আজকের আলোচনা দল, আদর্শ আর দলবদল নিয়ে। কোনও শব্দই অজর অমর অক্ষয় নয়, যেমন একই থাকে না কোনও রীতিনীতি, চালচলন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব পালটে যায়। আমার আপনার ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবেই বদলে যায় সমাজ। চোখের সামনে কাল যা পাহাড়ের মত অটল মনে হত, সেই ধারণা বদলে যায়, পাখির পালকের মত ভেসে যায়। প্রশ্ন করে লাভ নেই, এসব বদল মেনে নেবো কিনা? প্রশ্ন করে লাভ নেই এসব বদল দেশ সমাজের জন্য ভাল না মন্দ? মহাকালের রথের রশি চলতে থাকে ঘর্ঘর, ঘর্ঘর। আপনি মানলেও বা কি, না মানলেও বা কি এসে যায়। সে বদলের ইতিহাস তো আমাদের চোখের সামনে।
ক’দিন আগেই দেখা হলে বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম, সমবয়স্কদের আলিঙ্গন, কনিষ্ঠদের চুম্বন, এই কি ছিল না আমাদের রীতি? আজ দো গজ কি দুরি, বহত জরুরি। হঠাৎ রাস্তায় অফিস অঞ্চলে, হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে, বন্ধু কি খবর বল? কত দিন দেখা হয়নি? তারপর জাদু কি ঝাপ্পি, মৌন কিন্তু কত স্মৃতির আনাগোনা, কত প্রশ্ন আর না বলা উত্তর। কিন্তু আজ মুখে মাস্ক, দো গজ কি দুরি আর চোখে ভয়, সে বন্ধু করোনার সংক্রমণ নিয়ে আসছে না তো? মাইকেল আর গিরীশ মদ খেতেন, তথাকথিত শাস্ত্রে নিষিদ্ধ মাংসও খেয়েছেন মাইকেল। তাই নিয়ে ছিছিক্কার ছিল সুতানুটি, কলিকাতা আর ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর জুড়ে। আজ? স্যাটারডে নাইটে, কোন রঙিন পানীয়ের কত আয়োজন তা লিখে আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রকাশ্যেই, এটাই নিও নর্মাল। রাজনীতি? তার চেহারার আমূল পরিবর্তনও কি হয়নি?
কংগ্রেসি নেতাদের গায়ে খদ্দের, মাথায় গান্ধী টুপি আজ আরামদায়ক খদ্দেরেই টিঁকে আছে। কিন্তু সে খদ্দেরের দখল নিয়েছে, সেদিন খদ্দর নিয়ে হাসাহাসি করা আরএসএসও, তাদের হাফ প্যান্ট এখন ফুলপ্যান্ট। কমিউনিস্টদের খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর কাঁধে ঝোলাব্যাগ? কোথায় তাঁরা? হাতে আইফোন, আইপ্যাড, কবজিতে অ্যাপেল ওয়াচ, আমরা তো দেখেছি। কেবল পোষাক নয়,আসুন আদর্শ নিয়েও ক’টা কথা বলা যাক।
পুরনো স্বাধীনতা, দেশহিতৈষী নয়, কিছুদিন আগে গণশক্তিতেও কংগ্রেসকে দক্ষিণপন্থী বলা হত। দক্ষিণপন্থীদের দালাল বলা হত সিপিআইকে? এখন সেই দক্ষিণপন্থীদের নেতা রাহুল গান্ধীর মেন্টর সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিএমেরর সাধারণ সম্পাদক। কংগ্রেস এখন নাকি মধ্যপন্থী, বিজেপি হল সাচ্চা দক্ষিণপন্থী। কী করে হল? কবে হল? কোন সমাজ বা রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের ফলে কংগ্রেসের গা থেকে দক্ষিণপন্থা খসে গেলো? কেউ জানে না, আমরা তো জানিই না। ক’দিন আগে, কংগ্রেসকে হঠানোর জন্য মধ্যে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং সরকারের দুটো ক্রাচ ছিল, বিজেপি আর বাম, সে ছবি আমরা দেখেছি, হাত ধরাধরি করে দেশ থেকে হাত তাড়ানোর আয়োজন, তাহলে আদর্শ? সংসদীয় রাজনীতে প্রথম আর প্রধান বিবেচ্য হল ক্ষমতা। সুব্রত মুখোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ক্ষমতা ছাড়া রাজনীতি হয় নাকি? রাজনীতির প্রথম বিবেচ্য বিষয় হল ক্ষমতা, তিনি সেবার সবে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে গেছেন, সোজা কথা বলতে ভালবাসেন, বলেছিলেন। কংগ্রেসের বিরোধিতায় বিজেপির হাত ধরা যায়, বিজেপির বিরোধিতায় কংগ্রেসের হাত ধরা যায়, দেশের সবচেয়ে নীতিনিষ্ঠ দল সিপিএম যদি এটা করতে পারে, তাহলে বাকিদের নিয়ে আলোচনা করেই বা কি হবে?
