এখনও হাতে দু বছরেরও বেশি সময় আছে মোদি সরকারের। কিন্তু কি দিল্লি, কি চেন্নাই, কি কলকাতা, দেশ জুড়েই একটা আলোচনা চলছে, নরেন্দ্র ভাই দামোদর দাস মোদি কি ক্ষমতায় ফিরবেন? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ থেকে সাংবাদিক, কলামনিস্ট, রাজনৈতিক নেতারা এই আলোচনা করছেন, বিভিন্ন মতামত আসছে। প্রশ্ন তিনটে। এক, নরেন্দ্র মোদিকে আদৌ হারানো যাবে? দুই, কিভাবে তাঁকে হারানো যাবে? তিন, তাঁকে সরিয়ে কে আসবে? কিছু আলোচনায় এরকম বলা হচ্ছে যে, নরেন্দ্র মোদিকে হারানো অসম্ভব, তাঁর ক্যারিশ্মা, তাঁর সংগঠন, তাঁর দলের কাছে বিপুল অর্থের যোগান এবং টিনা ফ্যাক্টর, দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ, এই সব মিলিয়ে তিনি অজেয়, তাঁকে হারানো যাবে না। তাহলে, পরের দুটো প্রশ্নের উত্তর দেবার দায় রইল না। কিন্তু যে দেশে আপাত গণতন্ত্রও আছে, নির্বাচন হয়, কিছুটা হলেও সংবাদ মাধ্যম, বিচার বিভাগের অস্তিত্ব আছে, সেই দেশগুলোতে মাঝে মধ্যেই এরকম নেতার জন্ম হয়েছে, এমন দল ক্ষমতায় এসেছে, যখন মনে হয়েছে, দূর, একে হারানো যায় নাকি?
সেই শোলের ডায়ালগ, গব্বর কো সিরফ আউর সিরফ গব্বর হি হরা সকতা হ্যায়। বেশি দূর যেতে হবে না, ইন্দিরা গান্ধীর কথাই ভাবুন না, কোথায় বিরোধীরা? বিরোধী দলই বা কোথায়? ১৯৭৭ এর ভোটের আগে কেউ ভেবেছিল? ইন্দিরা গান্ধী ওরকম ভাবে হারবেন? বা ধরুন রাজীব গান্ধী? ৪০০ র ওপরে সাংসদ, দেশে প্রথমবার ওই ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, অনেকেই ভেবেছিল, ৪০০ হবে না, আরও ১০০টা আসন হারাবেন, ঠিক আছে ১৫০টা আসন হারাবেন, তাতেও কোয়ালিশন সরকার করেই নেওয়া যায়, কিন্তু তিনি হারলেন, বিরাট ভাবে হারলেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী? শাইনিং ইন্ডিয়া, মনে আছে? হেরে গেলেন। আমাদের রাজ্যে সিপিএম? ২৩৫ থেকে ৬২? ৫ বছরে ৩৪ বছরের রাজ্যপাট ভেঙে গেল কখন? যখন রাজ্যের মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল জন্ম যাঁদের বাম আমলে, তাঁদের মৃত্যুও হবে বাম আমলেই! কিন্তু খড়কুটোর মত কেবল ভেসে গেল তাই নয়, ১০ বছর পরে তারা বিগ জিরো, এরকম হয়। ট্রাম্পের নির্বাচনের মাস চার পাঁচ আগেও কেউ ভেবেছিল? ট্রাম্প হারবে? বিরাট পরাজয়। এরকম হয়। অতএব মোদিজি অজেয়, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। অন্তত ক্ষমতায় আসার পরে এমন কিছু তিনি করেননি, যা তাঁকে জয় এনে দেবে। বরং উল্টোটা, দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়েছেন, জিডিপি নামছে, বেকারত্ব রেকর্ড ছুঁয়েও থামছে না, নতুন রেকর্ড তৈরি করছে, শিল্পে মন্দা, মূল্যবৃদ্ধি। সব মিলিয়ে একজন প্রশাসক হিসেবে তিনি এমন কিছু করেননি, যা দেখে মানুষ তাঁকে বা তাঁর দলকে ভোট দেবে। তবুও তিনি জিতছেন, অন্তত ২০১৯ এ আগের চেয়েও বড় জয় ছিনিয়ে এনেছেন, যদিও একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, চরম ধর্মীয় মেরুকরণ আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করেই তিনি আবার ক্ষমতায় এসেছেন, বিরোধী দলগুলোর ব্যর্থতার জন্য তিনি ক্ষমতায় এসেছেছিলেন, বিপুল অর্থব্যয় করে, মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁর কাজ দেখে মানুষ ভোট দিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। যে কারণে তিনি টিঁকে আছেন, তা যে কোনওদিন কর্পূরের মত উবে যেতে পারে, আর যাইহোক তিনি অজেয় নন।
