এক মিনি সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল, ভগওয়া ঝান্ডা সর্বত্র, পঞ্জাবে বিজেপি শক্তিশালী নয়, সেখানে মানুষ কংগ্রেস আর আকালি দলের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, আপ জিতেছে। বাকি চার রাজ্যে বিজেপির জয়জয়কার। তো আগামী কয়েকদিন ধরে এই জয়, বিরোধীদের পরাজয় আর এই নির্বাচন থেকে উঠে আসা, রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করবো।
গতকাল বলেছিলাম, মূলত বি এস পি, কিছুটা হলেও আসাউদ্দিন ওয়েইসি সাহেবের এ আই এম আই এম আর কংগ্রেস, সমাজবাদী দলের ভোট না কাটলে ছবিটা অন্যরকম হত, কিন্তু কেবলমাত্র সেটাই নয়, কারণ আরও আছে, আমরা, মানে পলিটিকাল পন্ডিতরা, বিখ্যাত সাংবাদিক, ভোট বিশেষজ্ঞরা বহুবার দুটো কথা তো বলেইছি, এক হল কৃষক আন্দোলনের কথা, ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা আন্দোলন, যে আন্দোলনের কাছে শেষমেষ মাথা ঝুঁকিয়েছে মোদি সরকার, যে আন্দোলনের অন্যতম এপিসেন্টার ছিল পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, তো আমরা বলছিলাম এবারের নির্বাচনে হিন্দু মুসলমান কার্ড আর চলছে না, ৮০ – ২০র বিভাজনে মানুষ সায় দিচ্ছে না, কৃষক সমাবেশ থেকে শ্লোগান উঠেছে হর হর মহাদেও, আল্লাহ হু আকবর। কিন্তু সত্যিই কি তাই হয়েছে?
আমরা যখন উত্তরপ্রদেশ ঘুরছিলাম, অন্যদের থেকেও শুনেছি, বিজেপির পক্ষে দুটো কথা বারবার করে বলা হচ্ছিল, এক হল লাভার্থী, যারা র্যা শন পেয়েছে, কৃষক সন্মান নিধির টাকা পেয়েছে, একটা হলেও গ্যাস সিলিন্ডার পেয়েছে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ি পেয়েছে, সেই লাভার্থীরা নাকি বিরাট ভাবে ভোট দেবে বিজেপিকে।
দুই হল সুরক্ষা, মহিলারা বলছিলেন, পুরুষরা বলছিলেন হম সুরক্ষিত হ্যায়, আভি ডর নঁহি লগতা হ্যায়, যোগী সরকার বুলডোজার চলা দিয়া, থার্ড ফেজ থেকে তো যোগীর সভায় বুলডোজার হাজির হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী মঞ্চ থেকে বলছিলেন, বুলডোজার চল গিয়া, এমনকি সমাজবাদী দলের মঞ্চ থেকে স্বয়ং অখিলেশ যাদব বলছিলেন বুলডোজার বাবা কি অব নঁহি চলেগি, আমরা এই সুরক্ষার ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখিনি, দেখিনি কারণ হাথরস, দেখিনি কারণ উন্নাও, দেখিনি কারণ গোরখপুরে ব্যবসায়ী খুন, দেখিনি কারণ লখিমপুর খেরিতে কৃষকদের গাড়ির চাকার তলায় পিষে মারার ঘটনা আমাদের সামনে ছিল, দেখিনি কারণ ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, নারীদের ওপরে নির্যাতন, অপরাধের সংখ্যা সারা ভারতের মধ্যে উত্তরপ্রদেশেই সবথেকে বেশি।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: ভোটের আমি, ভোটের তুমি……
আমরা ভেবেছিলাম এই সুরক্ষার ব্যাপারটা আর্বান মিডল, আপার মিডল ক্লাসের ন্যারেটিভ, তাদেরই কথা, যারা বিজেপিকে ভোট দিয়ে এসেছে। কিন্তু তলায় লুকিয়েছিল অন্য আরেক ভয়ংকর ন্যারেটিভ, এই সুরক্ষার প্রশ্ন সেখানেই এসেছে, যেখানে মুসলমান জনসংখ্যা বেশি, যেখানে অন্তত ১০ থেকে ৪০ – ৫০% মুসলমান আছে, সাধারণ মানুষ, এমনকি গরীব মানুষও আসলে যা বলছিলেন, তা হল যোগী সরকার মুসলমানদের টাইট করে দিয়েছে, মুসলমান গুন্ডারা হয় জেলে নয় এনকাউন্টারে মারা গেছে, যোগী সভায় সভায় আতিক খান, আজম খানের কথা বলছিলেন, মানুষ সেই ন্যারেটিভটা নিয়েছে, গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এই ন্যারেটিভ, আমরা সুরক্ষিত, কারণ যোগী সরকারের আমলে মুসলমানরা ভয় পেয়েছে, তারা সন্ত্রস্ত, আমাদের ঘরের বহু বেটি এখন সুরক্ষিত।
