যিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে, আম চুষে খায় না চেটে খায় না কামড়ে খায় এরকম প্রশ্ন করেছিলেন, সেই কানাডার নাগরিক অক্ষয় কুমার দুঃখ প্রকাশ করেছেন কদিন আগে৷ বলেছেন, আমাদের দেশে ইতিহাস ঠিক করে লেখাও হয় না, পড়ানোও হয় না। এসব বলার ক’দিন পরেই আমাদের ছোটা মোটা ভাই অমিত শাহ, বললেন আমাদের দেশের ইতিহাস মানেই মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস৷ মুসলমান শাসিকদের ইতিহাস৷ কোথায় হিন্দু সম্রাটরা? চোল, চালুক্য, গুর্জর, প্রতিহার, রাজপুত হিন্দু রাজাদের কথা তো আমাদের ছাত্রদের পড়ানোই হয় না৷ ইতিহাসের রাজাদের হিন্দু আর মুসলমান বলে ভাগ করে দিলেন৷ যেমনটা ভোট চাওয়ার সময় করেন আর কী৷ এবার ইতিহাস নিয়ে সেটাই করছেন। আসলে ইতিহাস কী, ইতিহাস কী ভাবে তৈরি হয়, কোন কোন সূত্র থেকে কী ভাবে ইতিহাস বেরিয়ে আসে, সেসব জানার বা বোঝার দরকার নেই এনাদের৷ এনাদের ইতিহাসে দুটো ধারা, হ্যাঁ খেয়াল করে দেখুন দুটো ধারা, হিন্দু আর মুসলমান, খাবার? হিন্দু আর মুসলমান। পোশাক? ওই হিন্দু আর মুসলমান। ভাষা, সংস্কৃতি, সব সব কিছু ওই হিন্দু আর মুসলমান। লড়াই মুসলমানদের সঙ্গে, যে লড়াই আজও তারা জারি রেখেছেন, যে লড়াই তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি।
তো সেই অক্ষয় কুমার যিনি এই রাজনীতি নয়, এই রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে ঝরে ঝরে পড়া প্রসাদপুষ্ট, তিনি ইতিহাসের কথা বলছেন, কখন? তাঁর অভিনীত সিনেমা সম্রাট পৃথ্বীরাজ রিলিজ হওয়ার আগে৷ এর আগে তেনার ছবি বচ্চন পান্ডে মুখ থুবড়ে পড়েছিল৷ কিন্তু চোখের সামনে ঘৃণা আর বিষ ছড়ানো কাশ্মীর ফাইলসকে, কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করতে দেখেছেন৷ দেখেছেন মোদি, যোগী, শাহ, আরএসএস – বিজেপি মিলে কিভাবে একটা ছবির ক্যাম্পেন করেছে৷ তিনি এবার সেই ক্যাম্পেনটাই করাতে চাইছিলেন৷ তাই পৃথ্বীরাজ চৌহানের মাথায় গেরুয়া পাগড়ি আর হাতে গেরুয়া ঝান্ডা নিয়ে সিনেমার পর্দায়৷ ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখলেন যোগী, নাকি ২৫ বছর পর পরিবারকে নিয়ে ছবি দেখলেন অমিত শাহ৷ কিন্তু এসব ক্যাম্পেন কাজে দেয়নি৷ আবার মুখ থুবড়ে পড়েছে অক্ষয় কুমারের পৃথ্বীরাজ চৌহান৷ বার বার লোককে বোকা বানানো যায় নাকি?
