আড়াই বছরের একটু বেশি সময় আছে নরেন্দ্র মোদির হাতে, কিন্তু পায়ের তলা থেকে মাটি খসে যাচ্ছে, এমন ছবি উঠে এল, ইন্ডিয়া টুডে’র সার্ভেতে, খুব পরিস্কার সেই ছবি, জনপ্রিয়তা কমছে, কমছে বললে ভুল বলা হবে, হু হু করে কমছে। এই প্রবণতা জারি থাকলে ২০২৪ আবার এক নতুন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মুখে, নিশ্চিত বলা যায়, অন্তত এই সার্ভে তো সেই কথাই বলছে।
অনেকে এই সার্ভের হেডলাইন নিয়েই মত্ত, যেখানে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা যা নাকি অগস্ট ২০২০ তেও ছিল ৬৬%, যা অগস্ট ২০২১, মানে এক বছরের মধ্যে কমে দাঁড়িয়েছে ২৪% এ। মানে এক বিপুল জনপ্রিয়তার শিখর থেকে নরেন্দ্র মোদি নামতে শুরু করেছেন, কতটা নামবেন? জানা নেই, তিনি সামলে নিতে পারবেন কিনা? জানা নেই। কিন্তু এই প্রবণতা জারি থাকলে, ২০২৪ এ প্রধানমন্ত্রী পদ তাঁর হাতে থাকবে না, বলাই বাহুল্য। এর ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন, তাঁর পরে ছিলেন অমিত শাহ, তাঁকে ফেলে এগিয়ে আসছেন, আর এক হিন্দুত্বের পোস্টার বয়, কনফট যোগী আদিত্যনাথ, সে আর এক নতুন বিড়ম্বনা। মোদিজির একমাত্র সান্ত্বনা, বিরোধীরা এখনও ছত্রভঙ্গ, এক জায়গার আসার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু ছবিটা এখনও পরিস্কার নয়। আর এই সার্ভে বলছে, এই মুহূর্তে ভোট হলে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না, তার মানে বিজেপিকে শরিকদলের ওপরে নির্ভরশীল হতে হবে, তার মানে অমিত শাহ – মোদি যে স্টাইলে কাজ করেন, তা আর সম্ভব হবে না।আর ২০১৯ এনডিএ’র ভোট শতাংশ ছিল ৪৫, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ এ, এখনও আড়াই বছর দেরি, আর তিন, চার, পাঁচ শতাংশ কমলে, বিজেপি একলা ২৪০/২৪৫ টা আসন পাবে। শরিক দল মিলিয়েও ম্যাজিক ফিগার ছোঁয়া মুস্কিল হবে। সেখানেও সান্ত্বনা, বিরোধী দলের জোটের ছবি এখনও অধরা।
এই ক’দিন আগে জানুয়ারি মাসে, দেশের ৩০% মানুষ মনে করতেন, মোদি সরকার আউটস্ট্যান্ডিং, দারুণ সরকার চালাচ্ছেন। সেই সংখ্যা এই ছ’মাসে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? ১৬% এ। কতজন বলতেন নরেন্দ্র মোদি ভালই সরকার চালাচ্ছেন? ৪৪ জন, মানে ৪৪%, সেই সংখ্যা নেমে এসে এই অগস্টে দাঁড়িয়েছে ৩৮ জনে, মানে সরকারের কাজ নিয়ে মানুষ ভরসা হারাচ্ছেন। জানুয়ারি মাসে ৫০% মানুষ মনে করছিলেন, মোদি সরকার কোভিড পরিস্থিতি ভালই সামলাচ্ছেন। সেই একই প্রশ্নের জবাবে এই অগস্টে মাত্র৩৬% মানুষ বলেছেন মোদি সরকার কোভিড পরিস্থিতি ভালই চালাচ্ছেন। মানে টিকাকরণ ইত্যাদির প্রতিশ্রুতিতে চিঁড়ে ভিজছে না। আর মাথায় রাখুন, এই সার্ভেও কিন্তু কম করে দেড় মাস আগের তথ্য দিচ্ছে। এখনকার ছবি তার থেকেও মলিন।
