আমার ঠাকুমা, আমার জ্যাঠতুতো ভাইকে ঘেঁটুর ছেলে বলে ডাকতেন, এটা তো পরিষ্কার যে আমার জেঠুর ডাকনাম ঘেঁটু ছিল৷ কিন্তু আমার জেঠুর ছেলে তো নাম গোত্রহীন ছিল না৷ তাহলে? আসলে আমার জেঠুর ছেলের নাম ছিল ত্রিদিব৷ ওদিকে আমার ঠাকুরদার বড় দাদার নামও ছিল ত্রিদিব, আর যাই হোক ভাসুরের নাম ধরে তো ডাকা যায় না৷ তাই ঘেঁটুর ছেলে। বরের নাম না ধরে ডাকা ভাসুরের নাম না ধরে ডাকা ইত্যাদির প্রচলন ছিল৷ এখনও যে একদম উঠে গিয়েছে তাও নয়। গোপনে আমরা হেডস্যারকে হেডু বলেছি, জীব বিজ্ঞানের স্যরকে কেন্নো, অংক স্যরকে ক্যালকুলাস, ইংরিজি স্যরকে শেক্সপিয়ার। এসবও নতুন কিছু নয়৷ ঠিক এই সময় জেন নেক্সটরা তাদের মাস্টার মশাইদের যে ডাক নাম দেয়, তা জানতে পারলে তাদের অনেকেই অক্কা পাবে নিশ্চিত। জায়গার নামেও এমন বদল অনেকেই আছে৷ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, জানি না বানিয়ে বলেছিলেন কিনা, বলেছিলেন শ্যামবাজারকে নাকি অনেক বাস কনডাকটর, ঘোড়েওয়ালা মোড় বলে ডাকতেন, আ গয়া ঘোড়েওয়ালা মোড়, নেতাজির থেকে ঘোড়াটার সাইজ বড় কি না, তাই। খালাসি টোলাকে কেটি বলা হয় জেনেছিলাম কবি বন্ধুদের কাছ থেকে। দিঘা,পুরী, দার্জিলিংকে দিপুদা বলা হয়৷ রবীন্দ্র নজরুল সুকান্ত সন্ধ্যাকে রসুন বলা হয়৷ এসবও এক ধরণের নামবদল৷ আজ নয় বহুদিন ধরেই এসব চালু আছে।
দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে, নতুন নামকরণের ধুম পড়ে গেল৷ গুচ্ছের সাহেবি নামের বদলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী, দেশবরেণ্য কবি সাহিত্যিকদের নামে রাস্তা হল, কলেজ হল, স্কুল তখন জমিদাতাদের নামে, যিনি পয়সা দিয়েছেন তাঁর মা বা বাবার মার নামেই হয়েছে, ননিবালা প্রাইমারি হাইস্কুল, সতিপ্রসন্ন হাই স্কুল ইত্যাদি। সাহেবরা, ব্রিটিশ রাজত্বে সবকিছু নাম তাঁদের নামেই রাখেনি৷ অনেক কিছুই ছিল স্থান মাহাত্ম্য, লোয়ার সার্কুলার রোড, আপার সার্কুলার রোড, সাদার্ন এভনিউ ইত্যাদি, সে সব বদলে গেল, সিংহভাগ পেলেন নেতাজি আর গান্ধিজি৷ স্বাভাবিক৷ কিছু পেলেন বিপ্লবীরা, ডাক্তারবাবু, সমাজসেবী ইত্যাদিরা। এরপর বড় বদল বাম আমলে, সে কেরালা বা বাংলা, ত্রিপুরা যেখানেই বামেরা এলেন ক্ষমতায়, লেনিন বসলেন, কোথাও মার্কস। খিদিরপুরে হঠাৎই হল কার্ল মার্কস স্মরণি, ধর্মতলায় লেনিন স্কোয়ার। কিন্তু এসবই ছিল নতুন নাম বা এমন কোনও নাম যা প্রচলিতও ছিল না। কিছু বদল তো দারুণ ছিল৷ অ্যান্ডারসন হাউসের নাম হল ভবানীভবন, দার্জিলিং এ স্যর জন আন্ডারসনকে গুলি করে মারার চেষ্টা হয়েছিল, অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন গভর্নর অ্যান্ডারসন, গুলি চালিয়েছিলেন ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্যি, সঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দুজনেরই ফাঁসি হয়৷ ছিলেন মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, উজ্জ্বলা মজুমদার, সুকুমার ঘোষ, ওনাদের জেল হয়। সেই বিপ্লবী ভবানী প্রসাদের নামে অ্যান্ডারসন ভবনের নাম রাখা হয়৷ যেখানে স্বাধীন ভারতবর্ষে পুলিশ, গোয়েন্দারা বসেন, জেরা হয়, চড় থাপ্পড়, মারধোরও হয় বৈকি।
