আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে
আমি চাই মহুল ফুটবে সৌখিনতার গোলাপ কুঞ্জে।
আমি চাই নেপালি ছেলেটা গিটার হাতে
আমি চাই তার ভাষাতেই গাইতে আসবে কলকাতাতে।
আমি চাই ঝাড়খণ্ডের তীর ধনুকে
আমি চাই ঝুমুর বাজবে ঝুমুর বাজবে তোমার বুকে।
তাই সই, আজ রাইসিনা হিলসে এলেন নতুন অতিথি৷ দেশের প্রথম সাঁওতাল রাষ্ট্রপতি, আদিবাসী রাষ্ট্রপতি৷ সম্ভবত বলেছেন ‘আডি সেরহা’ নরেন্দ্র মোদি, নরেন্দ্র মোদি, আপনাকে ধন্যবাদ। রাইসিনা হিলসের দেওয়ালে, খিলানে, গম্বুজে এই প্রথমবার শোনা গেল সাঁওতালি ভাষা। দ্রৌপদী মুর্মু, আমাদের প্রথম আদিবাসী, সাঁওতালি রাষ্ট্রপতির মুখে। যে আদিবাসীরা দিকুদের বিরুদ্ধে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার ধরেছিল, এই উপমহাদেশের প্রথম লং মার্চ, উলুগুলান, হূল, সেই সিধু, কানু, বিরসা মুন্ডা, ফুলো মুর্মু, ঝানো মুর্মুদের এক বংশধর, তাঁদের উত্তরাধিকারি দ্রৌপদী মুর্মু আজ দেশের রাষ্ট্র প্রধান। আবডালে আড়ালে নয়, প্রকাশ্যে ধর্ষিতা হয়েছিলেন ফুলো মুর্মু, বেনিয়া, ব্রাহ্মণ দিকু জমিনদার আর ইংরেজ পুলিস ধর্ষণ করে, হত্যা করে ফেলে রেখে গিয়েছিল৷ তাদের উত্তরাধিকারি দ্রৌপদী মুর্মু নিশ্চই দাঁড়াবেন হাথরসের ধর্ষিতার পরিবারের পাশে৷ দেশ জুড়ে আরও এরকম অসংখ্য ধর্ষিতা মহিলার পাশে, হ্যাঁ এ রাজ্যেরও, দাড়াবেন? হ্যাঁ দাঁড়াবেন, আমরা তো সেটাই আশা করব। সমস্ত রাজনীতির ঊর্ধ্বে, দল আর প্রশাসনিক চাপকে অগ্রাহ্য করে দ্রৌপদী মুর্মু দাঁড়াবেন তাদের পাশে কারণ তিনি নিশ্চই জানেন ফুলো মুর্মুর কথা, সেই অপমানের কথা, সেই কষ্ট আর মৃত্যুর কথা।
দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হলেন, কত গল্প শোনা যাচ্ছে, একটা কাহিনী শোনা গেল সরকারি সূত্রে। সবেমাত্র এনডিএ বৈঠকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য দ্রৌপদী মুর্মুর নামে সিলমোহর পড়েছে৷ যে কোনও মেগালোম্যানিয়াকের মতই নরেন্দ্র মোদি চাইলেন, তিনি নিজেই ওনাকে ফোনে এই খবর জানাবেন। তো চেষ্টা শুরু হল৷ ওড়িষার প্রত্যন্ত গ্রাম রায়রঙ্গপুরে নেটওয়ার্ক নেই৷ পিএমও দফতরের কর্তারা ঘেমে নেয়ে অস্থির৷ সেখানে নেটওয়ার্ক নেই, সেটা প্রধানমন্ত্রীকে জানানো যাচ্ছে না৷ তাঁরা শেষমেষ খুঁজে পেলেন দ্রৌপদী মুর্মুর প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক বিকাশ চন্দ্র মহান্তির নম্বর, তিনি গ্রামের কাছাকাছি একটা দোকান চালান৷ তাঁকে ফোন করে পাঠানো হল দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে, আরও কয়েকবার ফোন কাটার পর পাওয়া গেল ওনাকে৷ মিস্টার প্রাইম মিইস্টার ফোন করে জানালেন, ওনাকে রাষ্ট্রপতি করা হচ্ছে, তার ক’দিন পরে নিউজ পেপারে ফাঁস হল, আলোও নেই সেখানে, মানে বিদ্যুৎ যায়নি, তড়িঘড়ি করে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হল। ছবিটা পরিষ্কার, এখনও প্রান্তিক এলাকায় আদিবাসীভূমে বহু জায়গাতেই না আছে আলো, না আছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। দ্রৌপদী মুর্মু রাইসিনা বাংলোয় গেলেন৷ আচ্ছা, এবার তাহলে ওই সব প্রান্তিক এলাকায় আলো যাবে? প্রধানমন্ত্রী মিথ্যে বলছেন, বলবেনও, কিন্তু সত্যি করে আলো যাবে তো? যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে তো? দরকারে ফোনে পাওয়া যাবে তো ফোনের লাইন? আশা করব যাবে, কারণ রাষ্ট্রপতি পদে একজন আদিবাসী সাঁওতাল, এই প্রথমবার, তিনি নিশ্চই জানেন অন্ধকারে থাকার জ্বালা, তিনি জানেন যোগাযোগের অভাবে কিভাবে পিছিয়ে পড়ে থাকে সমাজ।
