হীরাবেন মোদি ১০০ তে পা দিলেন৷ তো দেশের ইভেন্ট ম্যানেজার নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি এটাকে এক বড় ইভেন্টের মতই পালন করবেন, স্বাভাবিক। ১৮ জুন তিনি চলে গেলেন আমেদাবাদে, তাঁর মায়ের বাড়িতে। গাড়ি ঢুকল, দরজা খুলল, মোদিজি নামলেন না৷ নামলেন না কারণ তখন সবে নেমেছেন ক্যামেরাম্যান, ভিডিও ক্যামেরাম্যান৷ তিন চার সেকেন্ড পরে হাজির এক স্টিল ক্যামেরাম্যান৷ তাঁরা ভেতরে গেলেন, রেডি, অ্যাকশন৷ মোদিজি গাড়ি থেকে নামলেন৷ স্ক্রিপ্টেড ইভেন্ট। প্রণাম, আশীর্বাদ, বাড়ির ঠাকুরের সামনে বসা, মায়ের আরতি, ছেলের আরতি, মায়ের পা ধোয়ানো, পা ধোয়া জল চোখে দেওয়া, এই প্রথম দেখলাম, এতদিন জানতাম পাদোদক, পা ধোয়া জল মুখে দেয়, উনি হাইজিন মেনে চোখে দিলেন। মা মুখে মিষ্টি তুলে দিলেন, মোদিজি মিষ্টি খেলেন, মা মুখ পুঁছিয়ে দিলেন, ফুল ইভেন্ট ক্যামেরাবন্দি হওয়ার পর এক নাতিদীর্ঘ লেখা, নাকি মোদিজির ব্লগ, পৌঁছে গেল সংবাদমাধ্যমে।
ইভেন্টের নাম, মায়ের জন্মদিন এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশে সেদিন ছাত্র যুবরা রাস্তায়, রহনে দো। বাস জ্বলছে, ট্রেন জ্বলছে, জ্বলনে দো। লাঠি চলছে, চলনে দো। সেদিন কেন আজ অবদি মোদিজি ওই অগ্নিপথ নিয়ে, একটা কথাও বলেননি৷ সেদিন তো বলার প্রশ্নই ছিল না। কবে? ১৮ জুন, ২০২২। তার মানে নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজির মা, হীরাবেন মোদির জন্ম হয়েছিল ১৮ জুন ১৯২২এ৷ ইতিহাস বলছে ১৮৫৮ এ ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই সিপাহী বিদ্রোহ চলাকালীন, ওই ১৮ জুন এ প্রাণ দিয়েছিলেন। তো তিনি ছিলেন ঝাঁসির রানী, দিন, সাল মনে রাখার যথেষ্ট কারণ ছিল। মোদিজী তো তখন জন্মানইনি৷ কে রাখলো সেই হিসেব? রাখে অনেকেই রাখে৷ কিছু শতায়ু মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তাঁদের অনেকেরই বেশ মনে আছে দিন ও সাল৷ কারোর কারোর ছেলে বা মেয়ে হলপ করে বলেন, অমুক দিন অমুক তারিখ আমার মা জন্মেছিলেন৷ কোনও কোনও প্রবীণ মানুষ, তাঁর জন্ম সালের সঙ্গে, তার আগে পিছে ঘটে যাওয়া বড় ঘটনাকে মনে করতে পারেন৷ আমি জন্মেছিলাম যে বছর গান্ধিজি এসেছিলেন চম্পারণে৷ জানা গেল, জানা হয়ে গেল তেনার জন্মসাল।
তো এক্ষেত্রে হীরাবেনের সুপুত্র মোদিজি, দেশের প্রধানমন্ত্রীই নিজেই জানাচ্ছন, তাঁর মা শতবছরে পা দিলেন। কিন্তু মোদিজি তো বহু বিষয়ে, তাঁর চা বেচার স্টেশন থেকে, গ্রাজুয়েশনের সাবজেক্ট, বহু ব্যাপারেই অনৃত ভাষণ করেছেন৷ এখানে বলে রাখি অনৃত ভাষণ মানে, মিথ্যে কথা বলা। তো সেই জন্যই একটু খতিয়ে দেখা যাক। উনি বলছেন, মানে ওনার সেই ব্লগে বলছেন, ওনার মা হীরাবেন, খুব ছোট্ট বেলায় তাঁর মাকে হারিয়েছেন, সেই দিদিমার মুখও মনে করতে পারেন না হীরাবেন, এবং এইখানে এসে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, সেই শিশু হীরাবেনের মা, মারা গিয়েছিলেন, স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারীতে, কবে? হীরাবেন তখন শিশু, ধরে নেওয়া যাক দু’বছর, কি তিন বছর। এবার অঙ্ক মিলছে না৷ আমাদের দেশে স্প্যানিস ফ্লু এসেছিল ১৮ জুন, ১৯১৮৷ তাকে তখন বোম্বে ফ্লু বলা