পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন। উত্তর প্রদেশ, পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, গোয়া, মণিপুর। পলিটিক্যাল পন্ডিত, সাংবাদিক কেবল নয়, সাধারণ মানুষও তাকিয়ে আছে এই নির্বাচনের দিকে৷ প্রতিদিন নতুন নতুন ব্রেকিং নিউজ৷ প্রতিদিন ছবি বদলাচ্ছে৷ প্রতিদিন নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এটা হল মিনি সাধারণ নির্বাচন৷ এই নির্বাচনগুলোর ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে, ২০২৪ এর সাধারণ নির্বাচন৷ নির্ভর করছে ভারতবর্ষের আগামী রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। আসুন সেটা নিয়েই আজ আলোচনা করা যাক৷ বুঝে নেওয়া যাক সম্ভাবনাগুলো।
ঠিক এখন কে কোথায় ক্ষমতায় আছেন? ইউপি-তে বিজেপির শাসন৷ বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে, ৪০৩ জনের বিধানসভায় দলবদলের পরে, সহযোগী দলগুলোকে নিয়ে বিজেপি ৩১৫ র ওপরে৷ সমাজবাদী পার্টি, সপা ৪৭ জন বিধায়ক নিয়ে ডিসট্যান্ট সেকেন্ড। উত্তরাখণ্ডে বিজেপি ক্ষমতায়৷ পঞ্জাবে কংগ্রেস, গোয়াতে বিজেপি, মণিপুরে বিজেপি জোট। মানে যে পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন, তার ৪টেতেই বিজেপি ক্ষমতায়৷ একটাতে কংগ্রেস।
বিজেপি পঞ্জাবে কোনওভাবে ক্ষমতায় আসতে পারে, এরকম সম্ভাবনা নেই৷ বিজেপি জানে, সব্বাই জানে সে কথা। ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকে নিয়ে নির্বাচনে নামলেও, বিজেপি পঞ্জাবে কল্কে পাবে না৷ তার প্রথম কারণ পঞ্জাবে বিজেপির হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানের স্লোগান অর্থহীন৷ এ স্লোগান পঞ্জাবে কোনও প্রভাব তো ফেলেই না৷ বরং এর উলটো প্রভাব আছে৷ শিখরা হিন্দুদের থেকে আলাদা, পঞ্জাবের ভাষা নিয়ে পঞ্জাবীরা যথেষ্ট গর্বিত৷ রাজ্যের ৭৬% মানুষ আমিষ ভোজী, রামমন্দির নিয়ে কারোর কোনও মাথা ব্যাথা নেই৷ রাজ্যে ৩% এর কম মুসলমান জনসংখ্যা৷ হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের কোনও প্রশ্নই নেই৷ আগে অকালি দলের সঙ্গে জোট করে যেটুকু জায়গা পেয়েছিল, তা অকালি দলের সঙ্গে জোট ভেঙে যাবার পর চলে গিয়েছে।
তাহলে? কংগ্রেস আবার ফিরে আসছে৷ তারা হারলে আপ ক্ষমতায় আসবে৷ তেমন একটা ক্ষীণ সম্ভাবনাও আছে। অতএব এই চার রাজ্য থেকে পঞ্জাব বাদ৷ পঞ্জাবে বিজেপি বিরোধী দলেরাই ক্ষমতায় আসবে। তবুও যদি কোনওভাবে আপ আসে, তাহলে বিজেপি খুশি হবে৷ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষের হার তাদের কাছে ভাল খবর বৈকি। বাকি রইল চার বিজেপি শাসিত রাজ্য৷ যেখানে মণিপুরে বিজেপি আর তার সহযোগীরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত দারুণ অবস্থায় ছিল৷ কিন্তু নাগাল্যান্ডে সৈন্যবাহিনীর গুলিতে নিহত নাগরিক, আফস্পা, বিশেষ সামরিক আইন বাতিল ইত্যাদি নিয়ে জনরোষ এক অন্য ইকুয়েশন তৈরি করছে৷ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, মণিপুর আবার তাকিয়ে থাকবে নির্বাচন পরবর্তী বোঝাপড়ার ওপর? হ্যাঁ তেমনটা সম্ভব৷ যদিও অ্যাডভানটেজ অবশ্যই বিজেপির।