হ্যাঁ বিজেপি পেরেছে, এই বিষ চারিয়ে দিতে, তারা বোঝাতে পেরেছে যে মুসলমানদের নজর তোমাদের বহু বেটিদের দিকে, তাই আমরা লাভ জেহাদ কানুন এনেছি, তাই আমরা অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড তৈরি করেছি, তাই হিন্দু যুবা বাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাই গরু আর ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, হিন্দুরা সুরক্ষিত, সেই সুরক্ষা এনে দিয়েছে যোগিজী, ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভূমিহার তো বটেই, তারপরের নন যাদভ ওবিসি, নন জাঠভ দলিতদের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে সেই বার্তা, পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে তোমরা সুরক্ষিত, গভীরভাবে তৈরি করা হয়েছে মুসলমান বিদ্বেষ, আমরা বুঝতে পারিনি, অনেকেই বুঝতে পারেনি।
পশ্চিম থেকে পূর্বাঞ্চলে এই ন্যারেটিভ, এই পার্সেপশন ছড়িয়েছে, হিন্দু ভোট কনসোলিডেশন হয়েছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই বিষ ছড়িয়ে যাবার কথা যদি বিরোধী রাজনৈতিক দল বুঝতে পারতো, তাহলে প্রথম থেকেই এই ভুয়ো প্রচারের বিরুদ্ধে তুলে ধরা হত বিপর্যস্ত আইন শৃঙ্খলার খতিয়ান, এন সি আর বির তথ্য তুলে ধরা যেত, বলাই যেত যে নারীদের ওপর অত্যাচারের ঘটনায় সারা দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে এই বুলডোজার বাবার সরকার, কিন্তু তা করা হয় নি।
বলা হয়েছে মূল্যবৃদ্ধির কথা, বলা হয়েছে বেরোজগারির কথা, কিন্তু সে সব ইস্যুকে ছাপিয়ে গেছে এই কল্পিত শত্রুকে ঠান্ডা করে দেবার জয়গাথা, লাভ জেহাদ কানুন এসেছে, আমাদের সম্ভ্রম কেড়ে নেবার আর কোনও সুযোগ নেই, মুসলমানরা টাইট হয়ে গেছে, ভোটের বাক্স উপচে পড়েছে।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: কী বলছে উত্তরপ্রদেশ?
হ্যাঁ কিছুটা হলেও লাভার্থী কাজ করেছে, চুড়ান্তভাবে সফল এই সুরক্ষার প্রচার, বিজেপি সরকার, যোগী সরকারের বিরুদ্ধে অ্যান্টি ইনকম্বান্সি তো ছিলই, ভোট তো বেড়েছে সমাজবাদী দলের, ২৩ – ২৪ % থেকে এক লাফে ৩৪% ভোট, কিন্তু বিজেপিরও ভোট বেড়েছে, সঙ্গে মায়াবতী, আসাউদ্দিন ওয়েইসির ভোট কাটার হিসেবের ওপর ভর করে বিজেপি ২৭৩।
আসলে, বিজেপির নির্বাচন জেতার ফর্মুলা একটাই, রাজ্যের, দেশের হিন্দু জনসংখ্যার ৫৫ – ৬০% ভোট পেতে হবে, পেলেই জয় হাতের মুঠোয়, দেখুন না উত্তরপ্রদেশে, হিন্দু জনসংখ্যা ৮০% তার ৫৫% পেয়েছে বিজেপি, মুসলমান ভোট? ইন্সিগনিফিক্যান্ট, কিছু পেয়েছেন, তা গুনতির মধ্যে আসে না, এবং সেই হিন্দু ভোটের ৫৫ – ৬০% কি তার বেশি পাবার জন্যই চুড়ান্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়েছে, তার ফলও পেয়েছে বিজেপি।
এবং এইখানে একটা কথা বলা দরকার, এরকম প্রচার তো বিজেপি আমাদের বাংলাতেও করেছিল, কাঁথির খোকাবাবু বলেনি? ঐ ৩০% ভোট আমার দরকার নেই, আমাদের দরকার ঐ ৭০% ভোট, সেদিনও একইভাবে বিষ ছড়ানো হয়েছিল, সেদিনও মুসলমান বিদ্বেষী বিজেপির নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মমতাজ বেগম বলেছিল, বলেছিল এ রাজ্যে মুসলমান তোষণ চলছে, বলেছিল মুসলমান অপরাধীদের আস্কারা দিচ্ছে মমতার সরকার, অন্যদিকে সংযুক্ত মোর্চার মঞ্চ থেকেও সেই অপপ্রচারকেই তোল্লা দেওয়া হয়েছিল, সেই প্রচার কেন কাজ করলো না? বাংলায় কাজ করলো না, কিন্তু উত্তরপ্রদেশে কাজ করলো কেন?