হত। গান্ধিজির স্প্যানিস ফ্লু হয়েছিল ১৯১৮ সালে৷ গুজরাতে ছড়িয়েছিল, মারা গিয়েছিলেন গান্ধিজীর প্রপৌত্র। চলেছিল ২০২০ পর্যন্ত৷ হীরাবেন এ বছরে ১০০ তে পা দিলে৷ তাঁর জন্মসাল ১৯২২, দু বছর জুড়লে ১৯২৪ এ, তিন বছর জুড়লে ১৯২৫। কিন্তু অনেকেই বলতে পারেন, ১৯২০ তে শেষ হয়েছে মানে কী নির্মূল হয়েছে? দু-একটা ঘটনা তো পরেও ঘটতে পারে, হ্যাঁ ঘটতে পারে৷ দিলাম বেনিফিট অফ ডাউট। কিন্তু আবার কেলো, ২০১৭, ১৪ ডিসেম্বর ছিল গুজরাটের ভোট৷ সেদিন দেশের সব বড় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মোদিজীর মা, ৯৭ বছরের হীরাবেন মোদী ভোট দিতে এলেন।
তো ২০১৭ ডিসেম্বরেতে যদি ৯৭ হয়, তাহলে ২০২০ জুন মাসে ১০০ হওয়ার কথা, সেটা হলে ওই স্প্যানিস ফ্লুতে হীরাবেনের মায়ের মৃত্যু মিলে যাচ্ছে৷ কিন্তু ২০২০ তে হীরাবেন শতকে পা দিলে, তাঁর ১০০ বছরকে ইভেন্ট করা যেত না৷ কারণ সেই সময় লকডাউন চলছে৷ ২৪ শে মার্চ থেকে টোটাল লকডাউন। তাহলে এটা কি ডিলেইড ইভেন্ট? এ রকম তো হয়, জামাই জামাইষষ্ঠির দিনে ছুটি পেল না, পরের রবিবারে এল, হয় তো। এ রাজ্যের এক বাম যুব নেতা, ২২-এ এপ্রিলকে নিজের জন্মদিন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, লেনিনের জন্মদিনে তেনার জন্ম, এই ভেবে একটু উত্তেজনা, এই তো, তার বেশি কিছু নয়, সেটা ছিল খোকামি৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তো খোকা নন, খোকামি তাঁকে মানায় না। ২৭-এ ডিসেম্বর যখন দেশের বড় বড় কাগজে, তাঁর মায়ের ছবি বের হয়েছিল, তখন কি তিনি একবারও সেই সংবাদমাধ্যম, যা ততদিনে মোটামুটি গোদি মিডিয়া, তাদেরকে জানিয়েছিলেন? ৯৭ ভুল, ওটা ৯৫ হবে? জানাননি।
বয়স্ক মানুষজনের সঠিক বয়স নিয়ে অনেক সময়েই প্রশ্ন থাকে, থাকা স্বাভাবিক৷ কিন্তু উনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর মা, যে প্রধানমন্ত্রী আবার, সেই জন্মদিনকে ন্যাশন্যাল ইভেন্ট করে তুললেন। আসলে মিথ্যে কথার সমস্যা হল, তা হাজারটা নতুন মিথ্যের জন্ম দেয়, আমি বলছি না, মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন। তো মোদিজির এই ব্লগে এক নতুন চরিত্র এসেছে, সেই চায়ের দোকান ইত্যাদি আছে, কিন্তু রেল স্টেশন নেই৷ পুকুর আছে কিন্তু পুকুরের সেই মগরমচ্ছ, সেই কুমির নেই, এক নতুন চরিত্র যোগ হল, আব্বাস। কে এই আব্বাস? মোদিজির ছোট্ট বেলায় এই আব্বাস অনাথ হয়, মোদিজীর বাবা দামোদরদাস মূলচন্দ মোদিজি এই বাচ্চাটিকে বাড়িতে আনেন৷ মোদিজি এনার সঙ্গেই বড় হয়, ছেলেটি তাদের বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া শেষ করে, সেই আব্বাসকে হীরাবেন, মোদিজির মা ইদের দিনে পছন্দের খাবার বানিয়ে দিত, একটা সেকুলার আবহ তৈরি করলেন মোদিজি৷ সমস্যা হল এই আব্বাসের নাম আগে আমরা শুনিনি, বালক মোদিজির নামে ছবিতে জীবনী বের হয়েছে, ব্রিটিশ লেখক নরেন্দ্র মোদি, অ্যা পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি লিখেছেন, উমংগ কুমার ভান্দুলা খুব বাজে একটা ছবি তৈরি করেছেন, পিএম নরেন্দ্র মোদি৷ মোদিজির ভূমিকায় বিবেক ওবেরয়। এসবের কোথাও ওই আব্বাসের কথা শোনা যায়নি৷ কাতার, মধ্য প্রাচ্য সামলাতে জীবনীতে ঢুকল আব্বাস?
