ইয়ে লড়াই, উসসে বহত আগে জা চুকি হ্যায়, ইয়ে লড়াই অশসি বনাম বিশ কি হো চুকি হ্যায়, ব্রামহিন ইস লড়াই কা আগুয়া করেঙ্গে। উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ এই কথা বললেন, সরল বাংলায়, এই লড়াই অনেক এগিয়ে গেছে, এই লড়াই এখন ৮০ বনাম ২০ র মধ্যে, এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেবে ব্রাহ্মণরা, প্রবুদ্ধ সমাজের মানুষ জন। সোমবার এই কথা বললেন যোগী আদিত্যনাথ, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন শুরু, তিনি এই কথা বললেন, উপস্থিত বিজেপি সমর্থকরা জয় শ্রী রাম বলে চিৎকার করল, হাততালিতে ফেটে পড়ল।
উত্তর প্রদেশে কমবেশি ২০% মানুষ মুসলমান। কেউ ঘাড় ধরে এই অর্বাচীনকে জেলে পুরল না, নির্বাচন কমিশন একটা কথাও বললো না, এটাই এখন নিও নর্মাল, মাস্ক পরার মতন, দো গজ কি দুরি রাখার মতন, গোটা উত্তর প্রদেশ জুড়ে এই সাম্প্রদায়িক প্রচারই এখন নিও নর্মাল, অত্যন্ত স্বাভাবিক। মুখ্যমন্ত্রী যে কথা বললেন, ভক্তরা, বিজেপি নেতারা তার শত গুণ জঙ্গিপনা দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক, দেখাচ্ছেনও।
পুরবাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়ে, রাস্তাতে সামরিক বিমান নামা, বিরাট বিরাট বিকাশের পোস্টার এখন সরে গেছে, মুখোশ খুলে হায়নার দল নেমে পড়েছে ভোট শিকারে, হাতে মুখে পায়ে রক্ত লেগে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যোগিজী এই কথা প্রথম বললেন? না, এই কথাই তিনি বলে থাকেন, কুর্সিতে বসা ইস্তক তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর মন্ত্রীসভা, তাঁর সরকার, তাঁর প্রশাসন দেশের সংখ্যালঘুদের দেশের নাগরিক বলেই মনে করে না, তারা দেশদ্রোহী, তারা ক্রিমিনাল, তারা মাফিয়া অতএব, জিরো টলারেন্স, তারা যদি বাঁচতে চায়, তাহলে তাদের মাথা নীচু করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়েই বাঁচতে হবে, নাহলে এনকাউন্টার হবে, জেলে পোরা হবে, মামলার পর মামলা চড়িয়ে জীবন অতিষ্ট করে দেওয়া হবে, যেমনটা করা হয়েছে ডঃ কাফিল খানের, একজন ডাক্তার যখন রেহাই পান নি, তখন বাকিদের কী হবে, হচ্ছে বুঝে নিন।
আমাদের রাজ্যের প্রত্যেকের মনে আছে, এই ৮০ – ২০ র খেলার কথা আমাদের রাজ্যে বলেছিল কাঁথির খোকাবাবু, অবশ্য সেটা ছিল বাংলার সংগে তাল মিলিয়ে ৭০ আর ৩০ এর লড়াই এর গল্প, বলেছিল, আমার ৩০ % এর ভোট দরকার নেই, ওটা মমতাজ বেগমের জন্য থাক, আমার ঐ ৭০ ই দরকার, বাংলার মানুষ কথা শুনেছেন, কয়েকটা বেশিই দিয়েছেন, ৭৭ টা। অবশ্য তা তো হারাধনের ১০ টি ছেলের মত, রোজ কমে যাচ্ছে। ঐ প্রবল বিষ ছড়ানোর পরেও, ঐ সুবিশাল প্রচার আর কোটি কোটি টাকা খরচ করার পরেও, ৩৮ % এর একটু কম ভোট পেয়েছে বিজেপি, এই বাংলায়। তার মানে, যাদের কাঁথির খোকাবাবু ৭০% বলছিল, তাদের ৫০% ও বিজেপিকে ভোট দেয় নি, আর এই মুহূর্তে ভোট হলে? বাংলায় গোটা ১০ আসন পাবে কিনা সন্দেহ আছে।
সেদিন কাঁথির এই বিশ্বাসঘাতক, যে কথা বলেছিল, আজ উত্তর প্রদেশের যোগিজী, সেই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন মাত্র। অনেকেই এই খুল্লম খুল্লা প্রচার দেখে হতবাক, আমি কিন্তু অবাক হই নি। কারণ এটাই আর এস এস বিজেপির মূল লক্ষ্য, এটাই তাদের দর্শন। মুখে হাজার রকম বিকাশ, উন্নয়ন ইত্যাদির কথা বলেই যাবে, কিন্তু আসল প্রচারটা এই ধর্মীয় মেরুকরণকে ঘিরেই, এই বিষবাস্প ছড়িয়েই তারা ভোট কুড়োবে, আসুন সেই পদ্ধতিটার দিকে নজর দিই।