কপিল শর্মা, দিল্লির আপ নেতা ছিলেন, তুখোড় বক্তা, সেকুলারিজমের হদ্দমুদ্দ করে ছাড়তেন, এক বক্তৃতায় অনুপম খেরের মত বক্তাকে কাৎ করে ফেলেছিলেন। সেই তিনি বিজেপিতে গেছেন, দিল্লির নির্বাচনের সময়, শাহীনবাগ নিয়ে তাঁর কদর্য মন্তব্য আমাদের জানা আছে। জানা আছে মাত্র গত নির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয় কী বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোন ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন, তারপর চোখের সামনে তার দলবদল, এবং তার ব্যাখ্যা, সত্যিইতো অপারচুনিটি গ্রহণ করতে হয়। ফুটবল টিমে খেলতে নেমে সাইড লাইনে বসে থাকার চেয়ে, ১১ জনের মধ্যে থাকা ভাল, ছোট টিম হলেও ভাল, তাঁর যুক্তি। কেরালা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক জি রেথিকুমার, গত বুধবার সিপিএমে যোগ দিয়েছেন, তার ক’দিন আগেই, আরেকজন কংগ্রেসেরই প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, কে পি অনিলকুমার সিপিএমে যোগ দিয়েছেন। সিপিএম রাজ্য নেতা জানিয়েছেন, সবে তো শুরু, আরও আসবেন।
কাগজে কলমে এখনও কংগ্রেস দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতি, অবশিষ্ট সামন্তদের প্রতিনিধি, হ্যাঁ সিপিএম এরকমটাই মনে করে, তাতে কী? রাজনীতি মানে ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতা ধরে রাখা। কেরালা সিপিএম যেনতেন প্রকারেন তাদের গড় রক্ষা করছে। আদর্শ বদলে গেছে সময়ের ফেরে। সমাজতন্ত্রের আদর্শ, উদার অর্থনীতি, খোলা, মুক্তকচ্ছ বাজারের হাত ধরে চলতে পারে? পারে না, কিন্তু কংগ্রেস সিপিএম হাত ধরেই চলছে, এমনি এমনি নয়, কারণ আছে। বিজেপি আরএসএস পরিচালিত হিন্দুত্ববাদী দল, তারা প্রায় প্রতিদিনই পুষ্ট হচ্ছে কংগ্রেসের নেতাদের ভাঙিয়ে। তাকিয়ে দেখুন তলার সারি নয়, বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রাক্তন কংগ্রেসী বা জনতা দলের, যদি আদর্শের কথা ওঠে, তাহলে আকাশ পাতালের ফারাক, কিন্তু তারা দল ভাঙাচ্ছে, কেন? নিশ্চই কারণ আছে। বাকিরা কি চুপ করে বসে আছে, এতদিন পঞ্জাবে অমরিন্দর সিংয়ের প্রবল বিরোধী আপ এখন জল মাপছে। অমরিন্দর সিং যদি আলাদা দল তৈরি করে তাদের সঙ্গে হাত মেলায়? তারা হাত ধরবে না? ধরবে বৈকি, কেন ধরবে না? চাই তো ক্ষমতা, আর ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং হতেই পারেন সেই ঘোড়া, যার পিঠে সওয়ার হয়ে ক্ষমতার শিখরে পৌঁছন যায়। বিজেপি? তারও কি নজর নেই? আছে। রামবিলাস পাশওয়ানের দল ভেঙেছে, আরজেডি থেকে বিজেপিতে গেছে, এসপি থেকে বিজেপিতে গেছে, বিএসপি থেকে এসপিতে গেছে, কোনও জটিলতা নেই। রাজনীতিতে আদর্শ স্থায়ী নয়, তার পরিবর্তন চলতেই থাকে। তৃণমূল কি সেই খেলা থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখবে? রাখে নি। মুকুল রায়ের ঘর ওয়াপসি হয়েছে, বাবুল সুপ্রিয় এলেন, কংগ্রেস থেকে সুস্মিতা দেব, আরও আসবেন। কিছু যাবেন, তবে যাবার স্রোতে ভাটা পড়েছে। রাজ্য শুদ্ধু ছোট বড়, মাঝারি নেতা, কর্মী বিজেপি থেকে, সিপিএম থেকে, কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসছেন।
