কিছুদিন ধরেই বিজেপির সময়টা ভালো যাচ্ছে না৷ বা বলা ভালো বেশ খারাপ কাটছে সময়৷ তামিলনাড়ুর মিউনিসিপ্যাল, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের নির্বাচনের ফলাফল এল৷ ডিএমকে আর তার সহযোগীরা ৯০% আসনে জয়ী। বিজেপির ভোট ৫% এর একটু কম। এই প্রথম তারা একক দল হিসেবেই নির্বাচনে নেমেছিল৷ ফলাফল খুবই হতাশা জনক। এরপরের খবর এল ওডিশা থেকে৷ এখানে বিজেপির হাল তো তামিলনাড়ুর মতো ছিল না৷ কিন্তু তার পরেও হাওয়ায় উড়ে গেল পদ্মফুল৷ আবার প্রায় ৯৩% আসনে বিজেডি, কারণ খুঁজে বের করার আগেই এই বাংলায় ১০৮ টা মিউনিসিপ্যালিটির মধ্যে শূন্য বিজেপি, যারা ক’দিন আগে সরকার তৈরি করার কথা ভাবছিল৷ কেবল শপথগ্রহণ বাকি ছিল৷ মন্ত্রিত্ব পদ নিয়ে মন কষাকষিও নাকি হচ্ছিল, তারা ১০৮-এ শূন্য কেবল নয়, বামেদেরও পিছনে, মানে বামেরা দ্বিতীয়, বিজেপি তৃতীয়, বামেরা অন্তত তাহেরপুর ধরে রেখেছে, বিজেপির হাতে মর্তমান কলা।
এরই মধ্যে পাঁচ রাজ্যে ভোট, পাঁচ রাজ্যের মধ্যে চার রাজ্যে তাদেরই সরকার৷ একটাও হারা মানে পিছিয়ে পড়া। নির্বাচন শেষ, রোজ এ গল্প সে গল্প৷ এ মিছিল তো সে মিটিং৷ সংবাদ মাধ্যমের পোয়াবারো৷ এক বিজেপিরই নাকি ৭০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বাজেট৷ প্রসাদ পেতে কি আকুলি বিকুলি, ভোট হবার আগেই ওপিনিয়ন পোল৷ এগিয়ে বিজেপি, এগিয়ে বিজেপি, সংবাদ পাঠকই বলে দিচ্ছেন মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়৷ রাশি রাশি বিজ্ঞাপন ঝরে পড়ছে৷ কাগজের প্রথম পাতা আর টেলিভিশনের প্রাইম টাইম জুড়ে বিজেপি৷ কিন্তু মহাকাল ঘুরছে, সময় বয়ে যায় নিরবধি, তাই নির্বাচন শেষ হল, নেক্সট ইভেন্ট এক্সিট পোল, বিজ্ঞাপন চাই, দর্শক চাই, ইভেন্টের পরে ইভেন্ট চাই৷ কোন জিতেগা ইয়ে মহারণ? কোন জিতেগা ইউপি কা কিলা? কিসকে হাথ মে রাজদন্ড? কোন বৈঠেগা সিংহাসন পর? নির্বাচন নয় তো, যেন মধ্যযুগের ইতিহাস, পাতায় পাতায় যুদ্ধ।
কারণ নির্বাচনের উত্তেজনাকে জিইয়ে রাখতে হবে৷ কী দিয়ে? এক্সিট পোল দিয়ে, সেটা কী? এক বিজ্ঞানসম্মত হিসেব নিকেশ, ম্যাথমেটিকাল এক্সারসাইজ, গণনার আগেই বলে দেওয়া, গণনার ফলাফল। সবসে সঠিক, সবসে ভরোসামন্দ। অঙ্ক কাকে বলে? আমাদের দেশের এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স পাশ করা প্রধান সেবক ছাড়া সব্বাই জানে, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার মানে, এ স্কোয়ার প্লাস বি স্কোয়ার প্লাস টু এবি। তো ইয়ে টু এবি আয়া কঁহাসে? সাধারণ গুণ করলেই ওটা এসে যাবে, সে থাক, কিন্তু একটা কথা সত্যি যে হাজার চেষ্টা করলেও ওটা এ কিউব বা থ্রি এবি হবে না, হতে পারে না, কারণ ওটা অংক।
