ওদিকে দাদাঠাকুরের সঙ্গে পঞ্চকের দল, শোণপ্রাংশুরা নাচছে, গান গাইছে, হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দেরে দেরে, যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে,
এদিকে তৃণাঞ্জন খবর এনেছে অচলায়তনের প্রাচীর গিয়েছে ফুটো হয়ে৷ অচলায়তন ভাঙছে৷ খবর পেয়ে সেদিন মহাপঞ্চক বলেছিলেন, এ- কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। শিলা জলে ভাসে! ম্লেচ্ছরা অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দেবে! পাগল হয়েছ!
গতকাল যোগী – মোদি – অমিত শাহ সম্ভবত এই একই কথাই বলেছেন৷ একই ভাষায় না হলেও, বলেছেন ওই কথাই। তমে পাগল থই গয়া ছো? তিনজন মন্ত্রী ১১ জন বিধায়ক বিজেপি ছেড়ে সমাজবাদী পার্টিতে? হয় নাকি? ভোটের আগে টাকার থলি, চার্টার্ড প্লেন আর আগাম মন্ত্রিত্বের গাজর ঝুলিয়ে দল ভাঙানো তো বিজেপির কায়দা৷ এবার উলটো চালের সামনে দাঁড়িয়ে মোদি – শাহ – যোগী৷ কুল কিনারা পাচ্ছেন না৷ শোনা গ্যালো নন স্টপ ১৫ ঘন্টা বৈঠক করেছেন। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল, শোনা যাচ্ছে আরও বেশ কিছু মন্ত্রী, এমএলএ নাকি দল ছাড়ার জন্য তৈরি৷ সম্ভবত এ খবর যখন পড়ছি, তখন লিস্ট আরও লম্বা হয়ে গিয়েছে৷
কেবল উত্তর প্রদেশে? না তাও নয়৷ উত্তরাখন্ড থেকেও এমন খবর আসছে৷ এ বাংলায় তো চলছেই৷ এমন অবস্থা যে বাংলার সব কমিটি ভেঙে আবার নতুন কমিটি তৈরির কথাও বলছেন বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। একবার মনে করুন সেই দিনগুলোর কথা, আমাদের রাজ্যে তখন যোগদান মেলা চলছে৷ রোজ অঞ্জনা, কাঞ্চনা, রিমঝিম থেকে চোখে আঙুল দাদা রুদ্রনীল, সাংবাদিক থেকে এক ঝটকায় এমএলএ বনে যাওয়া প্রবীর ঘোষাল, মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে কাঁথির খোকাবাবু শুভেন্দু অধিকারী কমল বনে ঝাঁপ দিচ্ছেন, কোনও নীতির দোহাই শুনেছেন?
গোদি মিডিয়ায় তখন কি আনন্দ৷ বাংলা এবার গেরুয়া হবে৷ পাগলের গোবধে আনন্দ৷ ২৪ ঘন্টা অহোরাত্র মানুষকে বোঝানো হচ্ছে পালাবদলের কথা, ডাবল ইঞ্জিনের মাহাত্ম্য, পেছন থেকে খড়কে কাঠি নড়ছে, সেই ইঙ্গিতে টলিপাড়ার নায়িকারা, কুচুবুলুরা নেমে পড়েছেন মাঠে, আজ অমিত জি কে সাথ মুলাকাত হুয়া তো কাল নরেন্দ্র মোদিজী কো নমস্তে বোলা, গর্তে ঢুকে পড়া চিনা শিল্পপতির দল বেরিয়ে এসেছে, মোদীর সংগে সেলফি তুলে পোস্ট করছে ফেসবুকে, বাংলার মানুষ দেখেছে, শুনেছে, বুঝেছে।
