২০১৪ থেকে দেশের যা কিছু সনাতন, শাশ্বত, সুন্দর, সব বদলাচ্ছে৷ কালাপাহাড়ের মতো ভাঙা হচ্ছে গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা৷ এর মানে এমনও নয় যে আগে পুষ্প বৃষ্টি হচ্ছিল৷ এমনও নয় যে গঙ্গায় জলের বদলে দুধ বইছিল৷ না তা নয়৷ জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, কালা কানুন আনা হয়েছে, পুলিশি জুলুম হয়েছে, বিনা বিচারে জেল হয়েছে। তার বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছে, মানুষ প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু এখন ছবিটা আলাদা। যা করা হচ্ছে, সেটাকে একটা নীতিগত সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই করা হচ্ছে। শুনতে খটমট লাগলো? দাঁড়ান আর একটু খোলসা করে বলি।
আগে এনকাউন্টার হয়নি? আলবাত হয়েছে৷ এই বাংলায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানায় অসংখ্য তরুণ ছেলেকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ তাদের লাশ পাওয়া গিয়েছে বা যায়নি, গুলি করে মারা হয়েছে। কিন্তু কেউ শুনেছেন, কখনও শুনেছেন যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ‘এনকাউন্টার কিলিং করেছি আরও করব’ এমনটা বলেছেন। যোগিজী কিন্তু বলছেন, করছেন। জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা৷ জাস্টিফাই করতে গিয়ে হাজারটা কথা বলেওছেন৷ শেষ মেষ সেই সময়ের বাড়াবাড়ির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন৷ কংগ্রেসের বিভিন্ন স্তরের নেতা এই জরুরি অবস্থার বিরোধিতাও করেছেন, দল ছেড়েছেন, কিন্তু বিজেপিতে? এই অর্থহীন ধরপাকড়, জেলে পোরা, সিবিআই, ইডি লেলিয়ে দেওয়া নিয়ে কোনও কথা? কোনও আত্মসমালোচনা? না নেই। কারণ ওনারা মনে করেন এটা ঠিক করছেন৷ আলোচনায় বলছেন, এত গণতন্ত্র দিয়ে হবেটা কী? বিজেপির উঠে আসাকে মাথায় রাখুন, ২০১৩- ২০১৪, আট বছর আগে এদেশের কম্পট্রোলার জেনারেল বিনোদ রাই বলেছিলেন, কোল ব্লক আর টুজি স্পেক্ট্রাম বিলিতে, এক লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে। হ্যাঁ, এ তাবত দেশের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি, বোফর্স কেলেঙ্কারি ছিল ৬৪ কোটি টাকার৷ আর এখানে এক লক্ষ ৭৬ হাজার কোটির ব্যাপার। তো মাঠে নামলেন কে? আন্না হাজারে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কিরণ বেদী, স্বামী রামদেব, সুব্রমনিয়ম স্বামী৷ আর নির্বাচন প্রচারে জনে জনে এই কেলেঙ্কারির কথা বললেন, যে টাকা লুঠ হয়েছে, তা ফেরত আনার কথা বললেন কে? নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি।
বিনোদ রাই আদালতে ভুল স্বীকার করেছেন৷ তাঁর লেখায় তথ্যের অভাব ছিল৷ তিনি সব তথ্য যাচাই করেননি বললেন। আন্না হাজারে ১৬ জন সিকিউরিটি গার্ড নিয়ে গ্রামের ঘরে বসে আছেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, কিরণ বেদী রাজ্যপাল, স্বামী রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলির মোট সম্পদ ১৪০০ কোটি টাকা৷ নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী৷ উবেই গিয়েছে সেই কোল ব্লক স্ক্যাম, টু জি দুর্নীতির কথা। কেলেঙ্কারি ভেসে গিয়েছে হাওয়ায়, জলে। সেই কেলেঙ্কারির হাত ধরে আসা ইস্তক মোদিজী, আরএসএস – বিজেপির প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য আমাদের সংবিধান, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো, ধর্ম নিরপেক্ষতা। সেই লক্ষ্যেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই, তারা দেশের জাতীয় প্রতীকে বদল চায়, শান্ত, সমাহিত, ধীর পশুরাজের বদলে এক দাঁত খ্যাঁচানো হিংস্র পশুই তাদের পূজনীয়। ঠিক এইখানে আগের লেখায় একটা প্রশ্ন