হিংসার কথা তো মাওবাদীরা বলে, অস্ত্র হাতে তুলে নেয় তো মাওবাদীরা। আক্রমণ করে পুলিশ, থানা, মন্ত্রীদের কনভয়, এমনকি মিলিটারি বাহিনীকে। তারপর হয় তারা মরে, না হলে পুলিশ, মিলিটারি, মন্ত্রীসান্ত্রী। আর এসব তারা লুকিয়েও করে না, তারা তো সর্বক্ষণই বলেই চলেছে সশস্ত্র যুদ্ধের কথা, ক্ষমতা দখলের কথা। তার উল্টোদিকে একব্যবস্থা হল এই সংসদীয় গণতন্ত্র, যেখানে রাজনৈতিক দল থাকবে, তাদের বিভিন্ন মতামত থাকবে, তাদের সংগঠনের মানুষজন নির্বাচনে দাঁড়াবেন, ম্যানিফেস্টো, নির্বাচনের আগে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করবে, মানুষকে জানাবে তারা কী কী করতে চায়, সাধারণ মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এমএলএ, এমপি হবেন, আইন তৈরি করবেন, অস্ত্র থাকবে পুলিশের কাছে, অপরাধীদের মোকাবিলা করার জন্য। তো এক ছোট্ট সার্ভে করা হল, আমাদের দেশে অস্ত্র কাদের কাছে আছে? হিসেব বলছে আইনী ও বেআইনী অস্ত্রের ভান্ডার, পুলিশ বাহিনীর থেকে অনেক বেশী আছে দেশের মানুষের কাছে, তারা ক্ষমতাবান, অর্থবান মানুষ, কেন এত অস্ত্র কেন?
তাহলে ওই যে শ্লোগান, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, তাই কি ঠিক? ক্ষমতা বজায় রাখতেই কি ক্ষমতাবানদের হাতে এত অস্ত্র? জমি মাফিয়া, খনি মাফিয়াদের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে, আমার এক পরিচিত আইপিএস বলছিলেন, সেই মানের অস্ত্র পুলিশের কাছে নেই, যখন এসে পৌঁছয়, ততদিনে ওদের কাছে আরও উন্নতমানের অস্ত্র এসে পৌঁছে যায়, এটাই বাস্তব। অর্গানাইজড ক্রাইম, সংগঠিত অপরাধ আমাদের চারদিকে, কেউ বেআইনীভাবে জমি দখল করছে, কেউ জলাভূমি বোঝাচ্ছে, কেউ জঙ্গল কাটছে, কেউ বন্দরের দখল নিচ্ছে, কেউ টেন্ডারের দখল নিচ্ছে, তাদের সাহায্য করার জন্য বিরাট লুম্পেন বাহিনী, তাদের হাতে অস্ত্র, ঝাঁ চকচকে অস্ত্র। সরকার জানে না? পুলিশ জানে না? প্রশাসন জানে না? সব্বাই সব জানে, তাহলে কেউ কিচ্ছুটি বলছে না কেন? বলছে না কারণ তারা রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের নির্দেশেই কাজ করে, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়াতেই বেড়ে ওঠে, বেঁচে থাকে। আর রাজনীতি অপরাধের গাঁটছড়া ক্রমশ মজবুতহয়, বিচারপতি, প্রতিবাদী যুবক, ঘুষ না নিতে চাওয়া ইঞ্জিনিয়ার হঠাৎই লাশ হয়ে যায়, স্মৃতি কমিটি তৈরি হয়, স্মৃতিবেদী তৈরি হয়, মালা দিতে আসেন, দেশ কি নেতা ক্যায়সা হো, অমুক ভাই য্যায়সা হো। সেইভাই, তার ভাই ভাতিজা, রক্ষীদেহ রক্ষী মিলিয়ে গোটা ১২ কালাশনিকভ তো সেদিনের অনুষ্ঠানেই দেখতে পায় মানুষজন, অথচ ও না রাখা তায় কলমেকেও মাওবাদী নন, হিংসার কথা বলেন না। গতকালের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়, এই আলোচনাকে আবার সামনে এনে ফেললো, রাজনীতি আর অপরাধ জগতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ছবি আবার সামনে।