তার কারণ হল বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রচারের বিরুদ্ধে একটা সম্প্রিতীর ন্যারেটিভ তৈরি করতে পেরেছিল, বাংলার শাশ্বত বিবেকের কাছে সেই অপপ্রচারের জবাবকে তুলে ধরতে পেরেছিল, এবং সেই কাজ ঐ কদিনের নির্বাচনী প্রচারেই নয়, সারা বছর ধরে লাগাতার করা হয়েছিল, প্রতিটা জনসভায় সম্প্রিতীর সুর শোনাচ্ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কাঁথির খোকাবাবু, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ বা আদিত্যনাথ যোগীর চুড়ান্ত সাম্প্রদায়িক প্রচারের ফাঁদে পা দেন নি বাংলার মানুষ, এবং মাথায় রাখুন এ রাজ্যে মুসলমান ভোট প্রায় ৩৩%, হিন্দু ভোট ৬৬%, হ্যাঁ ৫০% হিন্দুদের ভোট পেয়েছে বিজেপি, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, প্রতিদিন মমতা মাঠেই ছিলেন, এই সাম্প্রদায়িক প্রচার কে রুখেছেন, সংখ্যালঘু মানুষজন ভরসা পেয়েছেন, সংখ্যাগুরু মানুষজন খোকাবাবুদের সাম্প্রদায়িক প্রচারে কান দেন নি, ঠিক উল্টোটা হয়েছে উত্তর প্রদেশে, সারা বছর পড়াশুনো না করে, পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়াশুনো করতে বসেছিলেন অখিলেশ যাদব, প্রচুর খেটেছেন, কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না,
বিজেপির টোয়েন্টিফোর ইন্টু সেভেন প্রচারের সামনে দাঁড়াতেই পারেন নি অখিলেশ যাদব, এই দানবীয় প্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেন নি অখিলেশ, কারণ ভোটের আগে তিন মাস কি চার মাস মাঠে নেমে কিছু নেতাদের দলে নিয়ে আসলেই সমীকরণ পালটে যাবে না, মমতাকে দেখুন, জগন রেড্ডিকে দেখুন, কে চন্দ্রশেখর রাওকে দেখুন, পিনারাই ভিজয়নকে দেখুন, নিদেনপক্ষে কেজরিওয়ালকে দেখুন, মাঝে মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, তার ফাঁকে দেশের রাজনীতি করলে কোনও রকমে টিঁকে থাকা যাবে, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না, কোনও শর্টকাট রুট দিয়ে বিজেপিকে সরানো অসম্ভব, সারা বছর, প্রতিটা দিন, প্রতিটা ঘন্টা থাকতে হবে মানুষের মাঝখানে, রাস্তায়।
কোথায় ছিলেন অখিলেশ যাদব, যখন কৃষকরা আন্দোলন করছিলেন? কবার গেছেন তাঁদের ধরণা মঞ্চের তলায়? কতজন আন্দোলনরত কৃষক বা কৃষকনেতাদের সাহায্য করেছেন? লখিমপুর খেরি থেকে হাথরস, ঘটনাস্থলে গেছেন অখিলেশ? যেতে হবে, মানুষের প্রতিটা লড়াইয়ের পাশে থেকে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে গড়ে তুলতে হয়।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: ধর্ষকের জন্য জেড সিকিউরিটি, কেন?
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে যাঁরা যাঁরা পরিবর্তন এনেছেন, সে এক জমানায় বামপন্থীদের কথাই বলুন, ৭৭ এ জয়প্রকাশ নারায়ণের কথাই বলুন, এ বাংলায় মমতার কথা বলুন, প্রত্যেকেই মানুষের আন্দোলনের সঙ্গে থেকেই সরকারের পরিবর্তন এনেছেন, এ শিক্ষা ভুলে গেলে চলবে না। সবকিছুর পরেও এটা তো সত্যি যে ৪৭ আসন পাওয়া এক দল আজ নিজেই ১১১, প্রায় আড়াইগুণ বেড়েছে, ভোট বেড়েছে ১০%, বহু মানুষ এসেছেন সঙ্গে, তাদেরকে নিয়েই আগামী দিনের লড়াই এর ডাক দিতে হবে।
এটা তো ঘটনাই যে ইউ পি নির্বাচনে সমাজবাদী দল জিতে গেলে, ২০২৪ এর লড়াইটা অনেক সোজা হত, কিন্তু এটাও তো নয় যে এই নির্বাচনে হেরে গেলে আগামী ২০২৪ জেতা যাবে না? আমরা এই বাংলায় ৩৫কে ২২০ হতে দেখেছি, ২৩৫কে শূণ্য হতেও দেখেছি, মানুষকে একবার, দুবার, তিনবার বোকা তো বানানোই যায়, চিরটা কাল বোকা বানানোর খেলা চলে না, চলতে পারে না।
কিন্তু আলোচনা এখানেই শেষ নয়, কারণ ৫ রাজ্যের নির্বাচনে কংগ্রেসের ভূমিকা, তাদের হার আর আম আদমি পার্টির উঠে আসার প্রেক্ষিতেও নতুন সমীকরণ আছে, রাজনীতির সেই প্যাঁচ পয়জার নিয়ে কাল কথা বলা যাবে।