তুলেছিলাম, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদির এক নৈতিক দিক আছে, নৈতিকতার দিক থেকে একটা মানুষের, সমাজের, দেশের সাম্প্রদায়িক হওয়া, অগণতান্ত্রিক হওয়া কি কেউ সমর্থন করতে পারে? কিন্তু যদি আমরা এই নীতি, নৈতিকতার প্রশ্নটাকে সরিয়েও রেখে দিই, যদি আমরা এই গণতন্ত্রকে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে উদার মতামতকে অর্থনৈতিক বিকাশ, উন্নয়নের দিক থেকেই দেখি, তাহলে কী পাব? আমরা দেখব কেবল নৈতিকতার প্রশ্নেই নয়, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ, উন্নয়নের জন্যও জরুরি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা।
প্রথমেই কিছু মানুষ চীনের দিকে আঙুল তুলবেন৷ দেশে গণতন্ত্র নেই, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম নেই৷ কিন্তু জিডিপি, পার ক্যাপিটা ইনকাম, মাথা পিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে মানে বিরাট বেড়েছে। তাহলে? এই বাড়ার আর না বাড়ার মাঝখানের তথ্যগুলো কি? ১৩ লক্ষ মানুষ মরেছে দুর্ভিক্ষে, কেন? সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চড়াই আর ইঁদুর মারো৷ মারা হয়েওছিল, ভারসাম্য খোয়া গিয়েছিল পরিবেশের৷ পোকায় খেয়েছিল শস্য, দুর্ভিক্ষ অনাহারে মারা গিয়েছিলেন ১৩ লক্ষ মানুষ৷ সেটাও আবার ছাপা হয়নি কোনও কাগজে৷ আমাদের আদর্শ কি তেমন একটা ব্যবস্থা? ছাত্ররা গিয়েছিল প্রতিবাদ জানাতে, সশস্ত্র বাহিনী গিয়েছিল সেই বিক্ষোভ থামাতে, হাজার হাজার লাশ গাড়িতে করে ফেলা হয়েছিল, কোথায়? কেউ জানে না। কেউ প্রতিবাদ করেনি, তখন করেনি, আজও ওই দিনের কথা মুখেও আনে না। উইঘুর মুসলমানদের আটকে রাখা হয়েছে, তাদের ধর্মাচরণে নিষেধাজ্ঞা, কেন? আমাদের আদর্শ কি তেমন সমাজ? শ্রমিক ইউনিয়ন নেই, মজুরি নির্ধারণ করছেন মালিক, কম হলে কম, বেশি হলে বেশি৷ এটাই আমাদের আদর্শ? দুর্নীতিকে অনেকটা আটকে এক অথরেটেরিয়ান রুল, এক দলের শাসন চলছে৷ যেদিন ভাঙবে, সেদিন চিহ্নও থাকবে না৷ একদলীয় শাসন, অগণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে আধুনিক পৃথিবীতে টিঁকে থাকা সম্ভব নয়।
ভারতবর্ষ, সে যারই হাতে থাক, ইন্দিরা, মোদি, কংগ্রেস, বিজেপি যার হাতেই থাক, তাকে এক দলের অধীনে নিয়ে আসা, গণতন্ত্রের ধারণাটুকুও মুছে ফেলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে দেখুন রাশিয়া, স্তালিনের রাশিয়া, যে স্তালিন হিটলারকে হারিয়েছিলেন, ফাসিজমকে রুখেছিলেন, গণতন্ত্রের অভাব তার অর্থনীতিকে শেষ করল৷ প্রশ্ন করার মানুষ নেই, একটাই দল৷ দলের অধীন পুলিশ, প্রশাসন, স্বাধীন মিডিয়া নেই, শাসকও জানতে পারলো না কোথায় কী হচ্ছে? জানতে পারলো না কারখানায় উৎপাদন বন্ধ, জানতে পারলো না যে উৎপাদিত দেশলাই কাঠি জ্বলে না, ব্লেড দিয়ে দাড়ি কাটা যায় না৷ জানতে পারলো না যে মানুষ কিছু বলতে চায়, তারপর একদিন সামান্যতম গণতন্ত্রের আভাস পেয়েই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তাসের দেশ৷ গণতন্ত্রহীনতা প্রথমে অর্থনীতিকে শেষ করে, তারপর সমাজকে, দেশকে।
তাকিয়ে দেখুন শ্রীলঙ্কার দিকে৷ গোতাবায়া রাজপক্ষেকে কেউ বলার ছিল না যে, স্যর, অর্গানিক চাষ ভালো৷ কিন্তু এক ধাক্কায় তা করতে গেলে দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দেবে৷ না তাঁর পারিষদের সেই ক্ষমতা ছিল, না মিডিয়ার, কাজেই দেশে হঠাৎই খাদ্যের অভাব। এখন তিনি দেশ ছেড়ে পালানোর প্ল্যান করছেন। হঠাৎ নরেন্দ্র মোদীর মনে হল, নোটবন্দি চাই৷ তাঁর পারিষদদের কিছু বলার ক্ষমতা নেই, মিডিয়া তো ২০০০ টাকার নোটে চিপ পেয়ে গিয়েছে৷ সেই যে দেশের অর্থনীতি নীচে নামতে শুরু করল, আজও ওঠার নাম নেই। সিপিএম, সিপিআই, কমিউনিস্ট পার্টি