতাদের বিরাগভাজন হয়েছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে দলের অন্দরে।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরেই কংগ্রেসে নেতৃত্ব বদলের দাবি উঠেছিল। তখন সভাপতি ছিলেন রাহুল গান্ধী। পরাজয়ের দায় মাথায় নিয়ে তিনি ইস্তফা দিলেন। তখন থেকেই কংগ্রেসে কোনও স্থায়ী সভাপতি নেই। দলীয় নেতৃত্বের চাপে বা অনুরোধে শেষ পর্যন্ত সোনিয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সভানেত্রী হন। তিনি জানান, স্থায়ী সভাপতি নির্বাচন হলে দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। তারপর গত তিন বছরে যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। রাহুলকে বহুবার সভাপতি হতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
২০২০ সালে দলের ২৩ জন বিক্ষুব্ধ নেতা সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখে নেতৃত্ব বদলের দাবি জানান। তখন থেকেই এই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী রাজনৈতিক মহলে জি ২৩ বলে পরিচিত। সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের ভোটে ভরাডুবির পর আবার নড়েচড়ে বসেছে জি ২৩ গোষ্ঠী। গত দুই তিন দিনের মধ্যে বিক্ষুব্ধ নেতারা কয়েক দফা বৈঠকও করলেন। এই গোষ্ঠীতে এবার গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ শশী থারুর, ভুপেন্দ্র সিং হুডার মতো নেতাদেরও দেখা যাচ্ছে। নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন গান্ধী পরিবারের আর এক কাছের লোক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমও। বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ, রাহুল গান্ধী দলের সভাপতি না হলেও পিছন থেকে তিনিই কংগ্রেসটাকে চালাচ্ছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে দিয়ে।
বিক্ষুব্ধদের বিদ্রোহ কত দূর গড়াবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের কৌতূহল রয়েছে। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে বলছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসমুক্ত ভারতের কথা বলে আসছিলেন। এখন কংগ্রেসের যা হাল, তাতে বোধ হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সেই স্বপ্নই পূরণ হতে চলেছে কংগ্রেসের নিজের দোষে।
চলতি বছরের শেষে এবং আগামী বছরের শুরুতে আরও বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোট। তার পরে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট। আগামী দুই বছরের মধ্যে কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তো? সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। দলের বিক্ষুব্ধদের সোনিয়া কী বার্তা দেন, সেটাও দেখার। এপ্রিল মাস থেকে কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু। শেষ হতে সেই সেপ্টেম্বর মাস। সভাপতি পদে গান্ধী পরিবারের বদলে অন্য কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন। দলের অন্দরে সংকট ক্রমশ বাড়ছে। তা কেমন করে সামাল দেবেন সোনিয়া, তা বলবে ভবিষ্যৎ।