ক’দিন আগেই ছবিটা অন্য ছিল, তখন রোজ মনে হচ্ছিল আজ কোনজন? নরেন্দ্র মোদির বিকাশের রথে সওয়ার হতে আজ কে লাফ মারবেন? আর তা নিয়ে কি উল্লাস সেদিন হেস্টিংসের বিজেপি কার্যালয়ে। রোজ ঝান্ডা দিচ্ছেন দিলু ঘোষ, চার্টার্ড প্লেন আসছে, যাচ্ছে। সাভারকর, গোলওয়ালকর জায়গার নাম না খাবারের নাম জানা নেই, টলি সুন্দরীরা যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে, দিলীপ ঘোষের হাত থেকে ঝান্ডা নিচ্ছেন। আজ সময় বদলে গেছে, দিলীপ ঘোষেরই আসন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, হাতে স্যানিটাইজার ঘষে, শুদ্ধিকরণের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন রথের সওয়ার হতে নেতা কর্মীর ঢল নেমেছে, খুব অস্বাভাবিক? কে কার দিকে আঙুল তুলবে? তাহলে আদর্শ? তাহলে আমরা কী ভাবে দেখবো? সবটাই নিছক ক্ষমতা? না তা নয়, আসুন তা নিয়েও দুটো কথা বলা যাক।
এক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পটভূমিকা তৈরি হয়েছে আমাদের দেশজুড়ে। সমস্ত রাজনৈতিক আদর্শ, ভেদাভেদ এখন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার একদিকে সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী, হিন্দুরাষ্ট্রের উদগাতা আরএসএস – বিজেপি। অন্যধারে সবাই, প্রত্যেকে। সেখানে আপাতত একটাই আদর্শ, বিজেপির বিরোধিতা, তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা। প্রেমে আর যুদ্ধে নৈতিকতার জায়গা নেই, হিটলারকে সরাতে স্তালিন হাত মিলিয়েছিলেন রুজভেল্টের সঙ্গে, চার্চিলের সঙ্গে। সেদিন বিপ্লবী বাম, গণতান্ত্রিক দল, চার্চ, সাংস্কৃতিক কর্মী এক জায়গায় এসেছিলেন একটাই উদ্দ্যেশ্য নিয়ে, আজ আমাদের দেশে সেই লড়াই। সেখানে একটাই কথা ‘মারি অরি, পারি যে কৌশলে’, বাবুল সুপ্রিয় বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে এলে বিজেপির ক্ষতি, তাই সই, অমরিন্দর সিং বিজেপিতে না গিয়ে আপে গেলে বা কংগ্রসে থাকলে ভাল, ওয়াইএসআর রেড্ডি বিজেপির সঙ্গে না গেলে ভাল, শচিন পাইলট যেন বিজেপিতে না চলে যায়, বিজেপি দল আরও ভাঙুক। এভাবেই রাজনীতির চাকা আবর্তিত হবে, আপাতত লড়াইটা এরকমই। যে দল নীতি নৈতিকতার ধার ধারে না, গণতান্ত্রিক মুল্যবোধকে তোয়াক্কাও করে না, সেই দলকে ভাঙার, হারানোর কোনো নিয়ম নীতি থাকাও সম্ভব নয়। অগণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে লড়াইয়ের সময়, নৈতিকতার জায়গা থাকে কি? আজ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, লড়াইটা সেভাবেই লড়তে হবে। আগুন নেভানো যাক, প্রত্যেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক ধ্যানধারণাকে পরাজিত করা যাক, তারপর আবার নির্দিষ্ট আদর্শ নিয়ে কথা হবে। উদার অর্থনীতি আর সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিরোধ হবে। দক্ষিণপন্থার সঙ্গে বামপন্থার লড়াই হবে। আপাতত ইটের জবাব পাথরে, দল ভাঙানোর জবাবে দল ভাঙাই সময়ের দাবি।