এক মিনি সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল৷ ভগওয়া ঝান্ডা সর্বত্র৷ পঞ্জাবে বিজেপি শক্তিশালী নয়, সেখানে মানুষ কংগ্রেস আর আকালি দলের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, আপ জিতেছে। বাকি চার রাজ্যে বিজেপির জয়জয়কার। তো আগামী কয়েকদিন ধরে এই জয়, বিরোধীদের পরাজয় আর এই নির্বাচন থেকে উঠে আসা, রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করব। গতকাল আমাদের আলোচনায় ছিল উত্তরপ্রদেশের হারা আর জেতার পিছনের সমীকরণ৷ আজ কথা বলব পাঁচ রাজ্যের ফলাফল নিয়ে। চার রাজ্যে বিজেপি জিতেছে৷ ভালোভাবেই জিতেছে৷ পঞ্জাবে আপ সুইপ করেছে৷ আক্ষরিক অর্থেই ঝাড়ু চালিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী ছন্নি দুটো আসনেই, সিদ্ধু পাজী তাঁর আসনে, অমরিন্দর সিং, প্রকাশ সিং বাদল এবং তাঁর পরিবারের ৪ জন হেরে ভূত।
যে দল দেশের চারটে নির্বাচনে বিরাট জয় পেল, সেই বিজেপি তাদের নতুন শরিক অমরিন্দর সিংকে সঙ্গে নিয়েও গতবারের চেয়ে ১ টা আসন কম পেল, তা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনার টাকা, কৃষক সন্মান নিধির টাকা, ফ্রি রেশন কি পঞ্জাবের মানুষ পায়নি? পেয়েছে, তাহলে? ওই যে আগেই বারবার বলেছি, বেনিফিসিয়ারি ভোট কাজ করে তখনই, যখন সেই বেনিফিসিয়ারিদের রাজনৈতিক আনুগত্যও পাওয়া যায়৷ পঞ্জাবের বেনিফিসিয়রিরা সমস্ত বেনিফিট পেয়েছেন৷ কিন্তু না, ভোট বিজেপিকে দেননি৷ ভোট আপ পেয়েছে৷ এমন কি ডেরা সচ্চা সওদার কনভিক্টেড ক্রিমিনাল বাবা রাম রহিমকে প্যারোলে ছেড়ে, জেড প্লাস সিকিউরিটি দিয়েও লাভ হয়নি।
আসলে এই লাভার্থীদের রাজনৈতিক আনুগত্য না পেলে ভোট পাওয়া যায় না, এ বাংলায় মতুয়ারা পেয়েছেন, কন্যাশ্রী পেয়েছেন, রূপশ্রী পেয়েছেন, রাশন পেয়েছেন, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য? বিজেপির দিকে তাই মতুয়া ভোট পেয়েছে বিজেপি, আগামীদিনে মতুয়া নেতারা তৃণমূলের দিকে এলে ফল উলটে যাবে, একই কথা প্রযোজ্য পুরুলিয়া ঝাড়খন্ড সীমান্ত ঘেঁষা হিন্দিভাষী আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও। কেবল রেশন দিলেই হবে না, রাজনৈতিক আনুগত্যও জরুরি, পঞ্জাবে সেই আনুগত্য ছিল আপের দিকে।
এবার আসুন আপ আর বিজেপির একটা তুলনামূলক আলোচনা করা যাক। বিজেপি ভয়ঙ্করভাবেই রাষ্ট্রবাদী, জঙ্গি রাষ্ট্রবাদীও বলাই যায়, ওদিকে আপও রাষ্ট্রবাদী চরিত্র ধরে রেখেছে৷ কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া, আপ সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন করেছে৷ কংগ্রেস করেনি, আপ বালাকোট সার্জিকাল স্ট্রাইক সমর্থন করেছে৷ কংগ্রেস সার্জিকাল স্ট্রাইকের প্রমাণ চেয়েছে৷ জেএনইউতে ছাত্রদের বিক্ষোভ, যাদেরকে টুকরে টুকরে গ্যাং বলা হয়েছে, তাদের সমর্থনে রাহুল গান্ধী গেছেন, কেজরিওয়াল যান নি। দলের মধ্যে উদারবাদী নেতা প্রশান্ত ভূষণ, যিনি নাকি কাশ্মীরে এমন কি গণভোট সমর্থন করেন, তিনি আজ আর দলেই নেই, দলের মধ্যে সোশ্যালিস্ট, লোহিয়াইট নেতা যোগেন্দ্র যাদব আর দলেই নেই, দল এখন পুরোপুরি কেজরিওয়ালের কন্ট্রোলে।
আপের কোনও রাজনৈতিক দর্শন আজ আর নেই, তারা চায় গুড গভর্নেন্স, তারা ওয়েলফেয়ার স্টেট চায়, ফ্রি বিদ্যুৎ, শিক্ষা, চিকিৎসা তারা দিচ্ছে, রেশন দিয়েছে, তাদের বেনিফিসিয়ারি লিস্ট বিরাট, বিজেপি এই খেলাতে তাদের পেছনে ফেলতে পারেনি। এবার হিন্দুত্ব, এই প্রশ্নে কেজরিওয়ালকে দেখুন, হনুমান পুজো থেকে রামনবমীতে উনি আছেন, কেবল তাই নয়, সিনিয়ার সিটিজেনদের বিনামূল্যে চার ধাম যাত্রার ব্যবস্থা করেছেন, না হিন্দুত্বের প্রশ্নেও বিজেপি কেজরিওয়ালকে কিছুই বলতে পারছে না। অর্থাৎ বিজেপির নির্বাচন জেতার মন্ত্র আপ করায়ত্ব করেছে, এবং তাদের ওপরে কোনও করাপশন চার্জ নেই, এক ধরনের স্মার্ট এন জি ওর ভূমিকায় তারা নেমেছে, এবং এই অস্ত্রকে হাতিয়ার করেই তারা দিল্লি থেকে পঞ্জাবে ছড়িয়ে গ্যালো। তৃণমূলের থেকে কতটা আলাদা?
