সিবিআই, ইডি, ভিজিলেন্স এজেন্সিকে রাজনৈতিক দাসত্ব ছাড়তে হবে, বললেন দেশের সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতি, এন ভি রামান্না। তিনি ডি পি কোহলি মেমোরিয়াল লেকচার অনুষ্ঠানে বলতে এসেছিলেন, পরিষ্কার বললেন, “The need of the hour is to reclaim social legitimacy and public trust. The first step to gain the same is to break the nexus with the political executive,”
এই মুহূর্তের দাবি হল, মানুষের ভরসা আর সামাজিক বৈধতা ফিরে পাওয়া, আর তার জন্য প্রথমেই রাজনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করাটাই প্রথম পদক্ষেপ। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল, “Democracy: Role and Responsibilities of Investigative Agencies” গণতন্ত্র, তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এবং দায়িত্ব। সোজা বাংলায় বললে দাঁড়ায়, রাজনৈতিক নেতাদের ইশারায় চলা বন্ধ করুন, একমাত্র তাহলেই নিজেদের খোয়া যাওয়া মান ও মর্যাদা ফিরে পাবেন। এইটুকু বলেই থেমেছেন নাকি? বলেছেন, “When it comes to the CBI, it possessed immense trust of the public in its initial phase. In fact, the Judiciary used to be flooded with requests for transfer of investigations to the CBI, as it was a symbol of impartiality and independence, Whenever the citizenry doubted the skill and impartiality of its own state police, they sought an investigation by the CBI, as they wanted justice to be done. But, with the passage of time, like every other institution of repute, the CBI has also come under deep public scrutiny. Its actions and inactions have raised questions regarding its credibility, in some cases,”
জাস্টিস রামান্না বলছেন, একটা সময় পর্যন্ত মানুষের অগাধ বিশ্বাস ছিল সিবিআইয়ের ওপর, সুপ্রিম কোর্টে হাজার একটা আবেদন জমা পড়ত সিবিআই তদন্তের জন্য, কারণ ছিল তাঁদের নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীন কাজকর্মের জন্য। যখনই মানুষ মনে করেছে, স্থানীয় পুলিশ ঠিঠাক তদন্ত করছে না, করবে না, তখনই তাঁরা সি বি আই তদন্তের দাবি করেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সি বি আই মানুষের ভরসা আর তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে তিনি কেন ঠিক এই সময়টাকেই বেছে নিলেন এই কথাগুলো বলার জন্য, তিনি মনে করছেন, রাজনৈতিক নেতাদের চাপ এবং নির্দেশে কাজ করার জন্যই সি বি আই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এখানেই থামেন নি, তিনি আরও বলেছেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা আসবে যাবে, কিন্তু আপনারা থেকে যাবেন, তাই আপনাদের দায়িত্ব আরও অনেক বেশি। কী করা উচিত সেকথা বলতে গিয়ে জাস্টিস রামান্না বলছেন, সমস্ত তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে এক নিরপেক্ষ সংস্থা বানানো উচিত, তারা যাতে নিজেদের মত করে, স্বাধীন ভাবে তদন্ত করতে পারে, তারও গ্যারান্টি চাই।
কেবল সিবিআই বা তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে নিয়েই বলেননি, তিনি একজায়গায় বলছেন, “Our rich diversity cannot be sustained through dictatorial governance. It is only through democracy that our rich culture, heritage, diversity, and pluralism can be sustained and strengthened,” আমাদের দেশের সমৃদ্ধ বৈচিত্র এক স্বৈরাচারী শাসন দিয়ে টিকিঁয়ে রাখা যাবে না, আমাদের সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর বহুস্বর কে টিঁকিয়ে রাখতে হলে গণতন্ত্রকে কেবল বজায় রাখাই নয়, আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যে সংকট আমাদের চোখের সামনে, জাস্টিস রামান্না সেটাকেই চিহ্নিত করলেন তাঁর বক্তৃতায়।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মুখ্য বিচারপতি তো কোনও রাখ ঢাক রেখে কথা বলেননি, তিনি সাকুল্যে দুটো কথা বলতে চেয়েছেন, খুব পরিস্কার করেই বলেছেন, প্রথম কথা হল, ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সিগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে, সি বি আই থেকে ইডি, এস এফ আই ও থেকে এন আই একে সরাসরি রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে এই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে, এই কাজ শুরু হয়েছিল বহু আগে, কিন্তু এই মূহুর্তে তা চরমে উঠেছে বলেই মুখ্য বিচারপতিকে এখনই এই কথা বলতে হল।
কেবল লখিমপুর খেরির কথাই ধরুন, কৃষকরা প্রতিবাদ জানাতে এসেছিলেন, কর্মসূচী শেষ, তাঁরা বাড়ি ফিরছেন, দেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে গাড়ি চাপা দিয়ে ঘটনাস্থলেই চারজন কৃষক একজন সাংবাদিককে পিষে মেরে ফেলেছে, ঘটনার আগে মন্ত্রী স্বয়ং আন্দোলন কারীদের সবক শিখানে কা হুমকি দিয়েছেন, ঘটনার ভিডিও আছে, কিন্তু সেখানে সি বি আই তদন্ত নেই, মুখ্য অভিযুক্ত মন্ত্রীপুত্র জামিন পেয়ে গিয়েছে, সিবিআই তদন্ত? না হয়নি।