তো যে কথা বলছিলাম তাতে ফিরে আসি৷ বাম আমলেও কিছু কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের নামে, মার্কস, লেনিন, হো চি মিন এর নামে, রাস্তা ঘাট হয়, না মাও এর নামে হয়নি, সে যখন মাওয়িস্টরা ক্ষমতায় আসে, যদি আসে, তাহলে হবে হয় তো। ইতিমধ্যে বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে, তারাও কিছু নামের ভাগিদার হয়েছে, রাস্তার নাম শ্যামাপ্রসাদের নামে রেখেছে, তাঁদের বিরাট ঐতিহ্য তেমন নেই৷ তাঁদের পূর্বসূরিরা ইংরেজদের দালালি করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, ইংরেজদের কাছে মুচলেকা দিয়ে চিরজন্ম তাঁদের গোলামি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ অতএব তাদের নামে, গান্ধী হত্যাকারী গডসের নামে তো রাস্তা, স্কুলের নাম রাখা যায় না, অন্তত যাচ্ছিল না৷ কাজেই ওই শ্যামাপ্রসাদ, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের পরে সোজা চলে যেতেন শিব শম্ভু মার্গ, দূর্গা চক ইত্যাদিতে।
কিন্তু ২০১৪ র পর থেকে, এই নামবদলের সঙ্গে তাঁরা জুড়ে নিলেন ভোটের রাজনীতিকে। এটা ভারতবর্ষে নামবদলের ক্ষেত্রে এক নতুন প্রচেষ্টা, এর আগে কংগ্রেসীরা তাদের নেতাদের নামে রাস্তা ঘা্ট, স্কুল কলেজের নাম দিয়েছিল, বামেরা তাঁদের নেতা, দার্শনিক ইত্যাদিদের নামে, কিন্তু তার সঙ্গে নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক ছিল না। এমন কি অটল জমানাতেও, ২০১৪ র আগে ওবদিও নাম পরিবর্তন করেছে বিভিন্ন বিজেপি সরকার, কিন্তু তার সঙ্গে ভোটের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ২০১৪ র পরে শুরু হল সেই কাজ, প্রথমে হোয়াটস অ্যাপে কুৎসা, নোংরা কথার বন্যা, আওরঙ্গজেব কা আওলাদ হ্যায়, কাদের বলা হচ্ছে, তা সবাই জানে, তারপর নাম বদল। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে ইসলামিক নাম, ঔররঙ্গজেব রোড হোক, এলাহাবাদ হোক, মুঘলসরাই স্টেশন হোক, ফৈজাবাদ হোক, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে পুরনো নাম কোনও মুসলমান শাসক, বা ইসলামের সঙ্গে জড়িত। তাকে পাল্টাতে হবে, কেন? এই প্রশ্ন যেই করবেন, ব্যস, আপনি সেকুলার, আপনি মুসলিমদের তোষণ করছেন, আপনি তার বিরোধিতা করবেন, ওনারা সেটাই চান৷ আলোচনা হবে, বিতর্ক হবে, নূপুর শর্মা, সম্বিত পাত্র, নভীন জিন্দলদের দল চ্যানেলে চ্যানেলে বিষ ছড়াবেন৷ প্রশ্ন উঠবে কেন জায়গার নাম আল্লার নামে হবে? এলাহাবাদ কেন? হর্ষবর্ধনের সময় তো ওই জায়গার নাম ছিল প্রয়াগ৷ আজও প্রয়াগ তীর্থক্ষেত্র হিন্দুদের, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু, তাহলে কেন এলাহাবাদ নাম হবে?
