নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অফ ইনভেনশন৷ প্রয়োজন নিজেই তৈরি করে নেয় নতুন আবিস্কার৷ এ তো সব্বার জানা। গরম লাগত বলেই কোনও এক বিজ্ঞানী পাখা আবিস্কার করেছিলেন৷ সমাজ বারণ করেছিল জ্যাঠামশায়ের মতো৷ ভাসুরের নাম মুখে আনা যাবে না৷ তাই সই৷ ভাসুরের নাম গোপাল৷ দিদিমা বলতেন, ডাক বাবা তোদের ওই গরুর পালকে৷ এইরকমই হয়। আগুন থেকে এসি, ফ্রিজ, রেলগাড়ি থেকে ফেরারি কার, আবিস্কার হয়েছে মানুষের প্রয়োজনে, ভাষাও। ভাষাতে পরিবর্ত শব্দ এসেছে৷ চালু হয়ে গিয়েছে এঁচোড়ের বদলে গাছ পাঁঠা৷ বোকার বদলে রামছাগল৷ সে কি আর এমনি এমনি? তো মোদি- শাহ জমানার নতুন ফরমান জারি হয়েছে৷ বেশ কিছু শব্দ, এমনকি লজ্জাজনক, জুমলাবাজ, বিনাশ পুরুষ, বিশ্বাসঘাতক আর বলা যাবেনিকো৷ এগুলো অসাংবিধানিক৷ সংবিধান এই শব্দগুলোকে বাতিল করছে৷ আপাতত সংসদের ভেতরে, কদিন পরেই সিনেমার সেন্সরবোর্ডে একই ফরমান আসবে৷ তারপর বিনাশপুরুষ বা জুমলাবাজ বলার অপরাধে আপনার লাশ পড়ে থাকবে৷ যেমনটা পড়েছিল গৌরি লঙ্কেশ, পানপ্সারি, দাভোলকর, কালবুর্গি ইত্যাদির।
তাহলে আপাতত প্রয়োজন এইসব শব্দের প্রতিশব্দ, কারণ মীরজাফর বা সাভারকার যে বিশ্বাসঘাতক ছিল, তা তো আমাদের বলতেই হবেই। প্রতিশব্দ খুঁজবে কে? অনেকেই, অনেকেই দায়িত্ব নিতে পারেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকার সুবোধ বা পবিত্র হয়, এমনটা বিশ্বাস করি না৷ কিন্তু এই দুজনেই, মানে সুবোধ সরকার বা পবিত্র সরকার আমাদের এই প্রতিশব্দ খোঁজার কাজে সাহায্য করতেই পারেন, নিশ্চই করবেন। কিন্তু আপাতত আমরাও একটু চেষ্টা করে দেখি৷ কথায় বলে চেষ্টা করলে কী না হয়৷ তো আসুন সেই শব্দ ব্রহ্ম নিয়ে মাঠে নামা যাক। প্রথমে আসুন বিশ্বাসঘাতক শব্দটা নিয়ে৷ বিশ্বাসঘাতক কাকে বলে? বিশ্বাস ব্যক্তিগত হতে পারে, পারিবারিক হতেই পারে৷ ওই যে বিভীষণ, নিজের ভাইকেই, জানেন সব্বাই৷ তারপর গোষ্ঠীর হতে পারে৷ এক রাজপুত সাম্রাজ্য বাঁচানোর জন্য লড়ছে, অন্য আরেকজন বিপক্ষের সঙ্গে চলে গেলেন, বলে দিলেন কেল্লায় ঢোকার গোপন পথ৷ এও তো বিশ্বাসঘাতকতা।
কিন্তু সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতকতা হল দেশের সঙ্গে, দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা৷ অনেকেই করেছেন৷ বহু রায়বাহাদুর, লাটবাহাদুর, নরেন গোঁসাইদের দল ছিল, কিন্তু আমাদের দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতকতা ছিল হিন্দু মহাসভা, আরএসএস বা তার নেতা পথ প্রদর্শক সাভারকারের, বিপ্লবী হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন৷ তারপর যেই তেনাকে আন্দামান সেলুলার জেলে ঢোকানো হল, উনি মুচলেকা দিতে শুরু করলেন৷ একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচটা মুচলেকা দিলেন। কী বললেন, আমি ভুল করেছি, ক্ষমা করে দিন, ছেড়ে দিন৷ না সে সব তো বললেনই, তার সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিলেন, জীবনে আর কখনও ইংরেজদের বিরোধিতা করবেন না৷ যারা বিরোধিতা করছে, সেই সব বিপথগামী যুবককে বিরোধিতার পথ থেকে সরিয়ে আনবেন৷ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