তৃণমূলের থেকে কতটা আলাদা আপ? জাতীয়তাবাদ বা জঙ্গি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এক্কেবারে আলাদা অবস্থান তৃণমূলের, তৃণমূল ৩৭০ ধারা তুলে দেবার বিরোধিতা করেছে, বালাকোট সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়েও তাদের অবস্থান আলাদা, কিন্তু গভর্নেন্স এর প্রশ্নে এক, তৃণমূলও এক বিরাট বেনিফিসিয়ারি তৈরি করেছে, করছে। আবার হিন্দুত্বের প্রশ্নে আপ এখনও মুসলমান জনসংখ্যাবহুল কোনও রাজ্যে পা দেয় নি, বিজেপি রাজত্ব করছে হিন্দু জনসংখ্যাবহুল কোনও রাজ্যেও পা দেয় নি।
এদিকে তৃণমূল বিজেপির সঙ্গে লড়াই করে মুসলমান ভোটও ধরে রেখেছে, হিন্দু ভোটও বিরাট ভাবে তাদের কাছ থেকে সরে যায় নি, যদিও দুর্নীতির অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আছে, বিজেপি তাকে কাজেও লাগাচ্ছে। সবমিলিয়ে দাঁড়ালো কী? আপ এমন এক রাজনৈতিক দল যা বিজেপির রাজনৈতিক হাতিয়ারকে এড়িয়েই রাজনীতি করছে, এবং সেটা করতে গিয়ে তাদের প্রধান লক্ষ কংগ্রেসের ভোট, যে ভোট ভাঙছে। পঞ্জাবের পরেই তাদের ঘোষিত লক্ষ্য গুজরাট আর হিমাচলপ্রদেশ, সেখানে বিজেপি বিরোধী ভোটকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসাটাই তাদের লক্ষ্য, আজ নয় তো কাল তারা অবশ্যই বিজেপি বিরোধী শক্তিদের মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠবে, অন্তত হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু এই মূহুর্তে তারা কংগ্রেসের ভোটের দিকেই তাকিয়ে আছে, কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে ওঠাটাই তাদের আপাতত লক্ষ্য, তারা সেই পথেই হাঁটছে।
কিন্তু সমস্যা হল, কংগ্রেসের হাতে আছেটা কী? আছে রাজস্থান, ছত্তিশগড়। মহারাষ্ট্রে মিলিজুলি সরকার আর ঝাড়খন্ডে জোট সরকার। এই চার রাজ্যে কোথাও আপের কোনও সংগঠন নেই, রাজস্থান আর ছত্তিশগড়ে সরাসরি বিজেপির সঙ্গে লড়াই, বাকি দুই রাজ্যে আপাতত বিজেপির কোনও সম্ভাবনা নেই, ঝাড়খন্ডে মুসলমান ভোট ১৫%, বিরাট আদিবাসী ভোট, যার দাবিদার ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। মহারাষ্ট্রে হিন্দু ভোটের দাবিদার শিবসেনা, কাজেই যতদিন মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাড়ি আছে, ওখানে বিজেপি দাঁত ফোটাতে পারবে না। তারমানে বড়জোর গুজরাট আর হিমাচল প্রদেশের কংগ্রেসের জায়গাটা আপ নিতে পারে, অন্তত চেষ্টা তো করতেই পারে। এবং এটা করেই আপ জাতীয় রাজনীতির একজন অন্যতম খেলোয়াড় হতেই পারে, একমাত্র খেলোয়াড় হওয়া সম্ভব নয়।
কারণ এরপর রয়েছে ওডিশা৷ সেখানে আঞ্চলিক দল বিজেডি আছে। রয়েছে তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, সেখানেও আঞ্চলিক দল বসে আছে। ভাষা, ধর্ম আর আঞ্চলিকতাবাদের সামনে আপের কোনও ফর্মুলাই কাজ করবে না। ধরুন এই বাংলা, আপের রাজনৈতিক বক্তব্য, তাদের গভর্নেন্সর মডেল কাজ তো করবেই না, উলটে ৩৩% মুসলমান ভোটকে তাদের দিকে নিয়ে আসতে গেলে যে তীব্র বিজেপি বিরোধীতা, সফল বিজেপি বিরোধীতার দরকার, তা আপের নেই, পঞ্জাবে জিতেছে বলে কলকাতায় একটা মিছিল? সে হতেই পারে, সেরকম নেতা পেলে এক আধটা আসনও পেতেই পারে কিন্তু রাজ্যের ক্ষমতা? কোনও চান্স নেই। কাজেই আপ পঞ্জাবে জয় পেল আর সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রবল শক্তি হয়ে উঠবে, তার কোনও সম্ভাবনা আপাতত নেই।