একবারও কেউ বলেওছে না, প্রস্তর যুগেও তো ওই এলাকার কোনও একটা লাদা নাম ছিল, আমরা ঠিক কতটা পিছবো? না ওনাদের প্রয়াগরাজই চাই, মানুষ ধর্মের নামে উত্তেজিত হবে, ওনারা আরও ধোঁয়া দেবেন, ভোটের মেরুকরণ, আরএসএস – বিজেপির লাভ। সরল অংক। দক্ষিণে এসব খাওয়ানো যায় না, কর্ণাটক বাদ দিলে অন্য কোথাও এই রাজনীতি চলে না, অন্তত এতদিন চলেনি। কিন্তু দক্ষিণ আরএসএস – বিজেপির চাই, দক্ষিণেও হিন্দু ভোটের মেরুকরণ চাই। পশ্চিম হাতে এসেছে, মহারাষ্ট্র ছিল না, সেটাও এসেছে, বিনিময় মূল্য নাকি কয়েক হাজার কোটি টাকা, হবেও বা। পূবদিকেও একই খেলা, অসমে আগে কংগ্রেসী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এখন রোজ বিষ উগরোচ্ছেন, বাকি বাংলা, ঝাড়খন্ড, বিহারেও তেমন সুবিধে হয়নি, সে ঘাটতি মেটাতে দক্ষিণ চাই৷ গতবার এই বাংলা থেকে ১৮ জন সাংসদ ছিল, এবার? একটা হবে? সন্দেহ আছে। তাহলে সে ঘাটতি কোথাথেকে পুরণ হবে, এমনিতেই এবারে অ্যান্টি ইনকম্বান্সির হাওয়া তো থাকবেই, থাকবে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি ইত্যাদি ইস্যুতে রিভার্স সুইং।
তাহলে? কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, ওড়িষ্যা তে হবে না, কর্ণাটকে যা ছিল তাই কিম্বা একটা বেশি, সেই জন্য টার্গেট তেলঙ্গানা। সেখানেই বসেছিল বিজেপির জাতিয় পরিষদের বৈঠক, টার্গেট তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রিয় সমিতি, তাদের নেতা কে চন্দ্রশেখর রাও, বিজেপি কংগ্রেস কে সরিয়ে উঠে আসতে চাইছে, কংগ্রেস আসন ধরে রাখতে চাইছে, টিআরএস তাদের আসন বাড়াতে চাইছে। তো রাষ্ট্রীয় পরিষদের বৈঠকে গেলেন নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি, অন্য কিছু কথা বললেন বটে কিন্তু মোদ্দা কথাটা ছিল, হায়দরাবাদের নাম পালটিয়ে ভাগ্যনগর করা হবে৷ বিজেপি জিতে আসলে, দলের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন, জানালেন রবিশঙ্কর প্রসাদ। মানে স্বয়ং মোদিজি ঘুঁটিটা ফেলে দিলেন, এবার লড়ে মর। তেলঙ্গনার হিন্দু মানুষজনকে বলা হল, হায়দরাবাদ নয়, ভাগ্যনগর হোক।
সেই ১৫৯১ তে মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ, কুতুব শাহ বংশের পঞ্চম সুলতান হায়দ্রাবাদের পত্তন করেন, তার আগের ইতিহাস টা কী? ইতিহাসে এই এলাকার হদিশ পাওয়া যাচ্ছে ৬২৪ খৃষ্টাব্দ থেকে, তখন চালুক্যদের রাজত্ব, এরপর কাকাতীয়, তারপর খলজি, তুঘলক, মুসুনুরি নায়ক, বাহমনি, হয়ে কুতুব শাহী শাসন শুরু হয়১৫১৮ তে, তখনও এই হায়দরাবাদের নাম কোথাও ছিল না, কুতুবশাহী বংশের আগে থেকেই গোলকোন্ডা দূর্গ তৈরি হয়, এখন যেখানে আছে, তার থেকে খানিক দূরে, তারপর এই মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ ঐ গোলকোন্ডা এলাকার জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য, হায়দ্রাবাদের পত্তন করেন, তিনিই চারমিনার তৈরি করেন, মক্কা মসজিদও তাঁর তৈরি। তাহলে এই ভাগ্যনগর এলো কোথা থেকে? এক কাহিনী মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে যে ভাগ্যমতি নামে এক নর্তকী ইসলাম ধর্ম নেন, তাঁর নাম হয় হায়দর মহল, তিনি সুলতানের প্রেয়সী ছিলেন, তাঁর নামেই হায়দরাবাদ হয়, কোনও ঐতিহাসিক এই গপ্পো মেনে নেননি, এটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া এক গল্প মাত্র, কিন্তু মোদিজি এখান থেকেই রসদ পেয়েছেন, নির্যাতিতা, ধর্ম কেড়ে নেওয়া হিন্দু নর্তকীর নামেই হোক শহরের নাম, আগুন জ্বলুক। চারমিনার ভাঙা হোক, মক্কা মসজিদ ভাঙা হোক, হায়দরাবাদী বিরিয়ানিকে ভাগ্যনগর পোলাও বলা হোক, মীনা বাজার হোক রাধা বাজার, এসব আসবে আস্তে আস্তে, এখন দরকার তীব্র মেরুকরণের, লক্ষ ২০২৪। যেখানে এই সমস্যা নেই, ধরুন আমেদাবাদ, তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া নেই, কারণ ভোটের চিন্তা নেই, ওখানে মেরুকরণের প্রক্রিয়া শেষ, তাই আপাতত হায়দরাবাদের নাম নিয়ে চিন্তিত মোদিজি, আসলে নতুন করে আগুন লাগাতে চাইছেন, দাঙ্গার আগুন।