বিজেপির উথ্বান জঙ্গী হিন্দুত্ববাদের হাত ধরেই, রামমন্দির, রথযাত্রা, রথযাত্রার রাস্তা জুড়ে দাঙ্গা, এসবের বদলেই বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু হাতে পূর্ণ বহুমত, বা পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, ১৩ দিনের সরকার ইত্যাদির শেষে অটলজির ৫ বছরের সরকার, দাঁড়িয়েছিল বহু শরিকের সমর্থনের ওপর, যারা আবার সেই অর্থে গর্ব সে কহো হাম হিন্দু হ্যায়, জয় শ্রীরাম, বচ্চা বচ্চা রামকা, জনমভূমী কে কাম কা ইত্যাদি শ্লোগান দিতেন না, কাজেই অটলজি যখন দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের জন্য ইন্ডিয়া শাইনিং এর ডাক দিলেন, তখন মানুষ বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছিল, কোথায় শাইনিং? এ তো ডাইং। শিল্প, অর্থনীতির দুর্দশা, বেকারদের চাকরি নেই, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি দেখে মানুষ অন্য দিকে ঝুঁকেছিল, সেই শিক্ষাটা বিজেপি মনে রেখেছে। ইন্ডিয়া শাইনিং বলেই ভোট পাওয়া যাবে না, এই পাঠ তারা অনেক আগেই তারা পেয়ে গেছে, তারা অপেক্ষা করছিল পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার, পেয়ে গেছে মুখোশ খুলেছে।
একবার স্মৃতির গোড়ায় টোকা মারুন, ২০১৪ র সাধারণ নির্বাচনের সময়ে, মোদিজীর যে কোনও নির্বাচনী বক্তৃতা বের করুন, শুনুন। তিনি মহিলাদের নিরাপত্তার কথা বলছেন, বাণিজ্য ঘাটতির কথা বলছেন, বেকারত্বের কথা বলছেন, কৃষক আত্মহত্যার কথা বলছেন, অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা দেবার কথা বলছেন। কচিত কদাচিৎ রাম মন্দিরেরও কথা বলেছেন বটে, কিন্তু তা ছিল দুলাইন কথা মাত্র। এবার ২০১৯ এর বক্তৃতার ভিডিও বার করুন, শ্লেষ ব্যঙ্গ সংখ্যালঘুদের নিয়ে, লুঙ্গি পরা মানুষদের নিয়ে, দর্শক এখন আরও জঙ্গী, তাদের মুখে জয় শ্রী রাম এখন যুদ্ধের হুঙ্কার, কথায় কথায় অযোধ্যা মন্দিরের কথা, পালটে গেছেন মোদিজী? না পাল্টান নি, মুখোশটা খুলে ফেলেছেন মাত্র, এবার তিনি প্রকৃত আর এস এস প্রচারক, তিনি ১৫ লাখ টাকার কথা বলছেন না, নোট বন্দী করেছেন, তার কথা বলছেন না, তিনি বেকারত্বের কথা বলছেন না, তিনি বাণিজ্য ঘাটতি কিম্বা ধুঁকতে থাকা শিল্প বা এম এস এম ই নিয়ে, একটা কথাও বলছেন না, তিনি চান ঐ ৭০% এর ভোট, কাঁথির খোকাবাবু তখন তৃণমূলে ঘাপটি মেরে বসে আর এস এস এর পাঠ, ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
এসব আমরা দেখেছি, পর পর প্রত্যেকটা রাজ্যে ইস্যু ধর্ম, সম্প্রদায়, ইস্যু মুসলিম জনসংখ্যা, বাংলায় সে প্রচার ছিল নগ্ন, নোংরা। কিন্তু মানুষ? যেখানে বিকল্প পেয়েছে, একটা শক্তপোক্ত বিকল্প যেখানে হাজির হয়েছে, একবারও ভাবে নি। সেই আবহেই এবার গোয়া, মণিপুর, উত্তরাখন্ড, পঞ্জাব আর উত্তরপ্রদেশে ভোট। আবার মোদি – শাহ – যোগী জানেন, বিকাশ নেই, সে সেই কবেই গরু চরাতে গেছে, তাদের ভরসা হিন্দু ভোটের মেরুকরণ, তাদের ভরসা সাম্প্রদায়িক প্রচার, তাদের হাতিয়ার বিকৃত জঙ্গী হিন্দুত্ববাদ। আমরা আগামী কদিন এই মিনি সাধারণ নির্বাচন নিয়েই কথা বলব, এই নির্বাচনের রায় কেন অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে আলোচনা করব, কোন রাজ্যে কেমন প্রচার, রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে, তাদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করবো। কী হতে চলেছে, এই পাঁচ রাজ্যে তা নিয়েও আলোচনা করব বৈকি। আজ সেই আলোচনার শুরুয়াত,