আসলে ওনার জীবনীতে কিস্তিতে কিস্তিতে নতুন চরিত্র ঢুকছে৷ পরেও আরো ঢুকবে। সে যাই হোক ঢুকে তো পড়েছে, এবার স্বাভাবিক প্রশ্ন গেল কোথায়? উনি তো মধুসূদন দাদা নন, আমরা ও আব্বাস দাদা, ও আব্বাস দাদা বললে উনি অবতীর্ণ হবেন না৷ কিন্তু জানতে ইচ্ছে করবেই, সেই আব্বাস এখন কোথায়? কিছুদিন আগেও রাজ্যসভায় ছিলেন বিজেপির মুক্তার আব্বাস নকভি, সবেধন নিলমণি, এবার টিকিট পাননি৷ তিনিই কি আব্বাস? দুষ্টু লোকেরা এসব প্রশ্ন করছেন। একজন মানুষ তো উবেযেতে পারেন না, আর মোদিজিই বা কেমন মানুষ, একটা বাচ্চার সঙ্গে অত বছর খেলাধুলো করলেন, খাওয়াদাওয়া করলেন, এমন নয় যে তাকে ভুলে মেরে দিয়েছেন, ঠিক সময় বুঝে তাঁর কথা জানিয়েছেন, কিন্তু তিনি গেলেন কোথায়? এই প্রশ্নের জবাব তিনি দেবেন না, কেন? অকালে মৃত্যু হয়েছে? কিভাবে? যখন আদবানির রথ ছুটছিল, রথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাঙ্গা হচ্ছিল, সেই তখন কোনও এক দাঙ্গায় মরে গেছেন ওই আব্বাস? নাকি গুজরাত দাঙ্গার সময়ে? বেস্ট বেকারির পুড়ে ছাই হওয়া লাশের মধ্যে ছিল নাকি আব্বাসের মৃতদেহ? হর হর মহাদেও, জয় শ্রী রাম নারা দিতে দিতে আগুন লাগানো হয়েছিল আব্বাসের গায়েও? আব্বাস গেল কোথায়? সেই আব্বাস, যিনি মুসলমান, যিনি আপনাদের বাড়িতেই ইদ পালন করতেন? হঠাৎ এক হদিশ এল আব্বাসের৷ তিনি এখন দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন, স্মস্যাতো কেবল ওনার আইডেন্টিটি নিয়ে নয়, মাননীয় মোদিজি, আপনার পরেই যে হিন্দুত্বের পোস্টার বয়ের ছবি হাজির হয়েছে, সেই আদিত্যনাথ যোগী, মুসলমান ধর্মের মানুষদের নিয়ে কী ভাবেন? তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, হিন্দু আর মুসলমান দুটো আলাদা আলাদা সংস্কৃতি, তারা কখনোই একসঙ্গে থাকতে পারে না৷ আপনি এই ক’দিন আগে সারা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ওই যোগীর হয়ে প্রচার করে এলেন, তাহলে প্রশ্ন তো থেকেই যায় যে আপনার ছোটবেলা আব্বাসের সঙ্গে কিভাবে কাটল? কিভাবে আপনার মা হীরাবেন ওই আব্বাসকে, এমনকি ইদের খাবার বানিয়ে খাওয়াতেন? নাকি আবার সবটাই মনোহর কঁহানিয়া? এবারে একটু গুছিয়ে করা হচ্ছে। আমরা বাঙালিরা ঘনাদা, টেনিদা কে নিয়ে গর্ব করতাম, এখন দেখছি তারা তো শিশু, এত অনৃত ভাষণের আগে কোনও প্রধানমন্ত্রীর মুখে আমরা শুনিনি, ও হ্যাঁ, আবার মনে করিয়ে দিই, অনৃত ভাষণ মানে মিথ্যে কথা।