টাকা উদ্ধারের ধারাবিবরণী আপাতত বন্ধ৷ টাকা, গয়না, বিদেশি মুদ্রার ছবি আকর্ষণ হারানোর মুখেই এসেছিল সেক্স টয়৷ তাও আর টিআরপি দিচ্ছে না। রোমান্টিক গলায় বাগানবাড়ির হদিশ, চিল চিৎকারে বলা, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সারে সারে ডাম্পার, যারই হোক না কেন, রামা শ্যামা যদু মধু যারই হোক না কেন, আপাতত সেগুলো পার্থের বলে চালালে, টিআরপি বাড়বে৷ অতএব ব্রেকিং নিউজে তাকেও জোড়া হয়েছে৷ এই দেখুন সারি সারি ডাম্পার, মালিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জুড়ে গিয়েছে পার্থ এপিসোডের সঙ্গে। আর নতুন ব্রেকিং কিছু আসছে না। বিদেশি কুকুরের গল্পই বা কতদিন চালানো যায়? পার্থ চট্টোপাধ্যায় মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত হয়েছেন৷ ফেবু সিপিএমের দাবি, মন্ত্রিত্ব কাড়া হয়েছে, মন্ত্রিসভায় তো আছেন, সেখান থেকে তাড়াতে হবে৷ ফেবু সিপিএমের মান ক্রমশ আঁটি সেলের মতই হয়ে উঠছে৷ টিভি চ্যানেলে বলা হল ক্যাবিনেট বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্থবাবুর মন্ত্রী পদ কেড়ে নেওয়া হল৷ অশিক্ষা এখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এখন ওই জেরা আর হাসপাতালে রুটিন চেকের মাঝখানে পার্থ ভাত খেলেন, কচুবাটা চাইলেন, অর্পিতা কাঁদলেন, কাজু খেতে চাইলেন গোছের গল্প আসতেই থাকবে৷ কিন্তু সেই বা কদিন। আমোদগেঁড়ে এই আবহে ছেদ আসতে বাধ্য।
উত্তেজনা শেষে আম আদমি হঠাৎই খেয়াল করবেন টুক করে গ্যাসের দাম বেড়ে গিয়েছে, আলুর দাম আবার চড়ছে, খেয়াল করবেন অটো ভাড়া বেড়ে গেল, খেয়াল করবেন ইলেক্ট্রিকের বিল জমা না দিলে ইলেকট্রিক বাবুরা তার কেটে দিয়ে যাবে, খেয়াল করতেই হয় ছেলের প্রাইভেট টিউটরের মাস মাইনের দিন এসে গিয়েছে, মেয়ের বই কেনা বাকি। এই বোদা জীবনের বারমাস্যায় পার্থ কি পারত? চেটেপুটে খাওয়া গিয়েছে। এই এপিসোডে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার স্তুপ তাদের উত্তেজিত করেছিল বটে, তবে সে উত্তেজনা থেকে তো ওই টাকার ভাগ মেলে না৷ অতএব সার্কাস শেষ, মন চল নিজ নিকেতনে। ছেলের মাধ্যমিক বের হলে আবার নেতা কে ধরতে হবে, টাকা চাইলে দিতে হবে। অনার্সের একটা সিটের দাম ২০ হাজার, অটোচালক নিয়ম ভেঙে ৪ জনের জায়গায় ৬ জন তুলছে, তাকে ২০ হাজারের জোগান দিতে হবে৷ মেয়ে ভূগোলে অনার্স নিয়ে পড়তে চায়। অটো স্ট্যান্ডে এক দাদা আছে, সে এই বেআইনি রোজগারের ভাগ পায়, তাকে হয়তো মিউটেশন সার্টিফিকেট বের করার জন্য দালালি দিতে হবে৷ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিস, সেও ভাগ নেয়৷ তার ছেলে মেডিক্যাল পড়বে, ডাক্তার হবে, আরও বড় খাঁই।
চাকরি থেকে রোজগার থেকে স্কুল, কলেজ, হাসপাতালে ভর্তি থেকে সরকারি প্রকল্পের সুবিধে, সব কিছুর জন্য কেউ ঘুস দিচ্ছে, কেউ ঘুস নিচ্ছে। এরা কারা? ওই যে টাকার ডাঁই জমা হয়েছে, তা এল কোথা থেকে? জেলায় জেলায় আড়কাটি আছে, তারা জানিয়েছে ২০ চাই, ৩০ চাই, হাজার নয়, লক্ষ। সে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আবার কোথাও সিঁধ কাটা চলছে, কারা করছে? আমি করছি, আপনি করছেন, উনি করছেন, ইনি করছেন, আমরা প্রায় সবাই করছি৷ ৫০ টাকা বেশি না দিলে ট্যাক্সি ড্রাইভার মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে, তার মাসে রোজগার