এক মিনি সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল৷ ভাজওয়া ঝান্ডা সর্বত্র৷ পঞ্জাবে বিজেপি শক্তিশালী নয়৷ সেখানে মানুষ কংগ্রেস আর অকালি দলের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে৷ আপ জিতেছে। বাকি চার রাজ্যে বিজেপির জয়জয়কার। তো আগামী কয়েকদিন ধরে এই জয়, বিরোধীদের পরাজয় আর এই নির্বাচন থেকে উঠে আসা, রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করব। আজ কিছু আসন, আর সেই আসনগুলোর ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা যাক।
চলুন উন্নাও৷ কোন উন্নাও? সেই উন্নাও যেখানে উন্নাওয়ের স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক ‘সদয়’ হয়েছিলেন! আশ্বাস দিয়েছিলেন, আশা সিংয়ের দরিদ্র পরিবারের ওই নাবালিকাকে যা হোক একটা চাকরি দেবেন৷ মেয়েটি ও তাঁর পরিবার বিধায়কের বাড়িতে গিয়েছিলেন ১৭ বছরের সেই নাবালিকা৷ কিন্তু চাকরি নয় তাকে ধর্ষণ করা হল! উন্নাওয়ের স্থানীয় বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার তাঁকে ধর্ষণ করে, মেয়েটি অভিযোগ। দিনটা ছিল ২০১৭-র ৪ জুন। অভিযোগ তখনই প্রকাশ্যেও আসেনি৷ মেয়েটি নিখোঁজ। বাড়ি ছিল উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের মাখি গ্রামে৷ ১১ জুন থেকে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ ২০ তারিখ তাঁকে উদ্ধা্র করে পুলিশ। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দিতে ওই নাবালিকা জানান, কেবল বিধায়কজিই নয়, বিধায়ক কুলদীপের ঘনিষ্ঠ কয়েক জন, তাঁকে চাকরি দেওয়ার নাম করে গাড়িতে কানপুরে নিয়ে যাওয়ার পথে আবার ধর্ষণ করে৷ পুলিশের পরামর্শ, বিধায়ক কুলদীপের নাম বাদ দিতে হবে, তাহলে খোরপোশ এবং ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে।
কোথাও কোনও প্রতিকার না পেয়ে, তাঁরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে চিঠি লেখেন৷ তাতেও কাজ না হওয়ায় মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে, কুলদীপের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেন নির্যাতিতার মা। এরপরেও ব্যবস্থা হল না৷ উল্টে নাবালিকার পরিবারকে হেনস্থা করা শুরু হল। এরই মধ্যে ২০১৮-র ৩ এপ্রিল উন্নাও আদালতে শুনানির জন্য গিয়েছিলেন মেয়েটির বাবা৷ তাঁকে গাছে বেঁধে রড, বেল্ট, লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর করেন কুলদীপের ভাই অতুল ও তাঁর সহযোগীরা৷ এফআইআর করতে গেলে পুলিশ অতুলের নাম বাদ দেয়। এর পরেই বেআইনি অস্ত্র রাখার অভিযোগে, নির্যাতিতার বাবাকেই ওই রকম জখম অবস্থাতেই গ্রেফতার করে পুলিশ।
মুখ্যমন্ত্রী, যিনি নাকি বুলডোজার বাবা,পুলিশ বা রাজ্য প্রশাসনের কাছ থেকে কোনও সুরাহা না পেয়ে, চূড়ান্ত বিধ্বস্ত ও সন্ত্রস্ত পরিবারটি ২০১৮-র ৮ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ধরনায় বসে। সেখানেই নির্যাতিতা নাবালিকা, গায়ে আগুন দিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন। এর ঠিক পরের দিনই, পুলিশি হেফাজতে মেয়েটির বাবা রহস্যজনক ভাবে মারা যান। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা যায়, তাঁর রক্তে বিষক্রিয়া হয়েছে, অন্ত্রেও ফুটো আছে। এ ছাড়া সারা শরীরে আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন রয়েছে, কিসের আঘাত? জানা নেই।