এবারে আসুন বিজেপির দিকে তাকানো যাক। হ্যাঁ তারা চার রাজ্যে জয় পেয়েছে, তার মানেই কি ২০২৪ এর রাস্তা খুলে গেছে? কিছুটা সুবিধে তো আছেই, কিন্তু ডান ডিল? না, সেরকমটা নয়। ২০১৮ র কথা মনে করুন, ৭৮% ভূখন্ডে হয় বিজেপির সরকার, নয় তো বিজেপি শরিক দলের সরকার। আজ ২০২২ এ? বড় ছোট মিলিয়ে রাজস্থান, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, ওডিশা, বাংলা, তামিলনাডু, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, কাশ্মীর, কেরলে তারা নেই। এম এল এ কিনে টিঁকে আছে কর্নাটকে, মধ্যপ্রদেশে। বিহারে জোট সরকার, তার রসায়ন খুব ভালো নয়, জাতি ভিত্তিক জনগণনা নিয়ে এই রসায়ন ভেঙে যেতেই পারে। এবং আবার একবার যদি বিজেপির রাজ্য জয়ের ফর্মুলাটা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, যেখানে আঞ্চলিক দলের নেতা শক্তিশালী, সেখানে ভাষা, ধর্ম আর আঞ্চলিকতাবাদের প্রশ্নে বিজেপির হিন্দুত্ব কার্ড চলছে না।
বিজেপি কখন হারে? যখন সেই রাজ্যের ৭০/৮০% হিন্দু ভোটের ৫৫/৬০% কি তার বেশি তারা পায়, কিন্তু যে রাজ্যে আঞ্চলিক দল ক্ষমতায়, সেখানে বিজেপির এই খেলা চলে না। কাজেই ২০২৪ ডন ডিল, খেলা শেষ, একথা বলার সময় এখনও আসেনি। নির্বাচন দুভাবে জেতা বা হারা যায়, প্রথমটা হল ভোট সুইং, মানে দলের প্রচারে মানুষের বিরাট অংশকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসা, সে প্রচার হিন্দুত্বের হতে পারে, মূল্যবৃদ্ধি বা বেরোজগারিরও হতেই পারে, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের হতে পারে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও হতেই পারে। অন্য ফ্যাক্টর হল, আই ও ইউ, ইনডেক্স অফ অপোজিশন ইউনিটি, বিরোধীরা যত বেশি ফ্রাগমেন্টেড থাকবে, যত বেশী অনৈক্য থাকবে বিরোধী দলের ভেতর, তত বেশি জয়ের সম্ভাবনা বাড়বে।
ভাবুন না, এই বাংলায় গত বিধানসভা নির্বাচনে যদি বাম কং জোট কোনও ভাবে ২০% ভোট পেতো? তাহলে বিজেপি এখানে ২১০ এর বেশি আসন জিতে সরকার তৈরি করত। বিজেপি অনেকটা ভোট সুইং করাতে পেরেছিল, কিন্তু ইনডেক্স অফ অপোজিশন ইউনিটি তাদের হারিয়ে দিয়েছে, কারণ এ বাংলায় তাদের অপোজিশন, তাদের বিরোধী বলতে তো ছিল কেবল তৃণমূল। গোয়া বা উত্তরপ্রদেশ, বিজেপি জিতেছে ওই ইনডেক্স অফ অপোজিশন ইউনিটির কারণেই, একশ শতাংশ অ্যান্টি ইনকম্বান্সি ভোট ভাগ হয়েছে, ভাগ করানো হয়েছে, বিজেপির সফলতা সেই কারণেই, বিরোধীরা কবে বুঝবেন?
এবং গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি, হ্যাঁ কংগ্রেসের কথা বলছি, তারা কি শেষ? তারা কি উঠে দাঁড়াতে পারবে? কংগ্রেস নিয়ে আলোচনায় থাকবো কাল, সঙ্গে থাকুন।