পি কে, আমরা প্রথম শুনেছিলাম মীরা নায়ারের মনসুন ওয়েডিং ছবিতে৷ চরিত্রের নাম ছিল পি কে দুবে৷ সে একটু কায়দা করে বলতো, পি কে ডুবে। ২০০১ সালের ফিল্ম৷ পি কে দুবে বিয়েবাড়ির প্যান্ডেল সাজাত, কথার ফুলঝুরি ছেটাত। এরপর ২০১৪-র শুরুতেই এল, আমির খানের পিকে। এক ভিনগ্রহের জীব, দেখতে মানুষের মত, তার উল্টোপালটা কথা শুনে সবাই বলত, পিকে আয়ে হ্যাঁয় কেয়া? তো চরিত্রটির নাম হয়ে গেল পি কে৷ অনেকেই দেখেছেন৷ কিন্তু সেই বছর শেষ হবার আগেই দেশে হাজির আর এক পি কে৷ প্রশান্ত কিশোর৷ ভারতীয় জনতা পার্টির ইলেকশন স্ট্রাটেজিস্ট, চায় পে চর্চা থেকে আরও অনেক নতুন নতুন স্ট্রাটেজি নিয়ে হাজির, কাক বসায় তাল পড়ল, নাকি তাল পড়ার আগে কাক বসল কিনা জানা নেই৷ কিন্তু ২০০৯ তে বিজেপি পেয়েছিল ১১৬টা আসন, পি কে আসার পর বিজেপি পেল ২৮২ টা আসন৷ আমরা সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে জানলাম পি কের নাম, তখনও আই প্যাকের নাম ততটা পরিচিত হয়নি।
এরপর পিকে শিবির বদলালেন৷ তিনি বিহারে গিয়ে এক অসাধ্য সাধন করলেন৷ যুযুধমান দুই শিবির, নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড আর লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল হাত মেলাল৷ বিজেপি হেরে গেল৷ দুই দলের গঠবন্ধন ছিল এক মাস্টারস্ট্রোক৷ ২০১৪-র পর ২০১৫-তে আবার পি কে সফল। এরপর ২০১৭-তে পঞ্জাবে অমরিন্দ্র সিংহের হাত ধরলেন পিকে৷ ২০১২ তে কংগ্রেস পঞ্জাবে পেয়েছিল ৪৬৷ ২০১৭ তে পেল ৭৭। আবার সফল পিকে এবং তাঁর আই প্যাক।
ইতিমধ্যে তিনি মিডিয়ার নজর কেড়েছেন৷ ওদিকে নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছেন, অর্থাৎ কেবল ইলেকশন স্ট্রাটেজিস্ট, একজন প্রফেসনাল নয়, তাঁর রাজনৈতিক আকাঙ্খাও ছিল, বোঝা গেল। এরপর ইউ পি, ২০১৭,
ইউপি কো ইয়ে সাথ পসন্দ হ্যায়
সাইকিল ঔর ইয়ে হাত পসন্দ হ্যায়
তরক্কি কি ইয়ে বাত পসন্দ হ্যায়
এই ছিল স্লোগান, অখিলেশ আর রাহুলের ছবি, হম সাথ সাথ হ্যায়। ফলাফল? সাংঘাতিক খারাপ, ২০১২ তে কংগ্রেস পেয়েছিল ২৮ টা আসন, ২০১৭ তে মাত্র ৭ টা আসন। সাইকেল আর হাত মিলল না৷ পি কে ডুবে।
এরপর তিনি অন্ধ্রপ্রদেশে, ২০১৯ এ ওয়াই এস আর রেড্ডির ছেলে জগন রেড্ডির হাত ধরলেন, জগন রেড্ডি৷ ২০১৪ তে পেয়েছিলেন ৭০ টা আসন, এবার পেলেন ১৫১ টা আসন৷ আবার সফল পি কে৷ প্রশান্ত কিশোর, ততদিনে তিনি নীতীশ কুমারের সঙ্গে দুরত্ব বাড়িয়েছেন, দল ছেড়েছেন।
২০২০-তে দিল্লির নির্বাচন, কঠিন ছিল সেই নির্বাচন৷ ৫ বছরের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি ছিল, বিজেপি দিল্লিতে একটা সফল দাঙ্গা করাতে পেরেছিল, সব মিলিয়ে কেজরিওয়াল জিতবেন কি না, তাই নিয়ে সংশয় তো ছিলই। ২০১৫ তে আপ পেয়েছিল ৬৭ টা আসন, এবার ৭০ টা আসনের বিধানসভায় ৬২ টা আসন৷ আবার সফল পি কে। এরপর ২০২১, তামিলনাড়ুর স্টালিনের হাত ধরলেন