আর বিজ্ঞান? ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি স্কোয়ার, আপনি যেভাবেই তার হিসেব নিকেশ করুন, বিজ্ঞান সেই একই কথা বলবে, আইনস্টাইন তা প্রমাণ করেছেন। কিন্তু, কিন্তু একজিট পোল হল সেই বিজ্ঞান বা সেই অঙ্ক, যা ক্রমশ পরিবর্তনশীল, মানে যে কোম্পানির হাতে থাকবে, তাদের মত ফলাফল বের হবে৷ তাই একজন বলছে বিজেপি ২২০ টা আসন পাচ্ছে, অন্যজন বলছে বিজেপি ৩২৬ টা পাচ্ছে, ৩৩০ও হয়ে যেতেই পারে, একজন বলছে উত্তরাখন্ডে বিজেপি জিতছে, একজন বলছে কংগ্রেস জিতছে, একজন বলছে পঞ্জাবে আপের ল্যান্ড স্লাইড ভিক্ট্রি, অন্যজন বলছে হাং অ্যাসেমব্লি, এবং এটাই নাকি অঙ্ক৷ এটাই নাকি বিজ্ঞান।
এবং সেই বিজ্ঞান বোলনেবালা, অঙ্ক কপচানেবালাদের ট্র্যাক রেকর্ড? বেশিদিন আগের নয়, এর ঠিক আগেই হয়ে যাওয়া বাংলার নির্বাচন, তার এক্সিট পোলের হিসেবটা দেখে নেওয়া যাক।
কি বলা হয়েছিল বাংলার বিধানসভার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে? পোল অফ পোলস, মানে সবকটা এক্সিট পোলের একটা গড়, তাতে বলা হল, তৃণমূল দল ১৪১ টা আসন পাবে, মানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে ৬ টা কম, বিজেপি ১৩৮ টা পাবে মানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে ৯ টা কম, সিপিএম, কং, আব্বাসের সংযুক্ত ফ্রন্ট পাবে ১৩ টা আসন, মানে তাদের হাতেই থাকবে বিধানসভার চাবিকাঠি, ওদিকে বিজেপি মহল বলছে, এ আর এমন কি? তৃণমূল থেকেই তো ৪০/৫০ জন বেরিয়ে আসবে, যোগাযোগও শুরু হয়ে গিয়েছে, নাচন কোদন শুরু।
একবার বিভিন্ন দোকানদারদের হিসেবটা দেখা যাক, সি ভোটারের সমীক্ষা বলছে, তৃণমূল ১৫৮, বিজেপি ১১৫, সংযুক্ত মোর্চা ১৯। অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া বলছে, বিজেপি ১৪৭, মানে সরকার গড়ছে, তৃণমূল ১৪৩, ২ টো আসন সংযুক্ত মোর্চা। রিপাবলিক – সিএনএক্স জানাল, বিজেপি ১৪৩, তৃণমূল ১৩৩, সংযুক্ত মোর্চা ১৬। জন কি বাত এর হিসেবে বিজেপি ১৭৪, তৃণমূল ১১২, সংযুক্ত মোর্চা ৬। ইন্ডিয়া টিভি বিজেপিকে দিল ১৯২ টা আসন, তৃণমূল কে ৮৮ টা আসন আর সংযুক্ত মোর্চা কে১২ টা আসন, মানে বিজেপির বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
ইভিএম খুলল, ফলাফল? তৃণমূল ২১৫, মানে আগের থেকে ৪ টে আসন বেশি, বিজেপি ৭৭ আর সংযুক্ত মোর্চার সবেধন নীলমণি আব্বাসের দল পেল ১ টা আসন, এটাকে কি বিজ্ঞান বা অংক বলা যায়? সেদিনও অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া থেকে সি ভোটার, জন কি বাত ইত্যাদি সমীক্ষকরা, জোরগলায় একটা হিসেব দিয়েছিলেন, চরম ভুল প্রমাণিত হয়েছিল, এদের একজনও কি পরে বলেছেন, কেন ভুল হয়েছিল? কোন কোন কারণে তাদের অংক বা বিজ্ঞান ভ্রান্তিতে ভরা ছিল? বলেন নি, কারণ বলার কিছুই নেই। ১০ টা দোকান আছে, ১০ রকমের হিসেব দেবে, কারোর ১টা মিলে গেলেই কলার তুলে বলবে, দেখেছেন, সবসে সঠিক গণনা। পচা আম দিলে, পচা খাবার দিলে, বাজে খারাপ মেশিন দিলে সেই দোকানদারদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, ক্ষতিপূরণ চাওয়াই যায়, কিন্তু এই সমীক্ষকরা সেকরেড কাউ, পবিত্র গাভী, এনাদের ধরে জেলে পোরা হয় না, কারণ খেয়াল করে দেখবেন, এনারা মোটামুটি কেন্দ্রে বসে থাকা দলের পাদুকা লেহনে ব্যস্ত থাকেন, ওটাই তাদের ব্যবসা। থাক সে কথা, এবার আসুন ফলাফলে।