কত? ১৮/২০/২৫ হাজার, আম আদমিই তো বলা যায় নাকি? বাইক কিনতে হবে, পাড়ায় যে প্রৌঢ় বাড়ি তৈরি করছে, তাকে চমকে আসতে হবে, এ শুড্ডা, নিমাইদার কাছ থেকেই ইঁট বালি সিমেন্ট কিনতে হবে, নাহলে…… চমকে দিলেই ক্যাশ ১০ হাজার, আর দু তিনজনকে চমকাতে পারলেই স্পেলন্ডার, পেছনে মনিকা। জানেন না এ গল্প? পাড়ায় শিক্ষক দেখেন না? স্কুলের, কলেজের? প্রাইভেট টিউশন করছেন, সকাল ৬ টা থেকে ১০ টা, বিকেল ৬ টা থেকে রাত ১০ টা, মন দিয়ে পড়াচ্ছেন, বিকে স্যর, পিকে স্যর, খোকন স্যর, বিজন স্যর দারুণ পড়ান। ৮ ঘন্টা টিউশন করার পর স্কুলে বা কলেজে ক্লাস করা সম্ভব? মানুষ তো, ভগবান তো নয়, অতএব এদের একজনও স্কুল বা কলেজে পড়াচ্ছেন না, রোজগার? মাসে ৩/৪/৫ লক্ষ টাকা, ছেলেকে হায়দরাবাদে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করেছেন, দেড় কোটি টাকা দিয়ে। ফেসবুকে ইনি শিক্ষা ব্যবস্থা পার্থর মতো চোরের কাছে চলে গিয়েছে বলে আফসোস করেছেন।
এই সর্বব্যাপী চুরির কথা বলছি কি এই জন্য যে, তাহলে কি পার্থর চুরি কে জাস্টিফাই করছি? বা বলা ভালো এরকম কি বলার চেষ্টা করছি যে, যদি উনি চুরি করে থাকেন তাহলে তা জাস্টিফায়েড, সবাই চুরি করছেন, উনিও চুরি করেছেন মিটে গেল? না সেই জন্য বলছি না৷ এই সর্বব্যাপী দুর্নীতি আসলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের রাগ, ঘেন্নাকে চেপে দিচ্ছে, এন্ড অফ দ্য ডে৷ সেই লোকটি ভাবছে, আমিও তো চুরি করি বা নেতা, পুলিস তো চুরি করবেই, এ আর নতুন কি৷ অবচেতন মনে একটা লেজিটিমেসি, চুরি করার পক্ষে একটা যুক্তি, চুরি করার একটা মরাল সাপোর্ট, নৈতিক সমর্থন তৈরি হয়ে গিয়েছে সমাজে। হাসতে হাসতে মেনেই নিয়েছি, চুরি বিদ্যে মহা বিদ্যে যদি না পড়ো ধরা।
পার্থ ধরা পড়েছে, যারা ধরা পড়ল না? তাদের বান্ধবীরা বড়জোর একটু সাবধান হবেন, বস্তায় করে টাকা রাখতে মানা করবে। এই তো। তাহলে আলোচনাটাকে নিয়ে যাওয়া যাক, বাংলার রাজনীতির দিকে। মানে এই পার্থ এপিসোডে বাংলার রাজনীতিতে কিরকম হলচল মচাবে, কতটা আলোড়ন তুলবে, এরফলে রাজনৈতিক সমীকরণে কোনও ইতরবিশেষ হবে কি? আসুন সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। নির্বাচনে প্রভাব। সামনে একটাই বড় নির্বাচন, পঞ্চায়েত। ২০২৪, ২০২৬ ওসব নিয়ে ভেবে লাভ এই কারণ তার আগে বহু জল বইবে, বহু কিছু হবে, আজকের পার্থ এপিসোড সেদিন কতখানি কার্যকর হবে, আদৌ কার্যকর হবে কি না, তা এখনই বলা খুব শক্ত। হ্যাঁ পঞ্চায়েত ভোট আছে। কোন ইস্যুতে হবে? শহর লাগোয়া কিছু জায়গা বাদ দিলে ভোট হবে রাস্তা, আলো, ১০০ দিনের কাজ, আর সরকারের গুচ্ছ গুচ্ছ প্রকল্প যা এক বিরাট ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি তৈরি করেছে, যদি সেই বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধে পাওয়া মানুষজন ভাবেন যে এই সরকার আছে বলেই আমরা এগুলো পাচ্ছি৷ যদি তাঁরা মনে করেন রাস্তা একটু ভালো হয়েছে, গ্রামীণ হাসপাতালে কিছু চিকিৎসা হচ্ছে, যদি মনে করেন আলো, জলের খানিক সুরাহা হয়েছে, তাহলে তারা সরকারে যে দল আছে, তাদের পক্ষে ভোট দেবেন৷ না হলে উল্টোদিকে দেবেন৷ এক বিরাট মুসলমান ভোট আছে, তাঁরা যদি মনে করেন এই বাংলায় দিদিমণির দল বিজেপিকে হারাতে পারে, বিজেপিকে রুখতে পারে তাহলে তাঁরা দিদিমণির দলকেই ভোট দেবেন৷ না হলে সিপিএম বা কংগ্রসকে দেবেন। পার্থ, অর্পিতা, ডাঁই করা টাকা, বাগানবাড়ি, সেক্স টয় কোনও কাজে দেবে না।