আরও বড় কথা হল, দ্য কাশ্মীর ফাইলসে রক্তের স্বাদ পেয়েছে সাম্প্রদায়িক মানুষজন৷ তাকে হালকা ঘোল খাওয়াতে গেলে সে তো আপত্তি করবেই, করেছে। তবে সেটা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, আমাদের আলোচনা পৃথ্বীরাজ চৌহান আর সমকালীন ইতিহাস নিয়ে, ইংরেজরা ভারতবর্ষের ইতিহাসকে প্রাচীন হিন্দু সাম্রাজ্যের ইতিহাস, পরে প্রায় ৭০০ বছরের ইসলামিক শাসনের ইতিহাস, শেষে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস, এই তিন ভাগে ভেঙে, আসলে তাদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিকে খাড়া করতে চেয়েছিল। সাভারকার, হিন্দু মহাসভা, আরএসএস ইত্যাদির ইতিহাস সেই পথ ধরেই এগিয়েছে৷ মহান এবং প্রাচীন হিন্দু সাম্রাজ্য, রামরাজ্য ভার্সেস ইসলামিক শাসন, মোগল শাসন,হিন্দু বনাম মুসলমান এর ইতিহাস, অথচ ইতিহাস তো এমন ছিল না। রাজা, সম্রাট, নবাব, সুলতানরা তো আসলে প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করে, বিপুল ধন সম্পদের ওপর নিজের কবজা, নিজের দখলদারি বজায় রাখার এক ব্যবস্থা করেছিল, সেটাও বংশ পরম্পরায়। রাজা, নবাব, সম্রাট বা সুলতান অত্যাচারী বা প্রজাহিতৈষী৷ যাই হোক না কেন, তাদের আরাম, বিলাস, প্রাসাদ, মৃগয়া থেকে বিরাট বৈভব তো আসত প্রজাদেরই পয়সায়, সেই ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য তারা ধর্মকে ব্যবহার করেছে, পুরুত, পাদ্রি, মোল্লারা তাদের ব্যবহার করেছে, তোরা খা, আমাদেরও খেতে দে, এই আশ্বাসেই ধর্ম আর রাজসিংহাসন চলেছে যুগ যুগ ধরে, রাজা সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেছেন ঋষি, মুনি, পয়গম্বরদের৷ তাঁরা মানে সেই ঋষি, মুনি পয়গম্বরেরা প্রজাদের সামনে বলেছেন, দেখো ইনিই হলেন ইশ্বর প্রেরিত সেই মানুষ, যিনি আমাদের রক্ষা করবেন৷ ব্যস, মিটে গেল।
সাধারণভাবে যে ধর্ম যখন শক্তিশালী হয়েছে, রাজা, নবাব, সুলতান, সম্রাটরা সেই ধর্মকে, তাদের উপাসক, তাদের উপাসনাস্থল ইত্যাদিকে সাহায্য করেছে, সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু তাদের প্রধান বিবেচ্য ছিল, তাঁদের রাজত্বের বিস্তার, আরও সম্পদ, আরও বিলাস বহুল জীবন, আরও ক্ষমতা। ঠিক সেই কারণেই, হিন্দু রাজারা, হিন্দু রাজাদের সঙ্গে লড়েছেন, মেরেছেন, হেরেছেন, জিতেছেন। যদি হিন্দু ধর্মেরই শাসন হত, তাহলে হিন্দু রাজায় রাজায় যুদ্ধ তো হত না, এমনকি পুরাণের রঘুকুলপতি রাম লড়ছেন কার সঙ্গে? শ্রেষ্ঠ ধার্মিক, ব্রাহ্মণ রাবণের সঙ্গে। দক্ষিণেই হোক উত্তরেই হোক বিভিন্ন মতের হিন্দু রাজা, সম্রাটরা একে অন্যের বিরুদ্ধে বড় বড় যুদ্ধ করেছেন, আমরা জানি। এরপর বৌদ্ধ ধর্ম এল, রাজারা সেই ধর্মকে স্বীকার করলেন, অহিংসা, সত্য, ধর্মের পাঠ এল৷ কিন্তু রাজ্য বিস্তার থেমেছে? যুদ্ধ থেমেছে? হত্যা থেমেছে? থামেনি। এরও পরে পশ্চিম থেকে শক, হূণ, পাঠান মোগল এল, সবাই মুসলমান ছিল? না, মুসলমান নয় এমন সম্রাট, যোদ্ধারাও এসেছিলেন, খান শুনে মুসলমান হবেই, মনে করে আর এস এস, বিজেপির দল, কিন্তু যেখান থেকে মোগল সাম্রাজ্যের সূত্রপাত, সেই স্বয়ং চেঙ্গিজ খান ও মুসলমান ছিলেন না, তিনি টেঙ্গিজম এর ফলোয়ার ছিলেন, কিন্তু আক্রমণকারীও ছিলেন, অজস্র উপাসনা স্থল ভেঙেছেন, লুঠ করেছেন, সে সবই নিজের ধন দৌলতের জন্য। তো সেই মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠি ধর্মের সম্রাট, নবাব, তাতার, শক, হূণ, পরবর্তীতে মোগলরা এল পশ্চিম দিক থেকে, কাদের সাহায্য নিয়ে?