এটা তো পরিষ্কার যে উত্তরপ্রদেশে লড়াইটা হচ্ছে অখিলেশ যাদব বনাম মোদি, যোগী, শাহের। বিজেপি বনাম সমাজবাদী দলের। তো কেউ একজন জিতবে, এর বাইরে তো কিছু হবার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না, হয় অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হবেন, নাহলে যোগী বা বিজেপি দলের অন্য কেউ।
কেন একথা বলছি? কারণ যোগীর নেতৃত্বে বিরাট জয়, কমবেশি ২৮০/২৯০/৩০০ আসন নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলে যোগীই হবেন মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু ২১০/২২০/২৩০ আসন নিয়ে জিতলে যোগী ছিটকে যাবেন, সে অন্য গল্প, পরে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু যদি যোগী জিতে আসেন, মুখ্যমন্ত্রী হন বা যদি অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, দুটো ক্ষেত্রেই এক নতুন ইতিহাস রচনা হবে। কী সেই ইতিহাস? পাঁচবছর মূখ্যমন্ত্রী থাকার পর আবার জিতে এসে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, এমন ইতিহাস উত্তরপ্রদেশে নেই, কাজেই যোগী যদি আবার মুখ্যমন্ত্রী হন, তাহলে তিনি এক নতুন ইতিহাস রচনা করবেন, দেশের সবথেকে বড় রাজ্য, দিল্লির গেটওয়েতে যোগী হবেন অপ্রতিরোধ্য।
অন্যদিকে যদি অখিলেশ জিতে আসেন, তাহলে তিনিই প্রথম রিজিওনাল বা আঞ্চলিক দলের নেতা হবেন, যিনি বিজেপি শাসিত সরকারকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসবেন। বিজেপি ক্ষমতায় আছে, এমন কোনও সরকারকে কোনও আঞ্চলিক দলের নেতা হারাতে পারেনি, এটাও একটা রেকর্ড। সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলের গুরুত্ব বিরাটভাবে বাড়বে, এক নতুন ইতিহাস রচনা হবে।
তাহলে সম্ভাবনা তিনটে৷ এক হল, যোগীজির প্রত্যাবর্তন। দুই হল, বিজেপির প্রত্যাবর্তন, যোগীজির নয়, তিন হল, অখিলেশের জয়। এবং এই ভুতুড়ে এক্সিট পোল নয়, একমাত্র ইভিএম খোলার ঘন্টা চার পরেই এই ফলাফল বের হবে, তার আগে নয়। তাহলে একটা সাধারণ প্রশ্ন তো থাকেই, এই সমীক্ষকরা কেন এরকম করছেন?
আসলে এনারা বাজার অর্থনীতির একটা অংশ, বাজারকে ক্রমাগত নতুন নতুন প্রোডাক্ট দিতে থাকা, নতুন চমক, নতুন প্যাকেজিং তৈরি করা, প্রথমে ঝাগ ওলা টুথ পেস্ট, মানে প্রচুর ফেনা হবে, তারপর ক্লোরাইড ওলা টুথপেস্ট, তারপর নমকওলা টুথপেস্ট, এখন মেডিকেটেড টুথপেস্ট বলে আসলে এক ও অকৃত্রিম এক প্রোডাক্ট বেচে চলা বাজারের মত, এনারা মিথ্যে বিক্রি করছেন, নানান নামে, নানান কায়দায়। কখনও সখনও মিলে গেলে তো বল্লে, বল্লে।
অতএব, দিল থামকে বৈঠিয়ে মেরে দোস্ত, পিকচার আভি বাকি হ্যায়।