মজার কথা হল উত্তরপ্রদেশে বিজেপির এই ভাঙন, কিন্তু বাংলার ভাঙন নয়, তার চরিত্র আলাদা, তার ইমপ্যাক্ট, তার প্রভাবও আলাদা৷ কেউ কেউ রামছাগলেরও দাড়ি আছে, রবিঠাকুরেরও আছে, এমন নির্বোধ লজিক নিয়ে বলছেন, বাংলাতেও তো দলবদল হয়েছিল, কই তার তো কোনও ফলই পায়নি বিজেপি৷ এখানেও এই ভাঙন তেমন কোনও প্রভাব ফেলবে না৷ আসুন উত্তরপ্রদেশের দলবদল নিয়ে, তার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বাংলায়, তৃণমূল ভাঙা হচ্ছিল, কারা ভাঙছিল? বিজেপি। কেন্দ্রে ক্ষমতায়, তাদের হাতে বিরাট ক্ষমতা, সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, ভিজিলেন্স, কোটি কোটি টাকা। ভাঙা সহজ। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে? রাজ্যে যোগী, কেন্দ্রে মোদি – শাহ৷ হাতে লক্ষ কোটি টাকার থলে, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স, ইডি ভিজিলেন্স, রাজ্য পুলিশ, রাজ্যের আমলা। অখিলেশ যাদব বা সমাজবাদী দলের কোনওটাই নেই৷ অথচ এমএলএ শুধু নয়, মন্ত্রীরাও যাচ্ছে সপার দিকে, যারা যাচ্ছে, তাদের অনেককেই উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক মহলে হাওয়া মোরগ বলে ডাকা হয়ে থাকে৷ এনারা বিএসপি ক্ষমতায় আসার আগে বিএসপিতে গিয়েছেন, এসপি ক্ষমতায় আসার এসপিতে গিয়েছেন, বিজেপি আসার আগে বিজেপিতে গিয়েছেন, এবার সপাতে আসছেন। অন্য কিছু না হোক, এই আসা থেকে উত্তরপ্রদেশের হাওয়ার ইঙ্গিত তো পাওয়াই যায়, আমরা পাচ্ছি, বিজেপিও পাচ্ছে। এই ভাঙন ইউপিতে অন্য হাওয়ার, পরিবর্তনের হাওয়ার খবর দিচ্ছে, না হলে এই মান্যবরেরা দল বদলাতেন না, মন্ত্রীত্ব ছেড়ে তো কভি নঁহি।
সেদিন বাংলায় বিজেপি তৃণমূল ভাঙার চেষ্টা করছিল বটে৷ কিন্তু সেই ভাঙার মধ্যে খুব বিরাট কোনও পরিকল্পনা ছিল না৷ এক কাঁথির খোকাবাবু ছাড়া, খুব পরিকল্পনা করে এই ভাঙন তৈরি হয়নি, যে নেতা যেখানে পেরেছেন, সেখানে খাবলিয়েছেন, কেউ কৈলাশ বিজয়বর্গিয়র সঙ্গে, কেউ দিলীপ ঘোষের সঙ্গে, কেউ আরও কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন, ফলে ভাঙনের চেহারাও ছিল বিক্ষিপ্ত, ভাঙন হল, কিন্তু কার্যকরী হল না, কোনও এক প্রযোজক কিছু কুচুবুলু টলি সুন্দরীদের ভিড়িয়ে দিলেন, কোনও এক শিল্পপতি এক খেলোয়াড়কে ধরে দুজন খেলোয়াড় পাঠিয়ে দিলেন, এরকম আর কি।
কিন্তু উত্তর প্রদেশে? রীতিমত পরিকল্পনা করেই করা হচ্ছে, অন্তত এখনও পর্যন্ত। রাজনীতি উত্তর প্রদেশে, শারদ পাওয়ার মুম্বইতে বসে বলছেন আরও ১২ জন দল ছাড়বে, শোনা গ্যালো তারা ছাড়বে সংক্রান্তির দিনে, সেদিন বিহারে দহি চুড়া হয়, ইউ পি র বহু জায়গাতেই খিচড়ি হয়, সেই খিচড়ি খাবার নেমন্তন্ন হয়, অনেকটা আমাদের বিজয়া দশমী বা ইফতারের মতন, সেই দিনেই নাকি তাঁরা ছাড়বেন, সে খবর শারদ পাওয়ারের কাছেও আছে। এবং খেয়াল করুন, যে তিন জন মন্ত্রী পদত্যাগ করলেন যোগী মন্ত্রী সভা থেকে, স্বামী প্রসাদ মৌর্য, দারা সিং চৌহান, ধরম সিং সাইনি, তাদের পদত্যাগপত্রগুলো দেখুন, একই বয়ান, একই চিঠি কেবল নয়, এক ফন্টে টাইপ করা, নীচের সইগুলো কেবল আলাদা, প্রত্যেকে পদত্যাগ করার মিনিট দুই কি তিনের মধ্যে অখিলেশ যাদবের টুইট, সেটাও প্রায় একই ভাষায়। তার মানে চিত্রনাট্য তৈরিই