রাজা আদেশ দিল, যাও ধরে নিয়ে এসো অমুক চন্দ্র অমুককে৷ এতবড় স্পর্ধা তার, সে রাজার বিরোধিতা করে, তার বিচার হবে এই রাজসভায়। তো সেই অমুকচন্দ্র তমুককে ধরে আনা হল৷ আসা মাত্র রাজা বলে উঠল, কোতোয়াল, ওর মাথাটা ধড় থেকে নামিয়ে দাও। ব্যস, হয়ে গেল। এরকমই ছিল রাজ আইন৷ তিনিই অভিযোগকারী৷ তিনিই ধরে আনছেন৷ তিনিই বিচার করছেন৷ তিনিই সব। পৃথিবী থেকে রাজতন্ত্র উঠে গিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এল৷ কিন্তু এরমধ্যেও কিছু রাজনৈতিক নেতা স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠলেন, মানে? মানে ওই, নিজেই অভিযোগ আনলেন, নিজেই ধরে আনালেন, নিজেই বিচার করলেন। আসলে এই পদ্ধতিই স্বৈরতন্ত্র, দেশের রাজ্যের সব ক্ষমতা নিজের হাতেই রাখা, রাখলে উনিই রাখবেন, মারলে উনিই মারবেন। স্বৈরতন্ত্রের চেহারাটা এমন, বরাবরই এরকম।
সেই স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসছে ভারতবর্ষে৷ প্রশাসন, প্রশাসনের মাথায় বসে থাকা রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ আনছেন, বিচার করছেন, শাস্তিও দিয়ে দিচ্ছেন, ফটাফট। কী হয়েছে? ধর্ষণ করেছে? আজ্ঞে হ্যাঁ অভিযোগ তো তেমনই। ব্যস, এনকাউন্টার করে দাও, লাশ পড়ে থাকুক রাস্তায়, হাসতে হাসতে বলে দেওয়া হোক, পুলিশের হাত ছাড়িয়ে পালাতে গিয়েছিল, পুলিশকে মারার চেষ্টা করেছিল, তাই পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়, মরে গিয়েছে, লাশকাটা ঘরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কে? মাফিয়া? এনকাউন্টার করে দাও, সাংবাদিকদের আটকে, হাস্যকর নাটক তৈরি করে, মেরে ফেলা হল। এবং মজার কথা হল সেই প্রশাসনের মাথায় বসা মহন্ত আদিত্যনাথ যোগী, গর্ব করে জনসভায়, মিডিয়ার কাছে সাক্ষাৎকারে বললেন, ৪৬ জনকে এনকাউন্টার করা হয়েছে, ৫৬ জনকে এনকাউন্টার করা হয়েছে, জিরো টলারেন্স, মিডিয়া বড় করে প্রচার করলো, কাগজে ছাপা হল, ভক্তরা বললো, দেখেছো, এই হল শাসন, কেউ বললো না তাহলে এই বিরাট বিচার ব্যবস্থা কি মূলো চাষ করার জন্য আছে? এই বিরাট জুরিসপ্রুডেন্স, এই আইনের বই, ধারা সেগুলো দিয়ে কী করা হবে? মিউজিয়াম? কেউ বললো না বললে ভুল হবে, কেউ কেউ বললো বটে, কিন্তু তাদের কন্ঠ শোনাই গেল না। এই মহন্তই ঘোষণা করেছিলেন, সিএএ, এনআরসি আন্দোলনে যারা মিছিল করছে, অবরোধ করছে, জমায়েত করছে, তাদের ফাইন করা হবে, জরিমানা করা হবে, করা হয়েও ছিল, বহুপরে আদালতের রায় এসেছিল, তাতে বলা হয়েছিল, এটা রাজ্য সরকার করতে পারে না।