কীভাবে? সুপ্রিম কোর্ট এক তালিকা বার করেছে, বিহারের নির্বাচন প্রার্থীদের তালিকা, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২০তে বিহার বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির ১০৯জন প্রার্থীর মধ্যে, ৭০ জনের বিরুদ্ধে অপরাধের বড়সড় অভিযোগ আছে, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের ১৪১জন প্রার্থী ছিল, তারমধ্যে ৭০জনের, মানে প্রায় ৫০% প্রার্থীর নামে বড়সড় অপরাধের অভিযোগ ছিল, কংগ্রেস আরও এককাঠি ওপরে, তাদের ৭০জনের মধ্যে ৬৪ জনের বিরুদ্ধেই ক্রিমিনাল কেস ঝুলে আছে বলে জানানো হয়েছিল, এলজেপি, রামবিলাস পাশওয়ানের দল, আপাতত তাঁর পুত্র চিরাগ পাশওয়ানের প্রার্থী ছিল ১৩৫জন, ৫২জনের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস ঝুলছিল, জেডিইউ, ক্লিনম্যান নীতীশ কুমারের দলের ১১৫ জনের মধ্যে, ৪৯ জনের নামে মামলা চলছিল, এবং বিএসপি, যারা বিহারে কোনও ফ্যাক্টরই নন, যাদের কোনও সংগঠনই নেই, তাদের ৭৮জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৮জনের বিরুদ্ধে গুরুতর মামলা ছিল, কত মামলা দায়ের করাই হয়নি, কত খুন চেপে গেছে পুলিশ, কত ধর্ষণের অভিযোগ আসার আগেই ধর্ষিতার বাবা, ভাই, আত্মীয়দের মুখবন্ধ করা হয়েছে, সে হিসেব বাদই দিলাম, সাধারণ হিসেবেই দেখা যাচ্ছে গরিষ্ঠাংশ প্রার্থীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। সুপ্রিম কোর্ট বলছে, আমরা তো রাজনৈতিক দলকে পরিস্কার জানিয়েছিলাম, অপরাধের অভিযোগ আছে, এমন মানুষজনকে যদি আপনারা নিজেরাই বাদ দেন, তাহলে এই প্রবণতা অনেকটাই কমবে, কিন্তু দেশের সরকারি দলেরই যখন এই হাল, তখন বাকিরা যে সেই পথের পথিক হবে, তাতে আর অবাক হবার কিই বা আছে? কিন্তু ক’দিন আগেই বলছিলাম না, আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ, সব কিছু যেনতেন সুরে বাজছে না, রাজামশাই হ্যাঁ বলিলে, সান্ত্রী, মন্ত্রী মোক্তারদের হ্যাঁ বলারই কথা, কিন্তু সবাই যেন সে কথা মানছে না, কেউ কেউ অন্যস্বরে কথা বলা শুরু করেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল সুপ্রিম কোর্ট, জাস্টিস আর এফ নরিম্যান আরবিআর গতকাল বললেন এনাফ ইস এনাফ, এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে বসেছে, আমরা বারবার বলছি, তাকানো যাচ্ছে না কেন? জাতীয় দলগুলোর উদ্দেশ্যে তারা বলেছেন, প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করার ৪৮ঘন্টার মধ্যে জানাতে হবে, কোন কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে কী কী মামলা ঝুলে আছে, সেই মামলার বিবরণ দিতে হবে, তা দলের ওয়েব সাইটে থাকতেই হবে, মোদ্দা কথা হল মানুষকে জানাতে হবে যেকোন হীরে মুক্ত, জহরত, মণি, মানিক্যদের নির্বাচনের আসরে নামানো হল।