প্রতিটা ক্ষেত্রেই দেশের মধ্যের হিন্দু রাজারা তাদের সাহায্য করেছেন৷ বিবেচ্য বিষয় ছিল, তাদের সাম্রাজ্য, তাদের ধন দৌলত, ধর্ম নয়। এরপর এক বিরাট ঐতিহাসিক সময়ে আমরা দেখেছি, এমনকি ঔরঙ্গজেবকেও কামাখ্যার মত মন্দিরের রিনোভেশন, পুনর্নির্মাণের জন্য জমি এবং অর্থ দান করতে৷ আবার সেই তিনিই মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, কেন? ধর্মের জন্য? না সেই মন্দির যাঁদের সেই রাজপুত নেতাদের সঙ্গে বিরোধিতার জন্য, তাদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য৷ আমরা এই বিশাল সময়ে দেখব এই ৬৫০/ ৭০০ বছরের ইসলামিক, মুঘল শাসনে বহু হিন্দু রাজার সেনাপতি, অস্ত্রাগারের মাথায় বসে থাকা মানুষ মুসলমান ছিলেন, বহু মুসলমান শাসনের মাথায় বসে থাকা সেনাপতি, রাজকর্মচারী হিন্দু ছিলেন, এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে, উদাহরণ আগেও দিয়েছি। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা যে শিবাজি মহারাজের কথা বলে, সেই ছত্রপতি শিবাজির ১৩ জন অন্যতম সেনাপতি ছিলেন মুসলমান, দৌলত খান, ইব্রাহিম খান, সিদ্দি ইব্রাহিম, সিদ্ধি হিলাই, সিদ্দি ওয়াহা, নূরখান বেগ, শমা খান, হুসেইন খান মিয়ানি, সিদ্দি মিস্ত্রি, সুলতান খান, দাউদ খান আর মাদারি মেহেতার৷ মোদি শাহের একজন মুসলমান সাংসদও নেই। আকবরের সভায় টোডরমল, রাজা মান সিং ছিলেন তো। আবার ওই ইসলামিক শাসনের সময় হিন্দু ধর্ম উড়ে পুড়ে গিয়েছে, এমনটাও ইতিহাস বলছে না৷
সম্রাট আকবরের শাসনকালে তুলসীদাস অযোধ্যায়, বেনারসে গঙ্গার ধারে, চিত্রকূটের জঙ্গলে বসে রামচরিত মানস রচনা করেছেন৷ জাহাঙ্গির সিংহাসনে বসেছেন, সেই তুলসীদাসী রামায়ণ পুড়িয়ে ফেলার চক্রান্ত হয়েছে, চক্রান্তে কারা জড়িত? বেনারসের ঘাটের হিন্দু পান্ডারা, এক অব্রাহ্মণের লেখা রাম চরিত মানস তাদের পছন্দ নয়, সংস্কৃত নয়, খড়ি বোলিতে লেখা হচ্ছে রামায়ণ, সাধারণের ভাষায়, তাদের ঘোর আপত্তি ছিল, সেই রাম চরিত মানসের পান্ডুলিপি বাঁচাল কারা? কিছু ধার্মিক মুসলমান মানুষ জন। তাঁরা লুকিয়ে রেখেছিলেন ওই পুঁথি৷ এটাই আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাস৷ সে সব ইতিহাস সত্যিই কম পড়ানো হয়েছে৷ কিন্তু হিন্দু রাজাদের ইতিহাস পড়ানো হয়নি? অক্ষয় কুমার ইতিহাস পড়েছেন? মানে আদৌ পড়াশুনো করেছেন? আমার জানা নেই, কিন্তু দেশের এন সি আর টি র ইতিহাস বই যদি দেখেন, তাহলে অনায়াসে পাবেন, অশোক থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, পৃথ্বীরাজ চৌহান থেকে শিবাজি, মারাঠা সাম্রাজ্য থেকে রাজপুতানার ইতিহাস, মহারাণা প্রতাপ সিং এর থেকে চোল, চালুক্য, গুর্জর প্রতিহার রাজাদের ইতিহাস, পড়ানো হয় তো, হ্যাঁ তাঁদের ইচ্ছে মতন হিন্দু রাজা হিসেবে নয়, রাজ্যের শাসক হিসেবেই পড়ানো হয়।