অর্থনীতি, যা ছিল ২০১৪ মোদি সরকারের প্রথম প্রতিশ্রুতি, আচ্ছে দিন লায়েঙ্গে। সেই সময়ে জিনিষপত্রের দাম বাড়ছে, পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়ছে। মোদিজি এসে বললেন আচ্ছে দিন লায়েঙ্গে। আর কী বললেন? বললেন কালা ধন ওয়াপস লায়েঙ্গে, ওই ১৫ লক্ষ টাকার কথা না হয় বাদই দিলাম, অমিত শাহ তো বলেই দিয়েছেন ওটা ছিল জুমলা, কথার কথা। কিন্তু এটা তো ঠিক যে মানুষ ২০১৪ তে আচ্ছে দিন, কালা ধন ওয়াপসি ইস্যুতেই ভোট দিয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদি সরকারে বসলেন। আজ সেই অর্থনীতির প্রশ্নে মানুষ কী ভাবছেন? ২৩% মানুষ মনে করেন কোভিড আমাদের সামনে বড় বিপদ, কিন্তু ১৯% মানুষ মনে করেন বাড়তে থাকা জিনিষের দাম, মানে ইনফ্লেশন হল আমাদের সামনে বিরাট বিপদ। ১৭% মানুষ মনে করেন বেকারি হল দেশের মানুষের কাছে বড় বিপদ। আর ৯% মানুষ মনে করেন বাড়তে থাকা তেলের দামের ফলেই আমাদের অর্থনীতির এই হাল। মানে ৪৫% মানুষ মনে করেন যে আচ্ছে দিন দূর অস্ত, যে ৬৬% মানুষ গত জানুয়ারিতেও বলেছেন মোদিজি অর্থনীতি ভাল বা খুব ভালই সামলাচ্ছেন, সেই সংখ্যা ৬৬ থেকে কমে ৪৭ এ এসে দাঁড়িয়েছে। মোদিজি যে আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলতেন, গত জানুয়ারি মাসে দেশের ৪৬% মানুষ তাকে সমর্থন করেছিলেন। আর অগস্টে সেই সমর্থন কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮% এ। ৫৯% মানুষ মনে করছেন বেকারত্ব এক বিরাট বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, জানুয়ারি মাসে ১৭% মানুষ মনে করতেন অর্থনীতি আরও খারাপ হবে। এই অগস্টে ৩২% মানুষ মনে করছেন অর্থনীতির হাল আরও খারাপ হবে। ৪১ শতাংশ মানুষ মনে করতেন অর্থনীতির হাল ফিরবে। এখন মাত্র ২১% মানুষ মনে করছেন সেই কথা। ৪৫% মানুষ মনে করছেন তাঁদের রোজগার বাড়বে না। ৩৪% মানুষ মনে করছেন তাঁদের রোজগার কমবে। তার মানে ৭৯% মানুষ নতুন বাড়ি, গাড়ি, ফ্রিজ, টিভি কিনবেন না। কারণ তাঁরা মনে করছেন হয় তাঁদের আয় একই থাকবে, বাড়বে না, বা কমেও যেতে পারে। জানুয়ারি ২১ এ ৩৫ শতাংশ মানুষ মনে করতেন, সরকার মূল্যবৃদ্ধি কমাতে যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে না। অগস্ট ২১ এ ৬০% মানুষ মনে করছেন সরকার মূল্যবৃদ্ধি রুখতে অক্ষম, এই অগস্টে ২৪% মানুষ মনে করছেন ২০১৪ র তুলনায় তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কমেছে। একই আছে মনে করছেন ৪৮% মানুষ। মাত্র ২৮% মানুষ মনে করছেন তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। এই তো গেলো অর্থনীতির কথা। মানে ওই আচ্ছে দিন এখন এক ধোঁয়াশা, এক কল্পনা মাত্র।