আগেও বলেছি বহুবার, প্রশাসন আইন লাগু করতে পারে, কিন্তু তাদের বিচার করার অধিকার নেই, শাস্তি দেওয়া তো দূরস্থান, পুলিস অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্তকে গ্রেফতার তো করতেই পারে, তাকে শাস্তি দিতে পারে না, একটা থাপ্পড় বা একটা লাঠির বাড়ি মারার আইনি অধিকার পুলিসের নেই, কিন্তু যোগী রাজ্যে সেসবের বালাই নেই৷ নূপুর শর্মা নবীকে নিয়ে কটুক্তি করেছে, যারা সেই কটুক্তিতে আঘাত পেয়েছেন, ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাঁরা রাস্তায় নেমে মিছিল করলে, তাদেরকে চিহ্নিত করা হবে, তাদের জরিমানা করা হবে, থানায় ঢুকিয়ে বেদম পেটানো হবে, বাড়ি ভাঙতে বুলডোজার পাঠানো হবে, ভেঙে দেওয়াও হবে, ওদিকে সেই নূপুর শর্মার জন্য নিশ্ছিদ্র পাহারা বসেছে, তিনি সুরক্ষিত। নবি বিতর্কের জেরে সাহারানপুরে যে বিক্ষোভ মিছিল, ভাঙচুর হয়েছিল, তার ভিত্তিতে দুজনকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়, কে আদেশ দিল? প্রশাসন? দিতে পারে? কানপুরে যে গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়েছিল প্রথম দিনেই, সেখানেও একজনকে চিহ্নিত করা হয়, তার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় বাড়ি, বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেন? ঐ অভিযুক্ত নাকি সেখানেই থাকতেন।
প্রয়াগরাজেও এরকম মিছিল, বিক্ষোভ, হিংসার ঘটনা ঘটে, মাত্র গতকাল সেখানেও বুলডোজার হাজির ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়ার নেতা, জাভেদ আহমেদের বাড়ি ভাঙা হল, জাভেদ অবশ্য জেলে৷ আজ জানা যাচ্ছে, ওই সম্পত্তি তাঁর স্ত্রী, যিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে এই সম্পত্তি পেয়েছিলেন৷ পতির পূণ্যে সতীর পূণ্য হলে পতির অপরাধে সতীর অপরাধ হবে না কেন? এটাই তো যুক্তি, মধ্যযুগীয় যুক্তি। একজন বিজেপি নেতা শলভ মনি ত্রিপাঠি, টুইট করেছেন, রিটার্ন গিফট, মানে গতকাল বিক্ষোভ দেখিয়েছো, আজ পুরষ্কার নাও, বেশ কিছু মানুষজনকে বেধড়ক পেটাচ্ছে পুলিস, কতটা নীচে নামতে পারে প্রশাসন, উত্তরপ্রদেশে গেলে বোঝা যাবে, কেবল ভাঙা, কেবল মারা? ওই যে প্রয়াগরাজে জাভেদ আহমদের বাড়ি ভাঙার কথা বললাম, সেখানে বুলডোজার গেল, তার পেছনে পেছনে পুলিস ও গেল, যে বাড়িটা পুলিস বুলডোজার নিয়ে ভাঙতে আসছে, সেই বাড়ির মালিকরা কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ছেড়ে চলেও গেল, কিন্তু পুলিস ওই বাড়ি থেকেই দুটো পিস্তল, কিছু আপত্তিকর কাগজপত্র উদ্ধার করলো। সন্ধ্যে থেকে খবর বাড়ি ভাঙা হবে, সকাল থেকে বাড়ির লোকজন বাড়ি ছাড়তে শুরু করলেন, বেলা একটায় পুলিস এসে পিস্তল উদ্ধার করলো, পুলিস না পোষা চাকর? উত্তরপ্রদেশে রাজ্য জুড়ে এই অরাজক অবস্থা জারি আছে, আদিত্যনাথ যোগী এই ভাবেই পুলিস, প্রশাসন, বুলডোজার দিয়ে বিক্ষোভ থামানোর চেষ্টা করছেন, যে বিক্ষোভের শুরুয়াত করিয়েছেন, তাঁর দলের রাষ্ট্রীয় মুখপাত্র। গোটা দেশে এক অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়েছে এই মোদি যোগী, শাহ, আর এস এস – বিজেপি সরকার, যে অসহিষ্ণুতার ফলাফল ওই নূপুর শর্মা বা নবীন জিন্দলের অসভ্য উক্তি, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, তা আজ পৃথিবী জুড়ে, সেই