গতকাল যে আলোচনা আমরা করছিলাম, সেই আলোচনার রেশ ধরেই আজকের চতুর্থ স্তম্ভ। গতকাল শুরু করেছিলাম এই বলে যে, নরেন্দ্র মোদি কি অপরাজেয়? তাঁকে কি হারানো যাবে না? বলেছিলাম যে এরকম যারা ভাবছেন, তাঁদের মাথায় রাখা দরকার আপাত গণতন্ত্র হলেও প্রবল শক্তিশালী নেতা বা দল হেরে যায়, হঠাৎই তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে তাদের শাসন। এ দৃশ্য আমরা বহুবার দেখেছি, সেই তত্ত্ব অনুযায়ীই নরেন্দ্র মোদিও অজেয় নন। বিশেষ করে তাঁর জমানায় যে অরাজকতা চলছে, তা মাথায় রাখলে তাঁর হেরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি হারছেন না, তাঁর জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমলেও, এখনই হেরে যাবার কোনও লক্ষণ নেই। কারণ, বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের প্রচার, অর্থবল, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো, এবং সবচেয়ে বড় কারণ হল বিরোধী সবচেয়ে বড় দল কংগ্রেস, যাদের এখনও সারা দেশে কিছু না কিছু অস্তিত্ব আছে, ২০% ভোট আছে, তাদের নিষ্ক্রিয়তা। তাহলে?
আসলে সবসময় বাইরে থেকেই সংগঠন ভাঙে, বিরোধী দলের প্রবল চাপে দল ভাঙে তা তো নয়, অনেক সময়েই নিজেদের বহু ভুল আর ঔদ্ধত্য, স্বৈরাচারী মনোভাব, দল নয় দু এক জনের খামখেয়ালে সরকার পড়ে যায়, এ আমরা দেখেছি। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি না করলে, ইতিহাস অন্য চেহারা নিত। রাজীব গান্ধী, বোফর্স নিয়ে ঔদ্ধত্য না দেখালে ক্ষমতা হারাতেন না। সিপিএম, পরমাণবিক চুক্তিকে কেন্দ্র করে সরকারের থেকে সমর্থন না তুললে, টাটাকে জমি দেওয়া নিয়ে একগুঁয়েমি না করলে, অন্তত ধৈর্য্য ধরলে সরকার পড়ত না। ঠিক সেরকম বিজেপি দল বিশেষ করে মোদি, অমিত শাহের একলা দল চালানো, তাদের ঔদ্ধত্য, তাঁদের সীমাহীন স্বৈরাচার তাঁদের পতনের কারণ হতেই পারে। আসুন দেখা যাক, ঠিক এই মুহূর্তে দেখা যাক, বিজেপি দলের চেহারাটা। কোথায় তাঁদের দল পরিচালনা আর নেতাদের খামখেয়ালিপনা, দলের মধ্যে বিক্ষোভ যা দলকে আগামী নির্বাচনে বিরাট বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তার আগে মনে করিয়ে দিই, নরেন্দ্র মোদির উত্থান কাহিনী, কারণ আজকের বিজেপি এক নতুন বিজেপি, এই বিজেপি অটল বিহারী বাজপেয়ীর এমন কি লালকৃষ্ণ আদবানির বিজেপিও নয়, এর চেহারাই আলাদা। সে জমানায় কেন্দ্রে ছিলেন বটে অটল, লালকৃষ্ণ, মুরলি মনোহরের মত নেতারা, কিন্তু রাজ্যের দিকে তাকান, গুজরাটে কেশুভাই প্যাটেল, মহারাষ্ট্রে প্রমোদ মহাজন, ইউপিতে রাজনাথ সিং, কল্যাণ সিং, বাংলায় তপন সিকদার, মধ্যপ্রদেশে উমা ভারতী, শিবরাজ সিং চৌহান, রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, যশবন্ত সিং, বিহারে যশবন্ত সিনহা, হিমাচল প্রদেশে শান্তা কুমার, গোয়ায় মনোহর পারিক্করের মত নেতারা। তাঁরা, তাঁদের রাজ্যে ছিলেন শেষ কথা, বিজেপির জাতীয় সম্মেলন বা চিন্তন বৈঠকে তাঁদের বিরাট ভূমিকা থাকত, দক্ষিণে বিজেপি দুর্বল ছিল, এখনও আছে। এক কর্ণাটকে, ইয়েদুরিয়াপ্পা লিঙ্গায়েত ভোটের সমর্থন নিয়ে, বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও, টিঁকে ছিলেন। আজ? রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার নামে আলাদা মঞ্চ খোলা হয়েছে, সেই ২০২৪ এ নির্বাচন কিন্তু এখন থেকেই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী চাই, শ্লোগান দিয়ে প্রচার শুরু হয়ে গেছে, বিজেপি, অ্যা ডিফারেন্ট পার্টি, তখন ছিল, এখন নেই। মধ্য প্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহানকে নিয়ে বিক্ষোভের ইন্ধন আসছে অমিত শাহের ইঙ্গিতে, এখন থেকেই বলা যায়, মামাজী শিবরাজ সিংয়ের গদি সুনিশ্চিত নয়। বাংলায় এরই মধ্যে দুটো পাওয়ার সেন্টার, দিলীপ ঘোষ আর কাঁথির খোকাবাবু লড়ে যাচ্ছেন, অসমে সর্বানন্দ সোনওয়াল, আদি বিজেপি। তাঁকে বাদ দিয়ে আদতে কংগ্রেসী হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে বসানো হয়েছে। বিহারে আদি বিজেপি সুশীল মোদি কার্যত একঘরে, ওড়িশায় আদতে বিজু জনতা দলের নেতা বৈজয়ন্ত জয় পন্ডা, বিজেপিতে আসার পরে তিনিই নেতা। এবার চলুন গুজরাটে, আনন্দিবেন প্যাটেলকে সরিয়ে বিজয় রূপাণিকে মুখ্যমন্ত্রী করা হল, তাঁর বিরুদ্ধে বিরাট ক্ষোভ, বিভিন্ন অভিযোগ এবং সর্বোপরি আরএসএসের এক সমীক্ষা বলছে, আগামী নির্বাচনে বিজেপি হেরেও যেতে পারে, অতএব তাঁকে সরানো হবে, কিন্তু ওই চেয়ারে বসার উচ্চাশা অনেকের, তার মধ্যে অন্যতম হলেন পাতিদার নেতা নিতিন প্যাটেল, কিন্তু প্রায় আচমকাই সেখানে আর এক প্যাটেলকে বসালেন মোদি – অমিত শাহ, ভূপেন্দ্র প্যাটেল হলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী, নিতিন প্যাটেলের চোখে জল।
কেবল গুজরাটই নয়, গত ৬ মাসে বিজেপি তাদের ৫ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে, এবং তা হয়েছে কেন্দ্র থেকে, মোদি – অমিত শাহের নির্দেশে, কংগ্রেসের হাইকমান্ডের মত চলছে বিজেপি। উত্তরাখন্ডে মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র সিং রাওয়াতকে সরানো হল, এলেন তীরথ সিং রাওয়াত, মাত্র ৬ মাসের মধ্যে, তার ক’দিন আগেই দেবেন্দ্র সিং রাওয়াত মুখ খুলেছিলেন, বলেছিলেন, পার্টি পদত্যাগপত্র চাক, তারপর দেখা যাবে, দেখে নিলেন মোদিজি। এমনিতে বলা হল যে উপনির্বাচন হয়নি বলে সরানো হল, কিন্তু মোদি – শাহের জামানায় এ কথা হাস্যকর, তবে তীরথ সিং রাওয়াতও কি নিশ্চিন্তে আছেন? একদম নয়, তাঁর গদির দিকে নজর অনুরাগ সিং ঠাকুরের, সম্ভবত আগামী নির্বাচনে অনুরাগ সিং ঠাকুরকে মুখ করেই নির্বাচন লড়বে বিজেপি, প্রায় মিউজিকাল চেয়ার। ওধারে অসম, সর্বানন্দ সোনওয়াল নির্বাচন জিতলেন, মুখ্যমন্ত্রী হলেন হিমন্ত বিশ্বকর্মা, এই ক’দিন আগেও যিনি ছিলেন কংগ্রেস নেতা, এটাও হল সেই মোদি – অমিত শাহের নির্দেশে বা ইচ্ছেয়। এরপর দক্ষিণ, দক্ষিণে একমাত্র রাজ্য যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় আছে, সেই কর্ণাটকে মুখ্যমন্ত্রী ইয়াদুরিয়াপ্পাকে সরানো হল, এর আগে বহু দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, বহু ক্ষোভ বিক্ষোভ ছিল, কিন্তু তাঁকে দিয়ে কংগ্রেস দেবেগৌড়ার সরকার ভাঙিয়ে, নতুন সরকার তৈরি হল ইয়েদুরিয়াপ্পার নেতৃত্বে, সে বিরাট নাটক। সেই ইয়েদুরিয়াপ্পার কাজ শেষ, তাঁকে সরিয়ে জনতা দল নেতা এস আর বোম্মাইয়ের ছেলে বি আর বোম্মাই, যিনি নিজেও ক’দিন আগে জনতা দলেরই বিধায়ক ছিলেন, তাঁকে বসানো হল, একমাত্র কারণ বোম্মাই লিঙ্গায়েত। আর সবশেষে পাঁচ নম্বরে বিজয় রূপাণি, তাঁকেও সরানো হল। এই যে রাজ্যে রাজ্যে