বিচারপতিরা বলছেন, দেশের মানুষের ধৈর্যের তো একটা সীমা আছে, তার অপেক্ষা করে বসে আছে, অপরাধ মুক্ত, ভয়মুক্ত এক রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য। ৭১ পাতার এই জাজমেন্টে, রাজনীতি থেকে অপরাধের শেকড় ছিঁড়ে ফেলার জন্য যাতে নতুন আইন বানানো হয়, তার কথাও বলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এই রায় দেবার পরে, মাত্র ৮মাসের মধ্যে বিহারের নির্বাচন হয়েছিল আর সেই নির্বাচনে দেখা গেলো, রাজনৈতিক দলগুলো কেউ দেখেও না, এমন পত্রপত্রিকাতে তাদের প্রার্থীদের অপরাধের তালিকা ছাপিয়ে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখালেন, না হলে অর্ধসত্য খবর দিয়ে মানুষকে বোকা বানালেন, তখন বিজেপি, কংগ্রেস, আরজেডি, জেডিইউ, এলজেপি এবং সিপিআইকে ১লক্ষ টাকা জরিমানা করেছিল, এবারে ফেব্রুয়ারির রায়কে সম্পূর্ণ অমান্য করার জন্য, সিপিআই আর এনসিপিকে ৫লক্ষ টাকা জরিমানা করা হল, অনেক ভাল ভাল কথাই বলা হল, এসব পাঁচ দশ লাখ জরিমানাতে যে কিছুই হবে না, তাও সবাই জানে। আসলে গান্ধীর সঙ্গে সঙ্গেই অহিংসার তত্ত্বও শেষ হয়ে গেছে, লাঠি যার, জোর তার নীতিতেই চলছে দেশ, রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনে জিততে হলে টাকা চাই, টাকার জন্য বেআইনী কাজ করতে হবে, রংদারি ট্যাক্স, দাদাগিরি খাজনা উসুল করা হবে, যে যার লেভেলে যেমন ভাবে পারবেন করে খাবেন, সেটা করতে গেলে গুন্ডা পুষতে হবে, তাদের অস্ত্র দরকার হবে, তারা বিভিন্ন অন্যায় করবে, যারা রাজনৈতিক নেতারা দেখেও দেখবে না, ছোট গুন্ডার হাতে ওয়ান শাটার, বড় গুন্ডার হাতে অটোমেটিক পিস্তল, আরও বড়দের হাতে কালাশনিকভ, এটাই রীতি। সংগঠিত অপরাধীরাও রাজনীতিতে নেমে পড়ছে, অর্থনৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত মানুষ শুধু নয়, ধর্ষণ, খুনের মত ক্রিমিনাল মামলা চলছে এমন মানুষ, অনায়াসে নেমে পড়ছেন রাজনীতিতে, প্রচার, পয়সা আর রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া পেয়ে এমপি, এমএলএ হচ্ছেন। এইভাবে ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠছে অপরাধ, অপরাধী আর রাজনৈতিক নেতারা, এবং এর ফলে সাধারণ মানুষ, ভদ্র মানুষ, শিক্ষিত সুভদ্র মানুষ জন রাজনীতিতে আসছেন না, ছোটদের বলা হয়, আর যাই করো রাজনীতি কোরও না, রাজনৈতিক নেতা এখন হিন্দি সিনেমার ভিলেন, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তাণ্ডব থেকে মির্জাপুর সেই অপরাধেরই গল্প, এ এক বিষাক্ত চক্র। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য, আমাদের, সাধারণ মানুষজনকে এগিয়ে আসতে হবে, রাজনৈতিক দলের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে, যাতে করে তারা অপরাধীদের প্রশ্রয় না দেয়, কোনও একজনকে তো বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতেই হবে, না হলে বন্দুকের বিরুদ্ধে বন্দুক, বোমার বিরুদ্ধে বোমা ছাড়াতো অন্যকোনও পথ খোলা থাকবে না, তাই না? আপনাদের মতামত দিন, আজ এই পর্যন্তই।