পি কে৷ ২০১৭ তে ডি এম কে পেয়েছিল ৯৮ টা আসন, এবার ১৫৯। এবং বাংলা, ৫ বছরের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি শুধু নয়, নির্বাচনের আগে দল থেকে বের হলেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা, টলিউডের সাতে পাঁচে না থাকা দাদা এবং কুচুবুলুর দলের চিৎকার শুনে মনে হল, বিজেপি ক্ষমতায় এসেই গিয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে পুরো মন্ত্রিসভা, অব কি বার ২০০ পার।
ওদিকে মমতা ঘুরছেন, আইপ্যাক কাজ করছে, সিভিল সোসাইটির এক বিরাট অংশ নো ভোট টু বিজেপি স্লোগান তুলেছে, তারপরেও অনেকের মনে হয়েছিল, নেক টু নেক লড়াই, কাঁটে কা টক্কর, কেবল পি কে সমানে বলে চলেছেন, বিজেপি ১০০ পার করবে না, বিজেপি ৭৭ এ থামলো, তৃণমূল ৫ বছরের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গতবারের চেয়ে আরও চারটে বেশি আসন পেল, ২১৫। পি কে আবার সফল। স্ট্যাটিসটিকস বলছে, আপাত দৃষ্টিতে পি কে, প্রশান্ত কিশোর সফল, ১০০ তে ৯০ পেলে তাকে সফল তো বলতেই হবে, আজ সেই সফলতা আর পি কে কে নিয়েই আলোচনা।
তবে তার আগে একটা ছোট্ট বিরতি
২০১৪ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পিকের এই সফলতার পিছনে কারণটা কী? এর মানে কি এটাই যে পি কে যে দলের সঙ্গে থাকবেন, আই প্যাক যে দলেরই সঙ্গে থাকবে, সেই দল নির্বাচনে জিতবে? মানে শাসক দল যাই করুক না কেন, যত মূল্যবৃদ্ধি হোক, যত অগণতান্ত্রিক কাজ চলতে থাকুক, একজন ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট, সব হিসেব পালটে দেবে?
অন্যদিকের প্রশ্ন হল, জরুরি অবস্থার বিরোধিতায় একজন জয়প্রকাশ নারায়ণের কোনও দরকার নেই, হাজার হাজার মানুষের রাস্তায় নেমে বিরোধিতার দরকার নেই, বোফর্স ঘোটালার মত বড় দূর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের জমায়েতের দরকার নেই, শ্রমিক আন্দোলনের দরকার নেই, কৃষকদের এক বছরেরও বেশী সময় ধরে রাস্তায় নেমে আন্দোলনের কোনও মূল্য নেই, কেবল একদল ছেলে মেয়ে, এক বুদ্ধিমান ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্টর নেতৃত্বে এনে দেবে নির্বাচনী জয়, সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেটের যুগে যেভাবে পণ্যকে ঘরমুখো করে কর্পোরেট সেলস স্ট্র্যাটেজি, সেভাবেই ফাটাফাটি শ্লোগান, ইভেন্ট আর নিত্য নতুন ধমাকেদার কায়দাবাজীতেই জেতা যাবে নির্বাচন?
খেয়াল করে দেখুন, আন্না হাজারের দূর্নীতিমুক্ত ভারতের লড়াই, কংগ্রেস সরকারের মূল্যবৃদ্ধি, বিরোধীদের ভোটভাগ ছিল ২০১৪ তে বিজেপির জয়ের চাবিকাঠি, নয় কি? পি কে না থাকলেও খুব অন্যরকম ফল কি হত? বিজেপির সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডা পঞ্জাবে কাজে লাগেনি, কাজে লাগবেও না৷ উলটে তাদের শরিক অকালি দলকে সেই বোঝা বইতে হয়েছিল৷ ক্যাপ্টেনের জয়ের কারণ কি সেটাও ছিল না?