প্রথম প্রশ্নের জবাব এটাই, যাঁরা বলছেন তিনি অজেয়, তাঁদের যুক্তিগুলো পরের প্রশ্নের ভিত্তিতেই বলা হয়েছে। পরের প্রশ্নটা কী? বিজেপি বা মোদি শাহকে কী ভাবে হারানো যাবে? কে হারাবেন? মুখটা কোনটা? সত্যিই তো, দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল, যাদের কাছে এখনও ২০%, হ্যাঁ এখনও ২০% ভোট আছে, সেই দলের গত ২ বছর ধরে কোনও স্থায়ী সভাপতি নেই, দলের মধ্যে ঘোষিত বিরোধী গোষ্ঠী কাজ করছে, এখনও তাঁদের রাজনীতি হাইকমান্ড নির্ভর। দিল্লি থেকে রিমোট কন্ট্রোলে রাজনীতি চালানোর চেষ্টা বরকরার, আর হাইকমান্ড কোনজন? সোনিয়া? রাহুল? না প্রিয়াঙ্কা? নাকি তিনজনেই? নাকি দুই এক? কেউ জানে না। আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা, সেই সখা সীতারাম ইয়েচুরি রাহুল গান্ধীর মেন্টর, তাঁর পরামর্শে বাংলায় জোট, নির্বাচনে শূন্য, হাইকমান্ড জানিয়ে দিল, মমতার বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়া হবে না, একজন প্রার্থী দলের টিকিট সিম্বল নিয়ে জানিয়ে দিলেন, তেনার এখন অনেক কাজ, ব্যবসা সামলাতে হবে, সেখানে কংগ্রেস প্রার্থীও দিতে পারল না, কোথায়? অধীর চৌধুরির মুর্শিদাবাদে। পঞ্জাবে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং নিজের জোরে ক্ষমতায় এসেছেন, একবার নয়, দু দু’বার। রাহুল প্রিয়াঙ্কার নব নিযুক্ত পঞ্জাব রাজ্য সভাপতি, একদা বিজেপি সাংসদ, ক্রিকেট প্লেয়ার, টিভি অনুষ্ঠানে হো হো করে হাসা, শায়রী বলা সিদ্ধু পাজি বিজেপির বিরুদ্ধে কম, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং এর বিরুদ্ধে বেশী বলছেন, এবার পঞ্জাব হাত থেকে বের হয়ে যেতেই পারে, অবশ্যই বিজেপি পাবে না। আপ গতবারে ২০% এর মত ভোট পেয়েছিল, এবার ক্ষমতায় আসতেই পারে। রাজস্থানে শচীন পাইলটের কাঁটা এখনও ফুটে আছে, সে সমস্যার কোনও সমাধান এখনও নেই, ছত্তিশগড়ে সমস্যা এতটাই বেড়ে উঠেছে যে দল ভাঙতে পারে, অন্ধ্রপ্রদেশ আর বাংলায় একদা কংগ্রেসী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর জগন রেড্ডির সামনে, খড়কুটোর মত উড়ে গেছে। যে অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে কংগ্রেস সরকার তৈরি করল তেলেঙ্গানা, সেই তেলেঙ্গানাতে কংগ্রেস ধুয়ে মুছে সাফ। কেরালাতে তারা নেই, তামিলনাড়ুতে স্তালিন যা চাইবেন তাই হবে, বিজেপির হাজার মতবিরোধ সত্ত্বেও, কর্ণাটকে তাঁরা দলের বিধায়কদের ধরে রাখতে পারছে না। বিহারে বা ইউপিতে তাঁরা ডিস্ট্যান্ট ফোর, অসমে নির্বাচনের আগে, বদরুদ্দিন আজমলের সঙ্গে আঁতাত হল, হেরে যাবার পর, সে আঁতাত শেষ। কেন আঁতাত হল, তাও জানা নেই, কেন ভাঙল তাও জানা নেই, উত্তর পূর্বাঞ্চলে কংগ্রেসের আপাতত কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু মেজাজ? মেজাজটা জলসাঘরের জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের মত, জমিদারি গেছে, খাজনা আদায় বন্ধ, বিশাল ভগ্নপ্রায় বাড়ির মেইন্ট্যানান্স, দেখরেখ করার পয়সা নেই, মেজাজ আছে। এদিকে ২০% ভোটও আছে। প্রায় সভাপতি, ঠিক সভাপতি নন রাহুল গান্ধী একবার বৈষ্ণো দেবী মন্দিরে যাচ্ছেন, একবার মসজিদে যাচ্ছেন, হিন্দু ভোট পাবার ইচ্ছে, বচাখুচা মুসলমান ভোট যেন না চলে যায়, সেদিকেও নজর আছে। আসলে বাজারে পিছিয়ে পড়া কোনও ব্রান্ডকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হলে, আবার বাজার ধরতে হলে, নিজের খোল নলচে বদলাতে হয়, কেন পিছিয়ে পড়েছে তার অ্যানালিসিস করতে হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রান্ডগুলোর দুর্বলতা খুঁজে বার করতে হয়, নতুন