ক্ষোভকে সামলানোর জন্যে আনা হল বুলডোজার, এবং সব কিছুর মাঝখানে চুপ করে মৌনিবাবা হয়ে বসে আছেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, যে কোনও কথায় প্রায় বাচালের ভূমিকায় থাকা তাঁর অভ্যেস, এখন চুপ, দেশকে বিশ্বগুরু বানানোর কথা বলে, সারা বিশ্বে কাছে দেশের মানুষের মাথা হেঁট করে দিয়েছেন, এখন চুপ করে থেকে ম্যানেজ করার চেষ্টা চলছে, এনার চেয়েও বড় উগ্র হিন্দুত্ববাদী হয়ে ওঠার লড়াই এ এগিয়ে থাকার জন্যই যোগীজী চুপ তো নয়ই, বরং বুলডোজার নিয়ে হাজির, রিটার্ন গিফট, পুলিসের বেধড়ক মার নিয়ে হাজির, এবং সেটাও বড়করে ঘোষণা করতে পিছুপা নন।
এদিকে বাংলায় তার আঁচ পড়েছে, এরাজ্যে ৩৩% মুসলমান মানুষজন থাকেন, স্বাভাবিকভাবেই তার এক বড় অংশ উত্তেজিত, রাস্তা অবরোধ করছেন, সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন, মমতা প্রশাসন চেষ্টা করছেন, যতটা সম্ভব মানবিকভাবেই এই অবস্থা সামলানোর, জেলাশাসককে সরানো হয়েছে, পুলিশি পেট্রল বাড়ানো হয়েছে, বিভিন্ন ধর্মের মানুষজন হিংসা থামানোর আহ্বান জানাচ্ছেন, এমন কি আব্বাস সিদ্দিকিও সেই আহ্বান করেছেন, ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে, হ্যাঁ বুলডোজার না চালিয়েও, থানায় নিয়ে গিয়ে ছাগল কুকুরের মত মারধোর না করেও, অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সেটা আবার না পসন্দ, বিজেপি নেতাদের, বিশেষ করে কাঁথির খোকাবাবু তো উত্তেজিত, এমন লাশের রাজনীতি হাত থেকে না বেরিয়ে যায়, এই সুযোগে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা লাগানো যাবে, ভোটে মেরুকরণ হবে, উনি তো আগেই বলে দিয়েছেন, আমাদের ৭০ চাই, তিরিশ নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই, তো স্বাভাবিকভাবেই এই সুযোগ উনি ছাড়বেনই বা কেন? ওদিকে দিলীপ ঘোষ ঢুকে পড়েছেন, এদিকে সুকান্ত ঢাক ঢোল পিটিয়ে লালবাজারে গিয়ে গ্যালারি গরম করে ফেলেছেন, খোকাবাবু এখনও পিছিয়ে, তাই উত্তেজিত। ও খোকাবাবু, আপনার জানা নেই, জানা থাকার কথাও নয়, আমাদের বাংলার জমিতে লালনের বীজ ছড়ানো আছে, রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সেচ, চৈতন্যের বাতাস বয় এখানে, নেতাজী সুভাষ এই বাংলারই মানুষ যাঁর সৈন্যবাহিনীতে হিন্দু, মুসলমান, ক্রিস্টান, শিখ এক সঙ্গে বসে খেতেন, তারপরেও এই মাটিতে তারাশংকর থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পুতুলনাচের ইতিকথা থেকে পদ্মা নদীর মাঝি, এখানে আপনার খোকাগিরিতে হাওয়া দেওয়ার মানুষ পাবেন না, মাঝে মধ্যে সুর তাল লয় কাটে বটে, সে সব সাময়িক, আপনাদের ঘৃণ্য চক্রান্তে পা দেবার মত বোকা এই বাংলার মানুষ নয়, আমরা রাম, রহিমের বাছা, এক সঙ্গেই থাকবো, কোনও বিভেদের কূমন্ত্রণায় কান দেবো না, হ্যাঁ খোকা বাবু, কান দেবো না, অতএব অনেক হয়েছে শান্তিকুঞ্জে যান, বাংলার মানুষ শান্তি পাবে।