তাই আশা করব দেশের সর্বত্র, সব থেকে পিছিয়ে পড়া আদিবাসি ঝুপড়িতে জ্বলবে আলো, থাকবে টেলিফোন। আচ্ছা কেন লড়েছিল, সিধু কানু, বিরসা মুন্ডারা? লড়েছিল, কারণ তাঁদের জল, জমি, জঙ্গল কেড়ে নিচ্ছিল দিকুরা, কেড়ে নিচ্ছিল ইংরেজ সাহেবরা। স্বাধীনতা এল, কেবল শহর আর কারখানা গড়তে যে উচ্ছেদ হল, তার ৮৭% হল আদিবাসীদের জমি। তাদের জমির তলায় কয়লা, আমাদের চাই। জমির তলায় লোহা, তামা, বক্সাইট, আমাদের চাই। শহর হবে, বন সাফ করা হয়েছে, রিসর্ট করা হয়েছে জঙ্গলের মধ্যে, তারপর আরও জঙ্গল কাটা হয়েছে। সত্যিই যদি ওই আদিবাসীদের এই উচ্ছেদের বদলে ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হত, তাহলে দেশের সবথেকে ধনী, বড়লোকদের না হত টুডু, মুর্মু, মাহাতো, জেনা।
হ্যাঁ, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে নগরায়ন হয়েছে, এখনও হচ্ছে। যে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন স্ট্যান স্বামী, যাকে জেলে পচিয়ে মারল এই বিজেপির সরকার, মোদি সরকার। এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আজও লড়ছে দ্রৌপদী মুর্মুর জন্মভিটের ৭০/৮০ কিলোমিটার দুরের মানুষ, নিয়মগিরি পাহাড়ের তলার আদিবাসী মানুষ, তারা বেদান্তকে রুখেছে, তারা আদানিকে রুখবে। কী করবেন আমাদের প্রথম আদিবাসী সাঁওতাল রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু? আমরা আশা করব তিনি রুখে দাঁড়াবেন, কারণ তাঁর হাতে এখন ক্ষমতা আছে। কেবল ওড়িশা কেন? ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ এমন কি ঝাড়খণ্ডেও চলছে উচ্ছেদ৷ আমরা বিশ্বাস করি আমাদের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি রুখে দেবেন সেই উচ্ছেদ, আদিবাসীরা ফিরে পাবে জল, জঙ্গল, জমির অধিকার।
ঠিক এই মূহুর্তে কেবলমাত্র ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বাংলা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগড় আর মহারাষ্ট্রে ১৩ লক্ষের কাছাকাছি আদিবাসী জেলে৷ তাদের মধ্যে এক বিরাট অংশ এক বছরেরও বেশি জেলে, বিভিন্ন অভিযোগে, তাদের উকিল নেই, তাদের পয়সা নেই, তাদের ক্ষমতা নেই, তাদের পরিচিতি নেই, মানুষগুলোর ওপর অভিযোগ কী? তাও তাদের অনেকে জানে না। আমাদের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি কি এই অবিচারের কথা ভাববেন? কিছু করবেন? যে আদিবাসীরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটাই জানে না, তাদের অন্তত অভিযোগটা জানানোর ব্যবস্থা হবে? তাদের আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা হবে? তাদের জন্য যে সব সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্থা কাজ করছে, তাদেরকেও হ্যারাস করা হচ্ছে, তাদেরকেও জেলে পাঠানো হচ্ছে, মিথ্যে মামলা দেওয়া হচ্ছে। সুধা ভরদ্বাজ, এই আদিবাসীদের মধ্যেই কাজ করতেন, বিনা বিচারে তাঁকে জেলে রাখা হল তিন বছর৷ এখন জামিনে, কিন্তু রোনা উইলসন, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং সুধীর ধাওলে, অধ্যাপিকা সোমা সেন এখনও জেলে, মাননীয় আদিবাসী রাষ্ট্রপতি কি এখনই সেই সব ফাইল চেয়ে পাঠাবেন? দেখবেন, প্রতিকার করবেন? আমরা আশা করবো দ্রৌপদী মুর্মু জানেন এই বিষয়গুলো, তিনি জানেন অসহায় আদিবাসীদের কথা, আশা করব তিনি এঁদের পাশে দাঁড়াবেন।