ছিল, ডিরেক্টর কেবল অ্যাকশন বলেছে মাত্র। এবং তিনজন মন্ত্রীকে, নিজেদের দিকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা তো এক দু ঘন্টায় হয় না, বহু আলোচনা লাগে, বহু দাম দস্তুর হয়, বহু চিন্তা ভাবনা হয়, বহু মিটিং হয়, এক্ষেত্রেও হয়েছে। মজার কথা হল, রাজ্যে যোগীর পুলিশ, আই বি, কেন্দ্রে অমিত শাহের যাবতীয় খোঁচড় বাহিনী টেরও পায় নি, মানে ক্ষমতায় গদীয়ান হলেই সব খবর রাখা যায় এমন নয়, এটা মোদি – শাহ – যোগী বুঝছেন।
তৃতীয় যে বিরাট ঘটনা এই দলবদল বা ভাঙনের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে, তা হল কাউ বেল্ট, গো জাত পাতের রাজনীতি, ইতিহাসের এক পুনরাবৃত্তি। সে এক বিরাট বৃত্তান্ত, আরেকদিন সময় নিয়ে বলবো, কেবল এটুকু বলা যাক যে বিজেপি হিন্দু সমাজের ‘পিছড়ে বর্গ’, পিছিয়ে পড়া দলিত সমাজকে তাদের ধারে নিয়ে আসার চেস্টা চালানো শুরু করে, এটা বুঝেই যে কেবল আপার কাস্ট আর বেনিয়াদের ভোটে নির্বাচন জেতা সম্ভব নয়, এই ইকুয়েশন ভালো বুঝেছিলেন অমিত শাহ, তাই উত্তর প্রদেশের দলিত সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের নিজেদের দিকে এনেছিলেন, ২০১৭ ইউপি নির্বাচনের সময় সুহেল সমাজের রাজভড়, নিষাধ, কুর্মি, বাল্মিকী দের সঙ্গে নিয়েছিলেন, মজফফরপুর দাঙ্গার পরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ গুজ্জররা বিজেপির দিকেই ভিড়েছিলেন, সবমিলিয়ে ৩১০, শরিক নিয়ে ৩২৫ এর কাছা কাছি, দুর্দান্ত বিজয়।
কিন্তু বিজয় মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেয়৷ জেতার পরেই বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী করল অজয় মোহন বিস্তকে৷ এক ক্ষত্রিয়, আপার কাস্টের নেতাকেই মুখ্যমন্ত্রী করল তারা৷ কারণ আদতে তারা তো আপার হিন্দু কাস্টেরই প্রতিনিধি৷ সেই অজয় মোহন বিস্ত বা আদিত্যনাথ যোগী গদিতে বসেই আপার কাস্ট রাজনীতিতে মাতলেন, নিচু জাত তো ছেড়েই দিন, এমন কি ইউপির রাজনীতিতে সংখ্যায় কম হলেও, অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্রাহ্মণরাও কলকে পেলেন না। কিছু দলিত, ওবিসি মন্ত্রিত্ব পেলেও ক্ষমতা পেলেন না। যে গাছের ডালে বসেছিলেন যোগিজী, সেই ডাল তিনি এই পাঁচ বছর ধরে অত্যন্ত যত্ন সহকারে কেটেছেন৷ এখন গাছ পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলনের ফলেই, অন্তত গ্রামে জাঠ আর মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ, সঙ্গে এসেছে চরণ সিংহের নাতি জয়ন্ত চৌধুরি, রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা, জাঠেদের নেতা, আগেই এসেছেন পুর্বাঞ্চলে সুহেলদেব সমাজের নেতা ওম প্রকাশ রাজভড়, এবার এলেন স্বামী প্রসাদ মৌর্য্য, সব মিলিয়ে গতবার স্যোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর নামে যেভাবে ছোট ছোট দল, তাদের জাতির আনুগত্যকে নিজেদের দিকে এনেছিলেন অমিত শাহ, এবার সেই খেলায় অনেকটাই এগিয়ে অখিলেশ যাদব, এই ভাঙনের দিকে নজর দিন, ৯০% বিজেপি দলত্যাগী নেতা দলিত, ওবিসি সম্প্রদায়ের নেতা।