পরিবর্তন, তা কিন্তু সরাসরি মোদি – শাহের নির্দেশেই হচ্ছে,। কেন মোদি শাহ বলছি? মোদিজি তাঁর উত্তরাধিকার দিয়ে যেতে চান অমিত শাহের হাতে, এই ক’বছর আগে পর্যন্ত সেটা ছিল পরিস্কার, নরেন্দ্র মোদির পর কে? অমিত শাহ। কিন্তু ২০১৭ তে ওই তেনারাই উত্তরপ্রদেশের গদিতে বসালেন যোগী আদিত্যনাথকে, বুঝতেই পারেননি যে এই যোগীর উচ্চাকাংখ্যাটা কোন লেভেলের, অটল বিহারী বা লালকৃষ্ণ আদবানির থেকে নরেন্দ্র মোদী, অনেক বেশি হিন্দুত্বের কথা বলেছেন, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিতে তিনি অনেক এগিয়ে। সেই গোধরার সময় অটলবিহারী বাজপেয়ী সেটা বুঝেছিলেন, কিন্তু তখন আদবানির প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন মোদি, এবং কিছুদিন পরে সেই আদবানিকে একঘরে করে তখনকার হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী নরেন্দ্র ভাই, একছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলেন, সঙ্গে নিলেন অমিত শাহ কে। দল তাঁর ওই হিন্দুত্বের ঝান্ডা ধরে, উগ্র জাতীয়তাবাদের কথা বলে, নির্বাচনের পর নির্বাচন জিতছে, তাই তাঁদের চ্যালেঞ্জ করার কেউ ছিল না। এখন সেই হিন্দুত্বের পোস্টার বয় মোদিজি নন, এসে গেছে নতুন, আরও তীব্র হিন্দুত্বের, আরও ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাস্তা খুঁজে নিয়েছেন, গোরখপুরের আদিত্যনাথ যোগী। যিনি প্রকাশ্যেই বাবরের বাচ্চাদের এদেশ থেকে তাড়ানোর শপথের কথা জনসভাতেই বলেন, যাঁর কথায় উদ্বেল হয় তথাকথিত হিন্দু সমাজ, মোদিজি কখনও সখনও গেরুয়া বসন পরেন, ইনি গেরুয়া ধারী। সেই কারণেই যতই মতবিরোধ হোক, যোগীজিকে সরানো গেলনা, ব্রাহ্মণ নেতা জিতিন প্রসাদকে এনে সাইডলাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছে, যোগীজিকে গিলতেও পারছেন না, উগরাতেও পারছেন না, মোদি – শাহ। এই দ্বন্দ্ব কোথায় কোন চেহারা নেয় সেটা দেখার। উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে যোগীজি হেরে গেলে, নরেন্দ্র মোদীর বিদায় সুনিশ্চিত, জিতে গেলে এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হবে মোদিজিকে, রাজনীতি এভাবেই ঘোরে, সেদিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছিলেন মোদিজি, কিন্তু তখনও বিজেপি দলে কিছুটা হলেও গণতন্ত্র ছিল, রাজ্যের নেতাদের হাতে ক্ষমতা ছিল, এখন বিজেপি কংগ্রেসের হাইকমান্ড কায়দা রপ্ত করেছে, পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের দিকে নজর রেখে, বা কিছুটা হলেও অপছন্দের নেতাদের সরিয়ে দিতে পেরেছেন মোদি – শাহ। কিন্তু ইউ পি? যোগীজিকে সরানো অসম্ভব, না মুমকিন। দলের মোদি – শাহ বিরোধী নেতারা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন? না, তাঁরাও নতুন ক্ষমতা কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মেলাবেন, কতটা? কি ভাবে? কখন? সেটা আগামী কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্কার হবে। তার মানে, বিজেপির সংগঠন আর দল পরিচালনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার ধ্বংসের বীজ, সময় যে বীজকে অঙ্কুরিত করবে। কিন্তু তা কি এমনি এমনিই হবে? নাকি আরও কোনো কারণ আছে, যা ওই পতনকে ত্বরান্বিত করবে? তা নিয়ে আলোচনা কাল, আজ এই পর্যন্তই, মতামত দিন, সঙ্গে থাকুন।