আজ এতদিন পরে হঠাৎ শ্রীমান পৃথ্বীরাজকে বেছে নেওয়ার কারণ কী? অক্ষয় কুমারের এই বেছে নেওয়ার পিছনেও ধর্ম নেই, বাণিজ্য আছে, বিজেপির এই হিন্দু – মুসলমান বাইনারির মধ্যে, একটা বাণিজ্য লুকিয়ে আছে, মুসলমান ঘৃণা বেচলে পয়সা আসে, তাই পৃথ্বীরাজের মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, তাকে বার বার একজন হিন্দু সম্রাট বলা হচ্ছে, আর তার বিরুদ্ধে মহম্মদ ঘোরি। ইতিহাস বলছে, সম্রাট পৃথ্বীরাজ আজমের থেকেই তাঁর শাসন চালিয়েছেন, তার দুটো কারণ, দিল্লি তখনও ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, আর দিল্লির শাসনে তিনি বসিয়েছিলেন তাঁর এক ভাইকে, কিন্তু বড় চড় কে দিখানা হোগা, দিল্লির তখত এ বসানো হল পৃথ্বীরাজকে। পৃথ্বীরাজের শাসন কালের অর্ধেকেরও বেশি সময় গিয়েছে, পাশাপাশি রাজপুত রাজাদের সঙ্গে লড়াই করতে, যার ফলে সেই গুজ্জর, তাঁর আজমেরের পাশের হিন্দু রাজারা ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে, যারা ঘোরির সঙ্গে লড়াই এ ঘোরি কে সাহায্য করেছিল, ছবিতে সেসব নেই, পৃথ্বীরাজ আর ঘোরি, ব্যস, সেই একই ন্যারেটিভ, একই বাইনারি, চৌহান বনাম ঘোরি, হিন্দু বনাম ইসলাম। এবারে তরাই এর যুদ্ধ ১১৯১ এ পৃথ্বীরাজ জিতলেন ঘোরির বিরুদ্ধে, ঘোরি ফিরে এল আরও শক্তি সঞ্চয় করে, ১১৯২ এ পৃথ্বীরাজ হেরে গেলেন৷ এরপরের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক আছে৷ কিন্তু ওই আজমের থেকে পাওয়া কিছু স্বর্ণমুদ্রা সে সমস্যার সমাধান করেছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে ফারসি ভাষায় পৃথ্বীরাজ এবং মহম্মদ ঘোরির নাম লেখা৷ তার মানে দ্বিতীয় তরাই এর যুদ্ধে, ১১৯২ সালে পৃথ্বীরাজ হেরে যাবার পরেও, তাঁকে আজমেরের সিংহাসনেই বহাল রেখেছিলেন ঘোরি, এরকমটা তখন হতই, তুমি সিংহাসনেই থাকো, আমাকে কেবল খাজনাটা দিয়ে যেও৷ এমন ব্যবস্থাই হয়েছিল৷ কিন্তু কিছুদিন পরে পৃথ্বীরাজ বিদ্রোহী হয়ে ওঠায়, তাঁকে হত্যা করে, মহম্মদ ঘোরি তাঁরই এক ভাইকে আজমের সিংহাসনে বসায়। এখন এ ইতিহাস তো দেওয়া যাবে না৷ তাহলে হিন্দু গৌরবের কাঁথায় গ্যামাক্সিন, তাই এই ছবিতে পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর প্রায় ৪০০ বছর পরে লেখা, পৃথ্বীরাজ রসো, এক কবিতা গ্রন্থকেই ইতিহাস বলে চালিয়ে দেওয়া হল৷ যেখানে পৃথ্বীরাজ অন্ধ, শব্দভেদী বাণ দিয়ে খুন করছেন মহম্মদ ঘোরিকে৷ যদিও ইতিহাস বলছে, পৃথ্বীরাজ চৌহান মারা যাওয়ার পরে অন্তত ১০ বছর, হ্যাঁ ১০ বছর রাজত্ব করেছে মহম্মদ ঘোরি, এটাই ইতিহাস৷ কিন্ত অক্ষয় কুমার গল্পের গরুকে গাছে তুলে, তাকেই ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন, গরু মাটিতে আছড়ে পড়েছে, সিনেমাও।
এখনও বাজারে আম আছে অক্ষয় ভাইয়া, ভাল হিমসাগর, চৌসা, ল্যাংড়া নয়ে প্রভুর পায়ের সামনে বসে, চিবে, চেটে, কামড়ে গিলে খান আম, সেটাই বরং মানাবে আপনাকে৷ ইতিহাস নিয়ে আর একটাও অশিক্ষিত কথা নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা কোনও কানাডার নাগরিক, আমার দেশের পাঠ্যপুস্তকে কী থাকবে, তা বলার অধিকার পেল কবে থেকে?