আমরা শপথ নিচ্ছি, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, হিন্দুস্তানকে, হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর জন্য৷ হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবেই বজায় রাখার জন্য৷ হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবেই আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ প্রয়োজন হলে আমরা বলিদান দেব৷ প্রয়োজন পড়লে বলিদান নেব৷ যে কোনও মূল্যে হিন্দুস্তানকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবেই ঘোষণা করব৷ এই কাজের জন্য আমাদের কুলদেবতা, আমাদের ইষ্টদেবতা, আমাদের শক্তি দিক, সামর্থ্য দিক, বিজয় প্রদান করুক। এটা শপথ৷ শপথ নিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, মহিলা, পুরুষ, সাংবাদিক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী। হরিয়ানার আম্বালা শহরের, অগ্রওয়াল ভবনে এই সমারোহ হয়ে গেল ২ মে। আজ ৪ মে৷ না এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি৷ আর গ্রেফতার করবেই বা কে? অনুষ্ঠানে পুলিশি পাহারা ছিল৷ উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক অসীম গোয়েল, যিনি দেশের সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন৷ এ ভিডিয়ো ভাইরাল৷ শহরের পুলিশ জানে, রাজ্যের পুলিশ জানে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন৷ প্রধানমন্ত্রীও জানবেন নিশ্চয়ই৷ না এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি৷
প্রকাশ্যে সংবিধান অবমাননা, সংবিধানের সমলোচনা নয়৷ সংবিধানের মূল স্বর, মূল বৈশিষ্টকে পালটে দেওয়ার শপথ৷ এক প্রজাতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর ঘোষণা করার জন্য, একজনকেও গ্রেফতার করা হয়নি৷ কে বা কারা জহরলাল ইউনিভার্সিটিতে স্লোগান দিয়েছিল, আজও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে সম্বিত পাত্র, আইটি সেলের মাথা অমিত মালব্য দেশের সমস্ত বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাদের, টুকরে টুকরে গ্যাং বলে চিহ্নিত করেন৷ দেশের সমস্ত আরএসএস–বিজেপি, হিন্দু জাগরণ সমিতি বিরোধী বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, কবি, সমাজকর্মীদের টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের সদস্য বলে চিহ্নিত করেন৷ তাকিয়ে দেখুন তাদের হীরণ্ময় নীরবতা৷ চুপ করে বসে মজা দেখছেন৷ কারণ এটা তো তাঁদেরও শপথ৷ এটাই তো তাঁরা চান।
আচ্ছা এই শপথ বাক্য, এই ঘৃণার বিষ পাঠ করল কে? কারা আয়োজন করল এই শপথ গ্রহণের? পুলিশ জানে না, আমরা জানি। শপথ গ্রহণ করালেন, সূদর্শন টিভির মালিক কাম সাংবাদিক কাম অ্যাঙ্কর, সুরেশ চভানিক৷ এই টিভির চ্যানেলে ২৪ ঘণ্টা বিজেপির পক্ষে প্রচার চালানো হয়৷ ২৪ ঘণ্টার বিষ তৈরি করার কারখানা বললেও ভুল হবে না৷ কিছুদিন আগেই এরাই, হলদিরাম ভুজিয়াওলার প্যাকেটে উর্দু লেখা আছে কেন, নিষিদ্ধ মাংস বা চর্বি আছে নিশ্চয়ই বলে এক প্রচার চালিয়েছিল৷ মজার কথা হল, এত বড় মিথ্যে আর ভুল প্রচার কারও বিরুদ্ধে হলে তারা কী করত? আমিষের প্রশ্নই নেই৷ হলদিরাম তো বিক্রি করে ভুজিয়া আর চাট, লাড্ডু আর প্যাঁড়া৷ তাদের নামে এই সূদর্শন টিভি প্রচার চালালো৷ তাদের খাবারে যে তেল তা নাকি নিষিদ্ধ পশুর৷ কী ভাবছেন? হলদিরাম এই চ্যানেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে? করা তো উচিত৷ করেছে? না করেনি৷ কেন? জানা নেই। তো সেই ৩ বছর বয়স থেকে সুরেশ চাভানিক, নিয়মিত আরএসএস শাখায় গিয়েছেন৷ সেখানেও এরকমভাবেই শপথ নেওয়া হয়, এই রকম হাত তুলে৷ সেই সুরেশ চভানিক শপথ পাঠ করালেন৷ শেষে বললেন, জয়তু হিন্দুরাষ্ট্র।