দেশের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্স আন্ড এনভারনমেন্ট ২০২২ এর রিপোর্ট বলছে দেশের ৭১% মানুষ পুষ্টিকর খাবার পায় না, আরও উদ্বগের ব্যাপার হল এই ৭১% এর ৭৮% আদিবাসী মানুষজন। দেশের শিশুমৃত্যুর হার আদিবাসী সন্তানদের সবথেকে বেশি, এই ব্যথা দ্রৌপদী মূর্মুর থেকে বেশীকে বুঝবেন? তিনি তাঁর দু সন্তান কে হারিয়েছেন, কেন দেশের আদত বাসিন্দারা এখনও দু’বেলা দুমুঠো ভাতের স্বপ্ন দেখেই কাটায়? কেন তাদের বাচ্চারা খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত? এই প্রশ্ন নেই দ্রৌপদী মুর্মুর মনে? আশা করব তিনি জানেন বাস্তব ব্যবস্থাটা, আগামী পাঁচ বছরে তিনি ধরবেন হাল, সরকারের কাছে জবাব চাইবেন, নির্দেশ দেবেন, পাঁচ বছর পরে আমরা দেখতে চাই এই ভারতের প্রত্যেক শিশু, প্রত্যেক আদিবাসী শিশুর খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষার ব্যস্থা হয়েছে।
না আদিবাসীরা হিন্দু নয়, আর্যদের সনাতন ধর্মের গণ্ডির মধ্যে তাঁরা নেই৷ আচার্য দ্রোণাচার্য অস্বীকার করেছিলেন বনবাসী একলব্যকে ধনুর্বিদ্যা শেখাতে৷ বেদ শিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা ছিল, আদিবাসীদের ভগবান সিং বোঙা, আবগে বোঙা, মারাংবুরু। তাদের ধররীয় উৎসব সোহরাই, বাহা, দাসাই। সাঁওতালদের মধ্যে অসুর সম্প্রদায় আছে, যারা অসুর পূজো করে। অনার্য শিব, বড়ঠাকুরকে তারা পুজো করে। তাদের ধর্ম সারি, সারনা। দেশে ৬০ লক্ষের বেশি এই ধর্মের মানুষ আছে, তাদেরকে হিন্দু ব্রাকেটে ভরে বোড়ের মত এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, জানেন আমাদের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মু? ঝাড়খন্ড এই দুই ধর্মকে স্বীকৃতি দেবার বিল এনেছে, বাংলা আনছে, রাষ্ট্রপতি সই করবেন তো? আমরা আশা রাখি রাষ্ট্রপতি এই বিলে সই করবেন।
৩২০ একর জমির উপর তৈরি দিল্লির রাইসিনা হিলসের বাসিন্দা দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। ১৯২৯ সালে তৈরি এই ভবনে ৩৪০টি ঘর রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ছাড়াও রাইসিনায় রয়েছে তাঁর অধিকারীনিবাস, স্বাগত কক্ষ, অতিথিশালা এবং রাষ্ট্রপতির কার্যালয়। এছাড়াও রাষ্ট্রপতি ভবনে রয়েছে সিকিউরিটি এবং কর্মচারিদের থাকার ব্যবস্থা। রয়েছে আস্তাবলও। আর রাইসিনা হিলসের বাগান? সে তো টিকিট কেটে দেখতে যেতে হয়। ১৯৫১ সালের নিয়ম মেনে দ্রৌপদী মুর্মু এখন থেকে প্রতিমাসে ৫ লক্ষ টাকা মাইনে-সহ বহু সুযোগ সুবিধে পাবেন। এক আদিবাসীর এই সম্মান দেশের অনেক পাপের প্রায়শ্চিত্য, কিন্তু কেবল রাষ্ট্রপুঞ্জে বা রাইসিনা হিলসে গেলেই তো হবে না, তা এক প্রকান্ড তামাসা, এক বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে দাঁড়াবে, যদি দেখা যায় দেশের আদিবাসীরা যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেল। অনেকেই বলবেন, আহা শুরুর দিনে এত হতাশার কথা কেন? আসলে ৮ বছর হয়ে গেল দেশের প্রধানমন্ত্রী এক চায় ওয়ালা, তাতে তো দেশের চায় ওলাদের অবস্থার কোনও হেরফের হয়নি, হয়েছে কী? যদি হয়ে থাকেও, তাহলে তাও হয়েছে আরও খারাপের দিকে, জিনিসের দাম বেড়েছে, মূল্যবৃদ্ধির চোটে মানুষ বেহাল, তাই শুরুর দিনেই বলে রাখা, মাননীয় রাষ্ট্রপতিজী আমাদের অনেক আশা রইল, রইল শুভেচ্ছাও।