নীতীশ আর লালুর জোট তো অঙ্কের হিসেবেই হারাবে বিহারের যে কোনও দলকে, আজও যদি জোট হয়, বিজেপি আবার হারবে, পি কে না থাকলেও হারবে, তাই নয় কি? জগন রেড্ডির বিরুদ্ধে ভোট কংগ্রেস আর টিডিপি র মধ্যে ভাগ হয়েছিল, সেটাই কি ছিল না জগন রেড্ডির জয়ের কারণ? জয়ললিতাহীন এ আই ডি এম কে, তাদের শাসনের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সিই কি স্তালিন এর জয়ের কারণ নয়? এই বাংলায় বিজেপি বিরোধী প্রায় ৩৩% মুসলিম ভোট, বিরাট অসাম্প্রদায়িক ভোট, আর নির্বাচনে তৃণমূল আর বিজেপির চুড়ান্ত মেরুকরণই কি মমতার জয়ের কারণ নয়?
খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, পিকের কাজ জয় এনে দেওয়া নয়, সেই জয়কে সুনিশ্চিত করা, জয়ের জন্য লড়াইকে আরও সুসংগঠিত করা, প্রতিটা প্রার্থীর প্রচার সমান জোর পাচ্ছে কি না, কোথায় পিছিয়ে পড়ছে, কোন স্লোগান টা মানুষের মনে ধরবে, কোন চমকদারি ইভেন্ট আরও কিছু মানুষকে আকর্ষিত করবে, এই ধরণের জরুরি বিষয়গুলো পিকে এবং তাঁর টিম নির্ধারণ করেন, ম্যানেজ করেন, একজিকিউট করেন, সেইখানেই পি কে সফল।
ভারতীয় রাজনীতি, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতি বড্ড জটিল, সেখানে একটা কায়দায়, একটা চালে বাজিমাত সম্ভব নয়৷ লেগে থাকার মত, প্রাণ পাত করে দেবার মত এক মমতা না থাকলে, এ বাংলায় বিজেপি জিতে যেত বৈকি। সেলস আর মার্কেটিং এর ভাষায়, প্রোডাক্টকে হতেই হবে কার্যকরী, অন্তত মানুষের মনে হতেই হবে তা কার্যকরী, তবেই তার সেলস টিম সেই প্রডাক্ট বিক্রি করতে পারবে, মার্কেটিং ষ্ট্র্যাটেজি কাজে দেবে, পচা আম বিক্রি করা যায় না। এবং সব চেয়ে বড় কথা যখন এক ঢেউ তৈরি হয়, মানুষের মধ্যে এক বিশাল আলোড়ন তৈরি হয়, তখন প্রচার কোনও কাজে লাগে না, সব প্রচারকে মিথ্যে প্রমাণ করে অন্য ফলাফল আমরা দেখেছি কেবল ১৯৭৭ এই নয়, তার পরেও অনেক অনেক বার।
সেই পিকে, এবার আবার আর এক পরীক্ষার মুখোমুখি, তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন গুজরাটের৷ কংগ্রেসের হাত ধরেছেন৷ গতবার কান ঘেঁসে জিতেছিল বিজেপি৷ এবার? নরেন্দ্র মোদি – অমিত শাহ জানেন সে কথা, গুজরাট থেকেই শুরু হয়েছিল, গুজরাটেই শেষ হতেই পারে খেলা৷ সেটা জানেন বিলক্ষণ, তাঁরা মাঠে নেমে পড়েছেন৷ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নেমে পড়ল কংগ্রেস, বিরাট চ্যালেঞ্জ পিকের সামনে। তবে এর মধ্যে দুটো ব্যাপার ঘটে গিয়েছে৷ প্রথমটা হল, আদর্শগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে পি কে নিজেকে বিজেপি, বা বলা ভাল আরএসএস–বিজেপি বিরোধী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন৷ দুই কংগ্রেসের মধ্যে এক ডেসপারেশন কাজ করছে, হয় এবার নয় নেভার গোছের৷ ২০২৪ এর আগে তাদের কিছু জয় দরকার৷ ভীষণ দরকার৷ কংগ্রেসের জয় ২০২৪ এ নির্বাচনকে আবার বিরোধীদের এক জায়গায় আসার সুযোগ করে দেবে৷ আপাতত আমরা নজর রাখব গুজরাটের ওপর, সেখানকার আগামী রাজনীতির ওপর।