পুলিশ প্রশাসন কিছু বলল না৷ দেশের মন্ত্রী সান্ত্রী, শাসক দলের একজনের গলাতেও কোনও বিরোধিতা নেই৷ এ এক ধরনের সায়, মৌনম সম্মতিবাচনম। এরপর রাজ্যে রাজ্যে এই শপথ নেওয়া হবে৷ বলা হবে, হিন্দুরাষ্ট্রের কথা৷ আরও সদম্ভে, আরও জোরে। দেশদ্রোহী গান্ধী হত্যায় অভিযুক্ত সাভারকার হাসবেন৷ দ্বিজাতি তত্ত্বের আরও এক নায়ক জিন্না অট্টহাস্যে ফেটে পড়বেন৷ গান্ধী, নেহরু, সুভাষ, আবুল কালাম আজাদ, ভগত সিং তাকিয়ে দেখবেন৷ তাঁদের সাধের ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর দিয়ে হাফ প্যান্টুল, খাঁকি পোশাক পরা ঝটিকা বাহিনী হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের শপথ নিচ্ছেন এবং দেশের বিরোধী দলের মুখ এই সময়েই নেপালে ব্যক্তিগত ভ্রমণে ব্যস্ত৷ যুক্তি হল, এমন কি ব্যাপার, এমন কী হয়েছে যে তেনাকে এদেশেই থাকতে হবে৷ জাহাঙ্গিরপুরায় বুলডোজারের সামনে দাঁড়াতে হবে? হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলা এই শক্তির মুখোমুখি হতে হবে? তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত৷ দেশের কমিউনিস্ট, বামেরা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন৷ মানুষরা তাদের বিশ্বাসই করে না। ক্রমশঃ এক অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছি আমরা৷ চলে যাচ্ছে আমার স্বদেশ, ভারতবর্ষ। একে আটকানোর জন্য চাই শিক্ষা৷ সেখানেও চোখ পড়েছে এই হিন্দুত্ববাদীদের৷ ইতিহাস পালটে দেওয়া হচ্ছে, প্রতিবাদের কবিতা, ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস মুছে দেওয়া হচ্ছে৷ হঠাৎ গত ৭/৮ বছর ধরে এক পরিকল্পিত প্রচার চলছে৷ স্বাধীনতার পরে ২০১৪ পর্যন্ত দেশে কিছুই হয়নি৷ দেশ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল৷ পৃথিবীতে আমাদের কেউ চিনত না৷ সীমান্তে পাকিস্তানের উসকানির জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছিল রাষ্ট্রনায়কেরা৷ এই প্রথম পাকিস্তানের চোখে চোখ রেখে মুহতোড় জবাব দিলেন নরেন্দ্র মোদী৷ এই প্রথম বিদেশের মানুষজন ভারতবর্ষের এক দেশ আছে তা জানতে পারলো৷ গোটা পৃথিবী নাকি নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির দিকে তাকিয়ে৷ এসব বলা হচ্ছে, প্রচার করা হচ্ছে৷ দেশের প্রচার যন্ত্রের ৯৯% কিনে নিয়েছে আরএসএস–বিজেপি৷ তারা এখন রাষ্ট্রের মুখপাত্র৷ রাজাকে প্রশ্ন নয়, ক্ষমতায় যে বসে আছে তাঁকে একটা প্রশ্ন নয়৷ তারা কেবল জয়ঢাক বাজাতে ব্যস্ত৷ ঢেঁড়া পেটাতে ব্যস্ত৷ নির্লজ্জভাবেই তারা এখনও প্রশ্ন করে চলেছে দেশের বিরোধী দল আর নেতাদের, আর দু একজন, কিছু ডিজিটাল মিডিয়া যখন স্বাধীনভাবে কাজ করছে, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায়, পরিকল্পনা করেই তাদের রিচ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ তারা যাতে ভাতে মারা যায়৷ তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ তাতেও না মানলে, ইউএপিএ তো আছেই, জেলে পোরা হচ্ছে৷