ঠিক নির্বাচনের আগে রাজ্যে রাজ্যে বিরোধীদের, বা বিরোধী ঘনিষ্ট ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে সিবিআই, ইডি, তাদের ডাক পাঠিয়ে জেরা করা হচ্ছে, যেন বিজেপি দলের নেতা বা তাদের ঘনিষ্ট শিল্পপতিরা দেবশিশু, মুকেশ আম্বানির ছোট ভাই অনিল আম্বানি ব্যাংকের কত টাকা শোধ দেননি? কত বকেয়া? সে সব টাকা কোথায় গেল? বিজেপি কেবল নয়, প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ট ব্যবসায়ী যারা দেশের টাকা মেরে দিয়ে পগার পার, তাদের একজনও ধরা পড়েনি, অথচ তাদের ধরতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, তারা বিদেশে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ক্রিকেট ম্যাচ দেখছে, ৯ লক্ষ টাকা দামের জ্যাকেট গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যে হাজার একটা জঘন্য ঘটনা ঘটেই চলেছে, একটারও কিনারা নেই, কারা মারল গোরক্ষপুরের ব্যবসায়ীকে? কে বা কারা দায়ী হাথরস গণধর্ষণের? কেউ জানে না।
আদানির বন্দরে এক জাহাজেই পাওয়া গেল লক্ষ কোটি টাকার ড্রাগস, তার কিনারা এখনও নেই, অথচ ৫/১০ গ্রাম ড্রাগস আছে এই সন্দেহে শাহরুক পুত্র আরিয়ান এর বিরুদ্ধে মামলায় কি তৎপরতা, এসব প্রমাণ করে আসলে কী চলছে, আর সেই কথাই সেদিন জাস্টিস রামান্না বলেছেন।
বিরোধী রাজ্যে পান থেকে চুন খসলে সিবিআই, এবং সেটাও এমন নয় যে তারা সেই অপরাধ, ষড়যন্ত্র ফাঁস করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে, তাদের শাস্তি দিতে পারছে, না এমনও নয়, কেবল ভয় দেখানোর জন্য, চাপ তৈরি করার জন্য তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে, সিবিআই কর্তারা সেই চাপের সামনে মাথা নোয়াচ্ছেন, এটাই বলেছেন জাস্টিস রামান্না।
দু নম্বর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাস্টিস রামান্না তুলে ধরেছেন তা হল আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই আজ প্রশ্নের মুখে, আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, ভাষা, ধর্মীয় আচার বিচারের বৈচিত্র, খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র, পোশাক আশাকের বৈচিত্রকে ধ্বংস করে এক আজব তথাকথিত হিন্দুত্ব, হিন্দু রাষ্ট্রবাদকে প্রোমট করার চেষ্টা চলছে, যেখানে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ তাঁর টিকি রাখতে পারবেন, মাথায় সিঁদুর কিম্বা চন্দনের টিকা চড়িয়ে যত্র তত্র ঘুরে বেড়াতে পারবেন, কিন্তু এক মুসলিম মহিলা হিজাব পরলে তার বিরোধিতা হবে রাস্তায়, মুসলমান দোকানের হালাল মাংসের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়া হবে, ঝটকাতে তাদের আপত্তি নেই, এবং এ চলছে সারা দেশ জুড়ে, অনর্গল মিথ্যে প্রচারের মাধ্যমে আজগুবি মিথ তৈরি করা হচ্ছে, আমাদের যাবতীয় ঐতিহ্যকে, সম্প্রিতীকে চুলোর দোরে পাঠিয়ে হিন্দু রাষ্ট্রবাদের শ্লোগান তোলা হচ্ছে, জাতির পিতার হত্যাকারীকে পুজো করা হচ্ছে, গান্ধী হত্যাকে জাস্টিফাই করার কাজ শুরু হয়েছে, ঠিক সেই সময় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মুখ্য বিচারপতি বলছেন, দেশের বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর বহুস্বরকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন আরও শক্তিশালী গণতন্ত্রের।
অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এবং এই সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা তিনি বললেন, স্বাগত জানাই এই বক্তব্যের প্রত্যেক কথা, প্রত্যেক শব্দগুলোকে, অভিনন্দন জাস্টিস রামান্নাকে, যিনি শিরদাঁড়া সোজা করে এই কথাগুলো বললেন। কিন্তু এরই সঙ্গে মাননীয় জাস্টিস রামান্নাকে আমার প্রশ্ন এই সময়ের মধ্যেই ঐ সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে যে মামলাগুলো পড়ে আছে, যে মামলাগুলোর রায়ের ওপর নির্ভর করছে আগামী ভারতবর্ষের সামাজিক রাজনৈতিক কাঠামো, সেগুলোর কী হাল? সেগুলোর সমাধানই বা হচ্ছে না কেন? সেখানে কোন চাপ কাজ করছে? ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া নিয়ে যে মামলা তার শুনানি হচ্ছে না কেন? কাশ্মীরকে দুভাগ করা নিয়ে যে মামলা তার শুনানিই বা হচ্ছে না কেন? নির্বাচন প্রচারে টাকা রাষ্ট্র যোগাবে, দল বা ব্যক্তি নয়, এই মামলারও শুনানি নেই, সি এ এ নিয়ে মামলার শুনানি নেই কেন? সাংবিধানিক প্রশ্ন আর সমস্যার সঙ্গে জড়িত এইসব গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় তো দুরস্থান, শুনানিও হচ্ছে না, কেন? এ প্রশ্নের জবাব তো মানুষ চাইবেই, বিচারবিভাগ তো এক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, নাকি সেখানেও রাজনৈতিক চাপ আছে, সে প্রশ্নও তো উঠছে।এর জবাবও তো জাস্টিস রামান্নার কাছেই আছে, সেটা নিয়েও তো আলোচনা হওয়া উচিত।
শেষ করার আগে একটা কথা না বললেই নয়, এসব কথা জাস্টিস রামান্না বললেন, বললেন শুক্রবার, পয়লা এপ্রিল, ঘটনাচক্রে সেদিনটা এপ্রিল ফুলস ডে, বোকাদের দিন, সেটাও মাথায় রাখছি।