কোন রাজ্যে কেমন প্রচার, রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে, তাদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করবো। কী হতে চলেছে, এই পাঁচ রাজ্যে তা নিয়েও আলোচনা করব । আদিত্যনাথ যোগী সুর চড়াচ্ছেন, আপাতত মধ্যগগনে তাদের প্রচার, প্রধানমন্ত্রী দু দফায় বিরাট প্রচার করে গেছেন, তিনি তানপুরা বেঁধে দিয়েই গেছেন, যোগী, মৌর্যরা সেই সুর সেধেই চলেছেন। এমনটা মনেই হয়েছিল যে, কনফড় নাথ সম্প্রদায়ের সন্যাসী, আদিত্য নাথ যোগীই প্রচারের বর্শা মুখ হবেন। তিনিই ২০১৪ এর নরেন্দ্র মোদীর মত, বিজেপির পোস্টার বয় হয়ে উঠবেন, তাঁকে নির্বাচিত করার জন্য নরেন্দ্র মোদীর প্রয়োজন হবেই না, কিন্তু দেখা গ্যালো না, এখনও রাশ নরেন্দ্র মোদীর হাতে, লড়াই চলছে, কিন্তু তা দু নম্বর আসনকে ঘিরে, যোগী – শাহের লড়াই, কে থাকবেন দ্বিতীয় নম্বরে? যদি আদিত্য নাথ যোগী আগের মতই ৩১০/৩২০ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফেরেন, তাহলে মোটাভাইকে এ জন্মের মত প্রথম আসনের কথা ভুলেই যেতে হবে, ২০২৪ এ যোগীজিই হবেন স্টার ক্যাম্পেনার, আরএসএস তার কাঙ্খিত মুখ খুঁজে পাবে, আরও সোজাসুজি, আরও ক্রুর, আরও হিংস্র এক হিন্দুত্বের পোস্টার বয়।
যোগিজী যদি হেরে যান, তাহলে অমিত শাহের কল্যাণে ২০২৪ এ গোরখপুরের সাংসদ পদও জুটবে না, যদি কোনও রকমে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে বিজেপির সরকার তৈরি হয়, তাহলে কোনওভাবেই যোগিজীর মুখ্যমন্ত্রিত্ব জুটবে না, এ কথা আদিত্য যোগী নিজেও জানেন, আর জানেন বলেই মুক্তকচ্ছ হয়ে প্রচারে নেমেছেন, বিষের গামলা নিয়ে মাঠে, তাঁকে জিততেই হবে, তাঁকে আগের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অন্তত কাছাকাছি যেতেই হবে, তাই এই ৮০ আর ২০ এর কথা নিয়ে তিনি নামলেন, আগামী দিনে আরও তীব্র হবে ওনার কন্ঠ, আরও অনেক বিষ জমে আছে তাঁর তূনীর এ। কারণ এতশত করেও প্রত্যেক সমীক্ষায় বিজেপি ৪০ কি ৪১% ভোটেই দাঁড়িয়ে, অখিলেশ ৩৩ কি ৩৪% এ, এমনিতে তো সমস্যা নেই, কিন্তু লড়াই টা যদি বিজেপি আর সমাজবাদী দলের মধ্যে হয়ে যায়, দলীয় মেরুকরণ? যেমনটা আমরা দেখেছিলাম বাংলায়? তাহলে কংগ্রেস বা বি এস পি আরও কম ভোট পাবে, ৬০% বিরোধী ভোটের মেরুকরণ যোগী সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনবে, এটা যোগিজী জানেন, জানেন বলেই ৮০ – ২০ র গল্প বলছেন, বিষ ছড়াচ্ছেন।
কিন্তু এসবের পরেও ধস নামছে, একের পর এক বিজেপি মন্ত্রী নেতারা দল ছাড়ছেন, আরও দিশেহারা বিজেপি নেতৃত্ব, মোদি – যোগী – শাহ এবার আরো তীক্ষ্ণ করছেন ধর্মীয় মেরুকরণের সাম্প্রদায়িক প্রচার, অযোধ্যা থেকে যোগীজীকে লড়িয়ে সেই জিগির তোলারই চেষ্টা। কিন্তু তাতেও তরী তীরে ভিড়বে? আগামী কদিন ধরে এ নিয়েই আলোচনায় থাকব আমরা।