ফল? আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্ট উইদাউট বর্ডারস৷ গত বছর জানিয়েছিল, আমাদের দেশের সাংবাদিকতা প্রশ্নের মুখে৷ ১৮০টা দেশের মধ্যে গতবার আমাদের দেশ ছিল ১৪২ নম্বরে৷ আমাদের দেশকে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিপদজনক বলা হয়েছিল৷ এবার মানে ২০২২ এর রিপোর্টে আমাদের দেশ আরও নেমেছে৷ এখন আমরা ১৫০ নম্বরে। আমাদের দেশের ১৩ জন এমন সাংবাদিকদের তালিকা তাঁরা দিয়েছেন, যাঁরা জেলে আছেন, কেন? খবর লেখার জন্য। মানে জেলের বাইরে তারা যারা সংবিধান বিরোধী, দেশদ্রোহী, গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রে দায়ীদের পুজো করছে৷ আর জেলে যাচ্ছেন, যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছেন৷ সংবিধান বাঁচানোর কথা বলছেন৷ এবং এসব করার জন্য নরেন্দ্র মোদির সরকারকে কোনও জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়নি৷ কোনও বিশেষ আইনও আনতে হয়নি৷ তারা এটা করেই চলেছে৷ দেশ পিছোচ্ছে৷ জিডিপি নামছে৷ মাথা পিছু আয় কমছে৷ টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে৷ মূল্যবৃদ্ধি অভূতপূর্ব৷ দেখে শুনে মনে হচ্ছে তাহলে বোধহয় এগুলোই হিন্দুরাষ্ট্রের প্রাক শর্ত৷
এরই মধ্যে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি, তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে৷ তাতে বলা হল, এপ্রিল মাসে বেকারত্বের হার ৭.৮৩%৷ মার্চে তা ছিল ৭.৬%৷ আপনি বলবেন এ আর এমন কী? মাত্র .২৩% বেকারত্ব বেড়েছে৷ কিন্তু মাথায় রাখুন লক ডাউন খুলেছে, একটু একটু করে কলকারখানা খুলছে, এর মধ্যে বেকারত্ব বাড়া কোন সর্বনাশের ইঙ্গিত দিচ্ছে? এবং সেই বেকারত্বও বাড়ছে শহরাঞ্চলে৷ শহরাঞ্চলের বেকারত্ব ৯.২২ শতাংশ। সর্বোচ্চ বেকারত্ব হরিয়ানায় ৩৪.৫%, বিহারে ২১.১%, বাংলায় ৬.২%, কেরালায় ৫.৮%। ও দিকে ভোগ্যপণ্যের খুচরো মূল্যবৃদ্ধি ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৬.০৭%, মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৯৫% এ। মানে সমস্ত প্যারামিটারে, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সামাজিক মাপকাঠিতে দেশ পিছিয়েই চলেছে৷ প্রত্যেকটাতে, গণতান্ত্রিক কাঠামো থেকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ক্ষুধা সূচক থেকে মাথা পিছু আয়, প্রত্যেকটাতে ধারাবাহিক পিছিয়ে পড়ার খবর৷ এ দিকে ক্রমাগত ঢাক পেটানো হচ্ছে, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়৷ মোদিজী আছেন বলেই নাকি এসব সম্ভব হচ্ছে৷ আমরা একমত৷ ১০০% একমত৷ সায়েন্স পাশ করা, মোদিজী ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে দেশকে এত তাড়াতাড়ি, এত বড় অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না৷ এই সত্যিটা মানুষকে বোঝাতেই হবে৷ চোখের সামনে সবকটা ডেটা অ্যাভেলেবল৷ প্রত্যেকটা পরিসংখ্যান চোখের সামনে৷ প্রতিদিনের জীবনচর্যায় মূল্যবৃদ্ধি কত বড় পরিবর্তন এনেছে তার এক উদাহরণ এলো মহারাষ্ট্র থেকে৷ থানের বাসিন্দা বিলাস রাওয়ের ৫ জনের পরিবারে এখন তাঁর তিন সন্তান সপ্তাহে সাতটা মিল পান৷ মানে বিলাস রাও সাত বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, বাকি দুজন, মানে উনি আর ওনার স্ত্রী সপ্তাহে চার দিন খান৷ একদিন বাদ দিয়ে অন্যদিন খান৷ যে কটা দিন খান না, সেদিন বাড়ি থেকে কাজ আছে বলে, সন্তানদের খাবার রান্না করে বাইরে চলে যান তিনি৷ রাতে ফেরেন। বিলাস রাও এ দেশের নাগরিক৷ সন্তানদের মিথ্যে বলছেন৷ তাদের সাতদিন অন্তত একবেলা খাবার যোগানোর জন্য৷ অবশ্য অবাক হওয়ারই বা কী আছে৷ দেশের ১৯% মানুষ তো একবেলা খেয়েই বেঁচে আছে৷ দাঁড়িয়ে যাক তারা, হাত তুলে, যেমনটা দাঁড়াত নাৎসী বাহিনী৷ দাঁড়িয়ে শপথ নিক সেই হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার, যেখানে মানুষ খিদে নিয়েই বেঁচে থাকে।