আসা যাক দুর্নীতির প্রশ্নে, কালা ধন ওয়াপস লায়েঙ্গে, না খায়েঙ্গে, না খানে দেঙ্গে ইত্যাদি মোদিজির শ্লোগান ছিল, মানুষ কী ভাবছে? ৪৫% মানুষ মনে করছেন, দুর্নীতি বেড়েছে, ২০% মানুষ মনে করেন দুর্নীতি যা ছিল, তাই আছে। ৬২% মানুষ মনে করেন দলবদলুদের নিজেদের দলে নিয়ে এসে পদ এবং মন্ত্রীত্ব দেওয়াটা ভুল, অন্যায়। জানুয়ারিতে ৫৫% মানুষ মনে করতেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ছে, অগস্টে মাত্র ৩৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ আছে। এই সার্ভে, এক প্রবণতাকে আমাদের সামনে হাজির করছে, যা পরিস্কার বলে দেয় মোদি সরকার তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। তার মূল কারণ হল দেশের অর্থনীতি। অর্থাৎ জঙ্গি জাতীয়তাবাদ, ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে, মন্দির ওঁহি বনে গা জাতীয় শ্লোগানের আকর্ষণ কমছে। কমছে কারণ মন্দির হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে জঙ্গি কথাবার্তা বলার পর চীনের সামনে যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই গোছের কথা বার্তা মানুষ শুনে নিয়েছে, এবং সব থেকে বড় কথা হল, মানুষের পেটে টান পড়েছে। প্রতিদিন বাজারে যাওয়া মানুষ চাল, ডাল, গম, তেল, নুন, চিনি থেকে শাক শব্জিতে হাত দিতে গেলেই আচ্ছে দিনের ভুয়ো শ্লোগানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পেট্রোল ডিজেল থেকে রান্নার গ্যাসে বাড়তে থাকা দাম তাঁর কাছে বাস্তবতা। যে বাস্তবতা বিশাল রামমন্দির দিয়ে ভোলানো যাবে না। তাঁর কাছে বাস্তব হল তাঁর মাসের রোজগার। তাঁর ছেলে মেয়ের চাকরি, তাঁর কাছে অনেক বেশী প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সিলিন্ডার। আচ্ছে দিন যে আসেনি, তা বোঝানোর জন্য কোনও বিরোধী দলনেতার বক্তৃতার প্রয়োজন নেই, মানুষ বুঝতে পারছেন। মানুষ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে এক পয়সার কালাধন, ব্ল্যাক মানি ফেরত তো আসেই নি, উলটে ৪০/৫০ জন গুজরাটি শিল্পপতি, তারমধ্যে অন্তত তিন জন নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত পরিচিত, তাঁরা কোটি কোটি টাকা নিয়ে উড়ে চলে গেছে দেশের বাইরে। না অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, না দুর্নীতি কোনও প্রশ্নেই নরেন্দ্র মোদি আর মসীহা নন, উলটে সময় আসছে জবাব চাইবার।
এটা নরেন্দ্র মোদির কাছে দুঃসংবাদ, এবং এই সার্ভেতেই সুসংবাদও আছে তাঁর জন্য, সুসংবাদ হল বিরোধীরা এখনও ঐক্যবদ্ধ নয়। সুসংবাদ হল এখনও কোনও সর্বসম্মত মুখ নেই তাঁর বিরুদ্ধে, এটাই তাঁর ভরসা। আর ভরসা এখনও আড়াই বছর সময় আছে, পেগাসাস থেকে কৃষক আন্দোলন সামলে, অর্থনীতিকে সামাল দেওয়া দুরূহ কাজ। সেই কাজে নামার চেষ্টায় নমো, নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে, বিরোধীদের কাছেও পরিস্কার যে, ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শক্তির কাছে নস্যির মত উড়ে যাবে এই সরকার। কিন্তু তাদেরও সামনে আনতে হবে এক সর্বসম্মত মুখ। সেটাও একইওভাবে দুরূহ কাজ। ইতিহাস চুপ করে বসে দেখছে, এই মুহূর্তে কারা কোন ভূমিকা পালন করছে। বিরোধীরা এক হতে পারলে, দেশ থেকে ফ্যাসিবাদের বিপদ বিদায় নেবে। যদি তারা সেই কাজ করতে না পারে তাহলে অনিশ্চিত দেশের ভবিষৎ।