চেহারায় নতুন উদ্যম নিয়ে নামতে হয়, নতুন এলাকার খোঁজ করতে হয়। পুরোনও এলাকাগুলোকে বার ফিরে পাবার চেষ্টা করতে হয়। অথচ দেখুন, গত দু বছর ধরে দলের স্থায়ী সভাপতিই নেই, সারা দেশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই। মোদির সামনে যে চ্যালেঞ্জ তাঁরা ছুড়ে দিতে পারতেন, তার সিকিভাগও দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে যে মঞ্চ তৈরি করতে পারতেন সেদিকেও গা ছাড়া ভাব, যদি হয়ে যায় তো ভাল, না হলেও ভাল, এরকমভাবেই চলছে কংগ্রেস। সামনে উত্তর প্রদেশের নির্বাচন? কংগ্রেস কোথায়? প্রতিদিন একটা কি দুটো জনসভা, বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে মিটিং, মোদির বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই, কোথায়? কংগ্রেসের সমস্যা তো রিজিওনাল দল নয়, বিজেপি। বিজেপিও জানে কংগ্রেসের ভিত যেটুকু আছে, তা যদি ধসিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তার কিছুটা অংশ তো তারাও পাবে। কাজেই কংগ্রেসের টিঁকে থাকতে হলে, বিজেপি বিরোধিতার প্ল্যাটফর্মেই টিঁকে থাকতে হবে, বিজেপি হেরে গেলে, কংগ্রেস আবার তাদের জমি ফিরে পাবে।
কংগ্রেসের মূল ভিত্তি কী ছিল? স্বাধীনতা সংগ্রাম। এখন সেই অতীত ইতিহাস তাদের খুব একটা কাজে লাগবে না, তাদের দ্বিতীয় ভিত্তি ছিল, মুসলিম আর দলিত, ওবিসি ভোট। মুসলিম ভোট বাবরি মসজিদ ঘটনার পর তাদের হাত থেকে চলে গেছে, সেখানে থাবা বসিয়েছে তৃণমূল থেকে সমাজবাদী পার্টি, আর জে ডি, জগন রেড্ডি বা তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রিয় সমিতি। তাদের দলিত ওবিসি ভোট, মণ্ডল কমিশনের পর চলে গেছে সপা, বসপা, আরজেডি, তৃণমূল এমন কি অনেকটা বিজেপির কাছে। অর্থাৎ সমর্থন ভিত্তি চলে গেছে, তাহলে এই ২০% ভোট আসছে কোত্থেকে? তারা দেশের কোন শ্রেণির নাগরিক? এরা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, এরা বিজেপির অগণতান্ত্রিক চেহারার বিরুদ্ধে কথা বলে, এরা দেশের আর্থিক উন্নতি চায়, আধুনিকীকরণ চায়, মুক্ত বাজার চায়, চাকরি চায়, রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের বিকাশ চায়, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম চায়, দুর্নীতি মুক্ত স্বদেশ চায়। এই মানুষজনদের ভিত্তি বাড়াতে হলে, কংগ্রেসের একমাত্র সম্বল বিজেপির প্রতিটা সাম্প্রদায়িক, প্রতিটা অগণতান্ত্রিক আচরণ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা, যে মানুষজন বিজেপির বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছে, তাদের সঙ্গে রাস্তায় থাকা। বৈষ্ণোদেবী মন্দিরে বা কোনও মসজিদে এর উত্তর পাওয়া যাবে না, এটা রাহুল সোনিয়া, কংগ্রেসকে বুঝতে হবে, এবং বুঝতে হবে প্রায়োরিটি, আপ কংগ্রেসের দিল্লি কেড়ে নিয়েছে, তাই আপের সঙ্গে লড়ে যাও, তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ে যাও কারণ তারা বাংলায় তাদেরকে শূন্যে এনে নামিয়েছে। জগন রেড্ডির বিরুদ্ধে লড় কারণ কংগ্রেসের ভিত্তি এখন তাঁর হাতে, এই যদি মনোভাব হয়, তাহলে কংগ্রেসের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব। এবং কংগ্রেসের বর্তমান চেহারা দেখে এরকমটাই মনে হচ্ছে, যা দেখে মনে হতেই পারে যে মোদিজি অজেয়, তাঁকে হারানো যাবে না। কিন্তু এর উত্তর কেবল কংগ্রেসের মধ্যেই লুকিয়ে নেই, আরও অনেক বিষয় আছে, যে কারণে মোদিজিকে ২০২৪ এ গদি থেকে সরে যেতে হতেই পারে, কাল সেইগুলো নিয়েই আলোচনা। আপনারা আপনাদের মতামত দিন, সঙ্গে থাকুন।