সারা দেশ উত্তাল, ৪২ এ, ইংরেজ ভারত ছাড়ো৷ হিন্দু মহাসভা, আর এস এস, তাদের পথপ্রদর্শক সাভারকার তখন ইংরেজদের পাশে৷ কিভাবে এই বিদ্রোহ দমন করা যায়, তার সুপারিশ করছেন। এখানেই শেষ? না এত শত করার পরেও যখন শেষমেষ স্বাধীনতা এল, তিনি তখন গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দিলেন, যে ইতালিয়ান বেরেত্তা পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়েছিল, নাথুরাম গডসে সেটা জোগাড় করেছিল এই বিনায়ক দামোদরদাস সাভারকারের সাহায্যে। জাতির সঙ্গে, দেশের সঙ্গে এর থেকে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কিই বা হতে পারে? তাহলে আসুন না, বিশ্বাসঘাতকতা শব্দ যদি বাতিল হয়, আসুন তার বদলে আমরা সাভারকার শব্দটা ব্যবহার করি, খাপে খাপ, পঞ্চুর বাপ।
এবার আসুন জুমলাবাজ শব্দটা নিয়ে৷ এ শব্দের বাংলা হল ঢপ, তো এ নিয়ে বাঙালির গর্বের অন্ত ছিল না। কারণ এ তাবত ঢপবাজির শ্রেষ্ঠত্ব তো আমাদেরই ছিল, একজন নয় দু দুজন এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ছিল, টেনিদা, ঘনাদা। ওনারা অবশ্য সেকেলে, তাই ঢপবাজ না বলে গুলবাজ শিরোপা পেয়েছিলেন। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করুন, এই দুজনের একজনও নিজের মুখে, বা তাদের কোনও পার্শ্বচরিত্রের মুখে, ওই ঢপ দেওয়া বা গুল দেওয়ার কথা স্বীকার করেননি। মানে বলতে চাইছি, টেনিদা, ঘনাদা তো বাদই দিলাম, তাঁদের সাকরেদরাও কেউ বলে উঠতে পারেননি যে ওনারা গুল দিচ্ছেন।
এবার চলুন ২০১৪, আমাদের দেশের নির্বাচনী প্রচারে, নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি৷ সভায় সভায় বলছিলেন, হরেক কে খাতে মে ১৫, ১৫ লাখ অ্যা যায়েঙ্গে। ভোট শেষ, উনিও চুপ, ওনাকে তো আম চেটে খান না চুষে খান ছাড়া, প্রশ্নও করা যায় না। তো খোলশা করলেন ওনার সাকরেদ, অমিত শাহ, বললেন ওহ তো জুমলা থা, ওটা তো ঢপ ছিল। মানে উনি বলেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী সেদিন ঢপ দিয়েছিল, এ রেকর্ড ঘনাদা বা টেনিদারও নেই। প্রথমে সারা দেশের মানুষকে ঢপ দেওয়া, তারপর সেটা সাকরেদকে দিয়ে বলিয়েও দেওয়া যে, ওহ তো জুমলা থা, ওটা তো ঢপ ছিল৷ হে হে, হে হে। এবং সেটাই কি শেষ? তারপরে পুকুর থেকে কুমিরধরা, জি মেল আসার আগেই ফটো অ্যাটাচমেন্ট করে পাঠানো, মেঘের তলা দিয়ে রাডারকে ফাঁকি দেওয়া, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফাঁক থেকে একটা এক্সট্রা টু এবি বার করে আনা, এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্স নিয়ে পাস করা, কত শত ঢপবাজি, আমরা তো সেসব শুনেছি। তাই জুমলাবাজ শব্দ যদি বাতিল করাই হয়, ধর্মাবতার, আমি জুমলাবাজের বদলে মোদিজী শব্দ ব্যবহার করার সুপারিশ জানাচ্ছি৷ এর থেকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট প্রতিশব্দ আর পাওয়া যাবে না হুজুর, গুলবাজ, ঢপবাজ, জুমলাবাজ প্রত্যেককে এখন থেকে মোদিজী বলেই ডাকা হোক।
আসুন বিনাশপুরুষ শব্দে, এটিও বাতিল করা হয়েছে। এটা তো ছিলই নরেন্দ্র মোদিজীর প্রতিশব্দ, কারণ এমন বিনাশ এর আগে দেশ তো দেখে নি, দেশের গড় বৃদ্ধির হার যখন ৫-৬%, দেশ থ্রি ট্রিলিয়ন না হোক, একটা ভাল অর্থনৈতিক অবস্থা দিকে এগোচ্ছে, তিনি সাডন ব্রেক কষে দিলেন, আনলেন নোটবন্দি। ব্যস, সেই যে অর্থনীতির পতন শুরু হল, আর ঘুরে দাঁড়ায়নি৷ ওই ব্ল্যাক মানি, টেররিস্ট অ্যাটাক ইত্যাদি ছিল বকওয়াস, ফালতু কথা। এরপর তাড়াহুড়ো করে জিএসটি, যে জিএসটি তে হিরের ওপর ১.৫%, খাবারের ওপর ৮% ট্যাক্স বসানো হল৷ আবার অর্থনীতি নামতে থাকল। এল কোভিড, থালা বাজালেন, তালি বাজালেন, দিয়া জ্বালালেন, তারপর ১২ ঘন্টার নোটিশে লকডাউন করে দিলেন৷ সে ছবি আমরা দেখেছি৷ মাইলের পর মাইল পরিযায়ী শ্রমিকরা হাঁটছে, ট্রেনের তলায় কাটা পড়ছে৷ আমরা দেখেছি৷ অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই, লাশ ভাসছে, একে বিনাশ বলবো না তো কাকে বলব?