আর যদি তৃণমূল দল ৬৫/৭০% গ্রাম পঞ্চায়েত, ৭০/৭৫% পঞ্চায়েত সমিতি, ৮০% জেলা পরিষদ দখল করে ফেলেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই পার্থ এপিসোডের গঙ্গা যাত্রা কেউ আটকাতে পারবে না। যদি উল্টোটা হয়, তাহলে পরের নির্বাচনগুলোতেও পার্থ এপিসোডের ভূত ঘুরে ফিরে আসবে। ভবিষ্যতের কথা থাক, বর্তমানের দিকে তাকান৷ সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ১১ তে দেখেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই একবার আলোচনা করেছেন, আহারে এই ইস্যু যদি বিরোধী অবস্থানে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে আসত? আমরা রাজ্যজুড়ে দেখতাম আন্দোলন, অবরোধ, বনধ, কাগজের হেডলাইনে, টিভির পর্দায় অন্য কিচ্ছু থাকত না। আজকের বিরোধীদের দিকে তাকান, ফেসবুকে মিম তৈরি হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তুখোড় চোখা চোখা লেখা আসছে, সাকুল্যে দুটি মিছিল বামেদের, একটি বিজেপির, খেল খতম পয়সা হজম৷ অধীর চৌধুরী রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রপত্নি বলে সেই উচক্কা ভুলের খেউড় সামলাতে ব্যস্ত। আব্বাস ভাইজান এখনও কিছুই বলেননি৷ কাজেই এটা ঠিক না বেঠিক, ওনার ফলোয়াররা বুঝতেই পারছে না। প্যালা দিতে বিরাট কাজে দিত ধনখড় সাহেব, আহারে উনি নেই, ব্যাথায় ব্যাথায় মন ভরে যায়। উনি থাকলে বিজেপির কিছুটা হলেও লাভ হত। একা কুম্ভ, থুড়ি রিপাবলিক রক্ষা করে নকল বুঁদিগড়।
এবার আসি যদির কথায়৷ যদি বিরোধীরা একসঙ্গে আন্দোলনে নামেন, যা আদতে সম্ভব নয়, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাভ, ৩৩% মুসলমান ভোটই ওনার দিকে যাবে। যদি বিজেপি এই ইস্যুকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, রাজ্যজুড়ে আন্দোলন করতে পারে, সেন্ট্রাল এজেন্সিকে আরও সক্রিয় করতে পারে, আরও দু তিন জন দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হয়, তাহলেও বিজেপিকে পঞ্চায়েত ভোটে বেশ ভালো ফল করতে হবে৷ তা না হলে এই এপিসোড থেকে ২০২৪ বা ২০২৬ এ ফসল তোলা সম্ভব নয়। বামেদের লড়াই এখনও রাস্তায় নেই, ফেসবুকে ১২ টা গোল দিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু ফেসবুকে তো ভোট হয় না। আর বামেদের পক্ষে এই ইস্যু খুব একটা টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কারণ জাতীয় রাজনীতিতে যৌথমঞ্চে তাঁদেরকে বসতেই হচ্ছে এবং হবেও, তৃণমূলের সঙ্গেই৷ তখনই কথা হবে দিল্লিতে দোস্তি বাংলায় কুস্তি, পিছিয়ে পড়বেন বামেরা। ঠিক এই মূহুর্তে এই ইস্যুতে বামেদের বিরোধিতার কোনও ফসল তোলা সম্ভব নয়। তাহলে? আপাতত তুরুপের তাস চিটফান্ডের দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যাওয়া সাংবাদিকের উল্লাস, নীলোৎপল বসুর ব্লু আইড বয়ের টিভি চ্যানেলে চিৎকার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য চ্যানেলে ড্যামেজ কন্ট্রোল ইত্যাদি চলবে৷ আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হয়, ভাদ্র মাসে তাল পাকে, বড়জোর আর দশদিন৷ এ খবর চলে যাবে ৯-এর পাতায়৷ দুর্নীতি এভাবেই সমাজের অন্দরে সেঁধিয়ে যায়৷ গা সওয়া হয়ে যায়। স্বখাত সলিলে ডুবে মরে শ্যামা, দোষ কারো নয় গো মা।