বিরোধীরা আর কিছু মিডিয়া প্রশ্ন তুলতে থাকে৷ এলাহাবাদ হাইকোর্ট প্রশ্ন তোলে৷ এফআইআর দায়ের হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত বিধায়ককে গ্রেফতার করা হয়নি কেন? কুলদীপকে গ্রেফতার করে সিবিআই। এক অসম লড়াইয়ের একদিকে ক্ষমতা, লেঠেল বাহিনী, অন্যদিকে এ দেশের এক প্রান্তিক পরিবার! স্বাভাবিকভাবেই ঘটনা বইতে থাকে, রহস্যজনক ভাবে মারা যায়, নির্যাতিতার বাবার হত্যা রহস্যের অন্যতম সাক্ষী ইউনুস। এর পরের বছর, ২০১৯-এর ২৮ জুলাই রায়বরেলি যাওয়ার পথে একটি ট্রাক সরাসরি ধাক্কা মারে যে-গাড়িতে, সেই গাড়িতেই ছিলেন উন্নাওয়ের ওই নির্যাতিতা৷ তাঁর আইনজীবী মহেন্দ্র সিং, নির্যাতিতার কাকিমা ও তাঁর বোন। কাকিমা ও তাঁর বোনের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়৷ গুরুতর আহত হন ওই নাবালিকা ও তাঁর আইনজীবী৷ ট্রাকটির নম্বর প্লেট আলকাতরায় লেপা ছিল।
নাবালিকার মা, জেলবন্দি বিধায়কের বিরুদ্ধে এই দুর্ঘটনার অভিযোগ এনে এফআইআর দায়ের করেন। পুলিশ কিছুই খুঁজে পায় না৷ এই ঘটনার সঙ্গে৷ বিধায়কের যোগসাজস প্রমাণ হয়নি৷ তবে ওই নাবালিকাকে ধর্ষণের দায়ে, বিধায়ক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গারের যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা হয়েছে৷ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে বিজেপির সাংসদ, বহাল তবিয়তে সেখান থেকেই রাজনীতি চালাচ্ছে ওই বিধায়ক। তো সেই উন্নাও জেলাতে ৬ টা আসনে নির্বাচন হল৷ বিজেপি ৬ টাতেই জিতল৷ উন্নাও আসনে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল, নির্যাতিতার মা আশা সিংকে৷ তিনি ভোট পেয়েছেন মোট ১৫৫৫ টা৷ ০.৬৩%৷ জামানত জব্দ হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে এবার নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, নারী সুরক্ষা, মোদি, যোগী, শাহ প্রত্যেকটা জনসভায় এই কথাই বলেছেন।
এবার চলুন হাথরসে। তিনটে ভিডিও, সবাই দেখেছেন। ওই ভিডিওগুলোতে যা বলা হয়েছে সেটা তো শোনানো যায়, অন্তত দেশের আদালতের তাতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই৷ তার আগে বলে নিই, হাসরথ নির্যাতিতা মারা যাওয়ার আগে ডাইং ডিক্লারেশন দিয়েছিল, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০৷ মানে মারা যাওয়ার সাত দিন আগে৷ তার মানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট লেভেলের অফিসারের সামনে মারা যাবার আগে সে জানিয়েছিল, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ তাঁকে অত্যাচার করা হয়েছে৷ তাঁরই ওড়না গলায় পেঁচিয়ে তাঁকে খুন করার চেষ্টা হয়েছে৷ এই ডাইং ডিক্লারেশন আদালতে গ্রাহ্য৷ এই ডাইং ডিক্লারেশনের ভিত্তিতে বিচার হলে অভিযুক্তরা দোষী বলে সাব্যস্ত হবে।
এবার ভিডিও, তিনটে ছোট ছোট ভিডিও। প্রথম ভিডিয়ো টা চান্দপা থানা চত্ত্বরে, মেঝেতে কুঁকড়ে পড়ে আছে নির্যাতিতা, চারধারে পুলিশ, একই জামা পরে আছে, যা তার অন্য দুটো ভিডিয়োতেও দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত এটাই প্রথম ভিডিয়ো, ঘটনার খানিক পরেই, খানিকটা আচ্ছন্ন হয়ে নির্যাতিতা কথা বলছে যদিও তা বেশ পরিষ্কার, শোনা যাচ্ছে।
নির্যাতিতা- উফফ, গলা টিপে ধরেছিল।
পুলিস- কেন?
নির্যাতিতা- যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে,
পুলিস- কেন গলা চেপে ধরেছিল, বলো
নির্যাতিতা- আমাকে জোর করছিল (জবরদস্তি) আমি আটকাচ্ছিলাম।
পুলিস- কেন গলা চেপে ধরেছিল, বলো?
নির্যাতিতা- কেন? আমাকে জোর করছিল, আমি করতে দিইনি।
পুলিস- আচ্ছা
পুলিস- কী করে গলা চিপলো?
মহিলা পুলিস- কী করে গলা চিপলো, বলো
নির্যাতিতা- হাত দিয়ে
পুলিস- আর কোথাও চোট লেগেছে?
নির্যাতিতা- না, গলায়
মা জিব টা দেখা
নির্যাতিতা- জিব দেখাচ্ছে।
আসুন দ্বিতীয় ভিডিয়ো টা দেখে নিই। এটা এস টি নির্মল কুমার, কেরলের আইটি সেল আর স্যোশাল মিডিয়ার মাথা, তিনি টুইট করেছেন। এটা সম্ভবত থানা থেকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে।
নির্যাতিতা- সন্দীপ করেছে
পুরুষ কণ্ঠ- কি?
নির্যাতিতা- সন্দীপ করেছে
পুরুষ কণ্ঠ- কে?
নির্যাতিতা- সন্দীপ
পুরুষ কণ্ঠ- আর কে ছিল?