সেখানেই থেমে নেই স্টার্ট আপ বন্ধ হচ্ছে, দেশের ইলেক্টনিক্স মার্কেট চলে গিয়েছে চীনের হাতে৷ যারা দেশের মধ্যে ঢুকে ব্রিজ বানাচ্ছে, রাস্তা বানিয়ে ফৌজ বসাচ্ছে। এদিকে জাতীয় অর্থনীতি ধুঁকছে, টাকা নামছে, এক ডলারে এখন ৮০ টাকা, উনি যখন গদিতে বসলেন তখন এক ডলারে ৫৯ টাকা ৪৪ পয়সা পাওয়া যায়, উনি সেদিন প্রশ্ন করছিলেন, টাকা এত নামছে কেন? এখন চুপ। রেকর্ড বেকারত্ব, হাঙ্গার ইনডেক্স এ আমরা নামছি, ফ্রিডম ইনডেক্স এ নামছি, একেই তো বিনাশ বলে, সমবেত ভদ্রমন্ডলীর কাছে আমার আবেদন, বিনাশপুরুষ শব্দ যদি বাতিল করাই হয়, তাহলে তার বদলে নরেন্দ্রভাই শব্দটিই ব্যবহার করা হোক৷ এ শব্দ আশা করি বাতিল করা হবে না৷ করা হলে বাঁচা যাবে। বাতিল হয়েছে তানাশাহি শব্দ, কোনও ডিকটেটর, কোনও তানাশাহ কি তানাশাহি কথাটা পছন্দ করেন? সম্ভবত সেই কারণেই বাতিল হয়েছে তানাশাহ শব্দ৷ জেলে ঢোকানো হয়েছে অশিতিপর জেসুইট ফাদার স্ট্যান স্বামীকে, জল খাবার সিপার দেওয়া হয়নি, আলজাইমার্স রোগে ভুগতে থাকা ওই অশক্ত মানুষটিকে, মারা গিয়েছেন জেলেই। জেলে পচছে কবি সাংবাদিক, লেখক, অধ্যাপক, আইনজীবী, সমাজকর্মীর দল। প্রত্যেক বিরোধী দলনেতার দরজায় কড়া নাড়ছে সিবিআই, ইডি, ভিজিলেন্স, ইনকাম ট্যাক্সের দলবল৷ হয় এদিকে আয় নাহলে জেলে পুরব৷ নির্বাচিত সরকার ভাঙা হচ্ছে নিয়ম করে, কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মুখের শব্দও, একেই তো স্বৈরতন্ত্র বলে। হিটলার, মুসোলিনির সুযোগ্য শিষ্য এই আরএসএস – বিজেপি সেই ফ্যাসিজমকেই আনতে চায়৷ সেটাকেই তানাশাহি বলে, সেটা বাতিল করা হলে আমরা বরং তার বদলে অমিত শাহি কথাটা ব্যবহার করবো, মন্দ লাগবে না কি বলুন।
এরকমভাবেই বোকামোর বদলে দিলু ঘোষ, ধান্দাবাজের বদলে শুভেন্দু বা গিরগিটির বদলে রুদ্রনীল শব্দ ব্যবহার করা যেতেই পারে, আপনাদের মতামত জানান, এই নতুন শব্দগুলোকে জনপ্রিয় করে তুলুন। আমরা বলবো, খোকা সাভারকার হোস না, খোকা বুঝবে দেশকে ভালো বাসতে হয়, বিশ্বাসঘাতকতা এক নোংরা কাজ। আমরা বলবো কক্ষনো মোদিজী হোস না, সে বুঝে ফেলবে, মিথ্যে বলিস না, গুল দিস না। আমরা বলবো ঐ যে নরেন্দ্রভাই আসছে, সে শিশু টলমল পায়ে সেই বিনাশপুরুষের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবে, সেই আগামীর ভবিষ্যৎ কোথাও স্বৈরতন্ত্র দেখলে হাঁক পাড়বে অমিত শাহি নিপাত যাক, সে গিরগিটি দেখলে হা হা করে হাসবে বলবে ওই যে রুদ্রনীল যাচ্ছে। নে এবার কত শব্দ পাল্টাবি পালটা।