শোনা যাচ্ছে নয়, জানা গ্যাছে আগামীকাল এই ভাঙন আরও বড় হবে, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির হাওয়ার গন্ধ পেয়েছেন যোগী, মোদি শাহ, কিন্তু সামলাতে পারবেন? মনে হয় না।
যোগীকে প্রায় সরিয়ে কেশব প্রসাদ মৌর্যকে আনার চেষ্টা বহু আগেই করেছিলেন অমিত শাহ, মোদিজী, কিন্তু সফল হননি৷ কেশব মৌর্যকে সাইড লাইনে রেখেই আদিত্য যোগী সরকার চালিয়েছেন৷ এখন সেই কেশব প্রসাদ মৌর্যের দিকে তাকিয়ে আছে বিজেপি৷ তিনি এখন ফ্রন্ট রানার৷ কোনও ক্রমে বিজেপি জিতে গেলে তিনিই হবেন দলের পছন্দের মানুষ৷ সেটা আবার আদিত্য যোগী জানেন৷ জানেন মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি গেলে, তাঁকে যেতে হবে বনবাসে, কাজেই তিনি তাঁর মতন ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে উত্তর প্রদেশ, পরিবর্তনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, আজ বলছি ১০ মার্চ মিলিয়ে নেবেন, অচলায়তন ভাঙছে।
আসুন আমাদের ঠাকুরের লেখা,অচলায়তনের শেষের দিকের কয়েকটা লাইন পড়া যাক,
চারিদিক থেকে খারাপ খবর আসছে, মহাপঞ্চক বেজায় ঘাবড়ে গেছে, সেই সময় উপাধ্যায় ঢুকছে।
মহাপঞ্চক। – কতদূর।
উপাধ্যায়। – কতদূর কী। এসে পড়েছে যে।
মহাপঞ্চক। – কই দ্বারে তো এখনও শাঁখ বাজালে না।
উপাধ্যায়। – বিশেষ দরকার দেখি নে– কারণ দ্বারের চিহ্নও দেখতে পাচ্ছি নে– ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
মহাপঞ্চক। – বল কী! দ্বার ভেঙেছে?
উপাধ্যায়। – শুধু দ্বার নয়, প্রাচীরগুলোকে এমনি সমান করে শুইয়ে দিয়েছে যে তাদের সম্বন্ধে আর কোনো চিন্তা করবার দরকার নেই।
মহাপঞ্চক। – কিন্তু আমাদের দৈবজ্ঞ যে গণনা করে স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়ে গেল যে–
উপাধ্যায়। – তার চেয়ে ঢের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শত্রুসৈন্যদের রক্তবর্ণ টুপিগুলো।
ছাত্রগণ। – কী সর্বনাশ!
সঞ্জীব। – কিসের মন্ত্র তোমার মহাপঞ্চক!
তৃণাঞ্জন। – আমি তো তখনই বলেছিলুম এ-সব কাজ এই কাঁচাবয়সের পুঁথিপড়া অকালপক্কদের দিয়ে হবার নয়।
বিশ্বম্ভর। – কিন্তু এখন করা যায় কী?
তৃণাঞ্জন। – আমাদের আচার্যদেবকে এখনই ফিরিয়ে আনি গে। তিনি থাকলে এ বিপত্তি ঘটতেই পারত না। হাজার হোক লোকটা পাকা।
সঞ্জীব। – কিন্তু দেখো মহাপঞ্চক, আমাদের অচলায়তনের যদি কোনো বিপত্তি ঘটে তা হলে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।
উপাধ্যায়। – সে- পরিশ্রমটা তোমাদের করতে হবে না, উপযুক্ত লোক আসছে।
উপযুক্ত কিনা জানিনে, লোক যে আসছে, তা আমিও জানি, মোদি- যোগী-শাহ ও জানেন