নির্যাতিতা- সন্দীপ আমার গলা টিপে ধরেছিল
পুরুষ কণ্ঠ- কেন সে এটা করলো
নির্যাতিতা- আমি ঘাস কাটতে গিয়েছিলাম
পুরুষ কণ্ঠ- হুম
নির্যাতিতা- ফির অন্দর (এরপর কিছু কথা শোনা যাচ্ছে না) বকরি কে পেড় কে পিছে, বা বকরি কে দুধ কে জগহ পে, মানে একটু দূরে,সম্ভবত একটা ঢাকা জায়গায় নিয়ে গেল, ওখানে নিয়ে গেল আমায়, জবরদস্তি করার চেষ্টা করছিল, আমি বারণ করছিলাম, আমার গলা টিপে ধরল।
পুরুষ কণ্ঠ- কোনও ঝগড়া ঝাটি ছিল?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
মা সে তো ছিলই।
আসুন, এবার তৃতীয় ভিডিয়োটা শুনে নিই। এটা জামিয়া মিলিয়া হাসপাতালে। গলায় একটা কলারের মত পরানো, ভেন্টিলেটরে আছে, মুখে মাস্ক।
নির্যাতিতা- কিছু একটা বলছে, সেটা শোনা যাচ্ছে না।
নির্যাতিতা- একবার আবার
পুরুষ কণ্ঠ- একবার আবার রেপ করার চেষ্টা করেছিল?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ ওই ভাইয়েরা মিলে
পুরুষ কণ্ঠ- আগে
নির্যাতিতা -হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ- আচ্ছা, এর আগেও একবার ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ- করেছিল?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ -তো কী হয়েছিল?
নির্যাতিতা- আমি ওখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম।
পুরুষ কণ্ঠ -পালিয়ে এসেছিলে? তারপর?
নির্যাতিতা- তারপর আমাকে দেখে রবি (রবি আর একজন অভিযুক্ত)
পুরুষ কণ্ঠ- কিছু হয়েছিল?
নির্যাতিতা- সন্দীপকে জিজ্ঞেস কর, (সম্ভবত নির্যাতিতা রবিকে বলেছিল)
পুরুষ কণ্ঠ- আচ্ছা
নির্যাতিতা- ফোন করে, সন্দীপকে জিজ্ঞেস কর
পুরুষ কণ্ঠ- আচ্ছা
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ – তারমানে রবি জিজ্ঞেস করছিল, কিছু হয়েছে নাকি?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ, আমি বুঝে গেলাম যে ওরা দুজনে মিলেই এটা করছে
পুরুষ কণ্ঠ- আচ্ছা
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ- ওরা দুজনে মিলে
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ- তো সেবারে আপনি বেঁচে গেছিলেন, তারপর?
নির্যাতিতা -সেদিন আবার হলো
পুরুষ কণ্ঠ- ওই দিন যেদিন আপনার চোট লেগেছে, সেদিন রেপ করেছিল?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ- ওই দুজনেই ছিল নাকি আরও কেউ ছিল?
নির্যাতিতা- ওরা দুজনে ছিল, বাকিরা পালিয়ে গেছিল।
পুরুষ কণ্ঠ- আচ্ছা বাকিরা পালিয়ে গিয়েছিল?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ মাকে দেখে।
পুরুষ কণ্ঠ- তো মাকে দেখে পালিয়ে গেল?
নির্যাতিতা – হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ – তো আপনার সেই সময়ে জ্ঞান ছিল
নির্যাতিতা- কিছুটা ছিল
পুরুষ কণ্ঠ- কিছুটা জ্ঞান ছিল?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
পুরুষ কণ্ঠ – তো আপনাকে রেপ করা হয়েছিল?
নির্যাতিতা- হ্যাঁ
পুরুষকণ্ঠ- তো আপনি তারপর কী করলেন?
নির্যাতিতা- তারপর মা মুখে জল দিল, জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, মেয়েটি মারা যায়। সেদিনই তাঁর মৃতদেহ এনে বাড়ির কিছুটা দূরে, মাঝরাতে জ্বালিয়ে দেওয়া হল, মেয়েটির বাবা মাকেও সেখানে আসতে দেওয়া হল না৷ পুলিশ পাহারায় মৃতদেহ পুড়ে ছাই হয়ে গ্যালো।
সেই হাথরসেও নির্বাচন হয়েছে৷ হাথরস সিডিউল কাস্ট সংরক্ষিত আসন৷ সেখানে ৫৮% এর বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়েছে বিজেপি৷ জিতেছেন এক মহিলা, অনজুলা সিং মাহর৷ তিনি পেশায় আইনজীবী৷ সাড়ে চার কোটি টাকার মালকিন৷ কিন্তু সিডিউল কাস্ট প্রতিনিধি। উত্তরপ্রদেশে এবার নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, নারী সুরক্ষা, মোদি, যোগী, শাহ প্রত্যেকটা জনসভায় এই কথাই বলেছেন। তাহলে এই নির্বাচন আমাদের কী বলল? কী বেরিয়ে এল নির্বাচনের ফলাফল থেকে? ভাবুন, ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন৷