নয়, ইদানিং চীনের ফলোয়ার হলেন নরেন্দ্র মোদি৷ চীনে ইন্ডাস্ট্রির গ্রোথ হচ্ছে, প্রায় ঘরে ঘরে ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠছে, এদেশেও চাই। মাথায় নেই, চীনের প্রায় ১০০% শিক্ষার হার কেবল নয়, স্কিল্ড লেবার, ট্রেনিং, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, এসব এক অন্য লেভেলে নিয়ে গিয়েছে ওরা৷ বললেই শিল্প হয় না। কিন্তু মোদিজীর মনে হয়েছে, লোকাল, ভোকাল, মেক ইন ইন্ডিয়া ইত্যাদি বলে তিনি সাবসিডি দেওয়া শুরু করলেন, মোবাইল তৈরি করবে কোম্পানি, ৬% সাবসিডি, কী মজা। শিল্পের নামে অ্যাসেম্বলিং শুরু হয়ে গেল, ৬% সাবসিডি। অ্যাপল থেকে সামসুং কারখানা করল৷ বিদেশে তাদের প্রডাক্টের ১৫% বেশি দামে, তার ওপরে ৬% সাবসিডি, ২৫/৩০% মার্ক আপ নিয়ে দারুণ ব্যবসা৷ কারণ লেবার রেট কম। সাবসিডি একটা সময়ের পর বন্ধ হবে৷ যেই বন্ধ করার কথা হবে ওনারা বলবেন তালা লাগাবো, পোষাচ্ছে না, শ্রমিকরা বেশি মাইনের কথা বলবে? নতুন লেবার’ল এসে গিয়েছে। তাকিয়ে দেখুন যেখানে চীনের ঘরে ঘরে মাইক্রো চিপ তৈরি হচ্ছে, কোনওটা ফ্রিজের, কোনওটা এসির, কোনওটা খেলনা, কোনওটা দ্রোনের। আমাদের দেশের নিজস্ব মাইক্রো চিপ? একটাও নেই, সব বাইরে থেকে আসছে৷
মোদিজী র মেক ইন ইন্ডিয়ার কলকব্জা আসছে চীন থেকে, টিকটক ব্যান করে হবেটা কী? নেলকাটার থেকে খেলনা মেড ইন চায় না, আসেম্বলড ইন ইন্ডিয়া, এটাই বাস্তব। কিছু ক্ষেত্রে কি নেই? ওষুধ শিল্পের মত কিছু ক্ষেত্রে আছে, তো সেখানে জোর দেওয়া হোক না। আমাদের থ্রাস্ট, আমাদের জোর দেওয়া উচিত কোনখানে? দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন সার্ভিস সেক্টর, সেখানে দেশের অগাধ সম্ভাবনা, শিক্ষা, স্বাস্থ, ট্যুরিজম ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের বিরাট বিরাট সম্ভাবনা, কিন্তু সেখানে সমস্যা ঐ যে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, আধুনিক উদার এক সমাজের, তা যদি না থাকে তাহলে সার্ভিস সেক্টরে আমরা এগোতে পারবো না। ধরুন চিকিৎসা ক্ষেত্র, বিশ্বে সর্বত্র ভারতীয় ডাক্তারদের কদর আছে, তাহলে আমাদের দেশ থেকে টেলি মেডিসিন সম্ভব কেন হবে না? তথ্যের গোপনীয়তার আশ্বাস নেই, সবটাতেই সরকারের নজরদারি আছে, যে কোনও মূহুর্তে তা চলে যেতে পারে অন্য কারোর হাতে, আর চিকিৎসার তথ্য? অত্যন্ত ব্যক্তিগত, গোপনীয়। সেই আশঙ্কা মাথায় রেখে কারা চিকিৎসা করাবেন? এখন আয়ুর্বেদের ডাক্তাররাও সার্জেন, এখবর পেয়েছে বিশ্ব, লুকিয়ে রাখা তো যাবে না, তারা ভরসা করে আসবে? উঠে গেছে হিপোক্রাটিক ওথ, এসেছে চরক প্রতিজ্ঞা, সেই চরক কে? কী করতেন? সারা বিশ্বের ডাক্তারেররা হিপোক্র্যাটিক ওথ নেয়, হঠাৎ এই চরক কেন? শিক্ষা? দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, গণেশের মাথা কেটে হাতির মাথা ছিল প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি৷ বলা হচ্ছে মহাকাব্যের রাম জন্মেছিলেন অযোধ্যায়, বলা হচ্ছে তাজমহল আসলে এক শিব মন্দির ছিল। এসবের পরে আমাদের দেশের শিক্ষকরা কল্কে পাবেন? শিক্ষা ব্যবস্থাতেও একই রকমের অদ্ভুত বদল, শিক্ষার নামে কুসংস্কার, ইতিহাসের নামে মিথ, বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান। এবং তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করার নেই। ট্যুরিজম? প্রকাশ্যে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, মোবাইল খুলে মাথা কেটে নেবার ঘটনা ঘটল কদিন আগে? ট্যুরিজম বাড়বে? মানুষ কী দেখতে আসবে? তাই কেবল নৈতিকতার জন্যই নয়, দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যও প্রয়োজন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, এক আধুনিক উদার সমাজ।