চলুন গোয়া। এমনিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়৷ ভোটের পরে দল ভাঙিয়েই তৈরি হয়েছিল গোয়ার সরকার, এবং মনোহর পারিক্কর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বেশ কিছু কাজ হয়েছে, যার ফলে বিজেপি পেয়েছে পায়ের তলায় জমি৷ পারিক্কর বেঁচে থাকলে বলাই যেত, বিজেপি আসছে৷ কিন্তু পারিক্করের না থাকা গোয়ার রাজনীতিকে বদলে দিয়েছে৷ তার ওপর গোয়ার খ্রিস্টান পপুলেশন, বিজেপির নেতা কর্মীদের চার্চ ভাঙা, খ্রিস্টমাস ডে-তে হামলা চালানো, ধর্মান্তরণ নিয়ে জঙ্গিপনা ইত্যাদির কারণে ক্ষুব্ধ, এবং গোয়াতে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু মেরুকরণে বিজেপির ক্ষতি৷ সব মিলিয়ে বিজেপি গোয়াতে ব্যাকফুটে। কিন্তু তাদের ভরসা, বেশ কিছু আসনে বিরোধী ভোটের ভাগাভাগি। সেখানে আপ লড়ছে, কংগ্রেস লড়ছে, তৃণমূলও ভোট পাবে। বিরোধী তিন শিবিরে ভোট ভাগাভাগি, গোয়াতে বিজেপির সুবিধে করে দেবে একথা বলা বাহুল্য৷ শেষ পর্যন্ত যদি বিরোধী জোট হয়, তাহলে কিন্তু বিজেপির কপালে দুঃখ আছে৷ কিন্তু সেই জোট হবে কি হবে না, হলে তার চেহারা কেমন হবে, তার জন্য অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।
রইল বাকি দুই, উত্তরাখণ্ড আর ইউপি। চলুন উত্তরাখণ্ডে, সেখানে বিজেপির ভেতরের লড়াই কংগ্রেসকে সুবিধে দিচ্ছে৷ তিন তিন বার মুখ্যমন্ত্রীর চেহারা বদলে সেই ইন ফাইটিং কমে তো নি, বরং বেড়েছে। বিজেপি থেকে কিছু নেতা কংগ্রেসে এসেছেন, এবং কিছুদিন আগেও পঞ্জাব দেখছিলেন হরিশ রাওয়ত, আপাতত নিজের জায়গায় ফিরেছেন৷ তিনিই উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেসের নেতৃত্বে, সভায় ভালো ভিড় হচ্ছে, কংগ্রেস সেখানে ভালো লড়াই দিচ্ছে৷ সেখানেও আপ আছে৷ যদিও লড়াই কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে, আপ যদি বিরাট ভোট না কাটে, তাহলে অবশ্যই উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেস বিজেপি, কাঁটে কা টক্কর, সমানে সমানে লড়াই।
বাকি রইল ইউ পি৷ মাস ছয়েক কি দশেক আগে মনে হচ্ছিল মাঠে কেউই নেই৷ অখিলেশ যাদবকে রাস্তায় দেখা যাচ্ছিল না৷ মায়াবতী তো ঘরেই বসে আছেন৷ কেবল যোগীজী মাঠে। বিজেপি নেতৃত্ব কিন্তু খারাপ গন্ধ পেয়েছিলেন বেশ কিছুদিন আগেই৷ বিধায়কদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ, ব্রাহ্মণদের ক্ষোভ, ব্যাকওয়ার্ড কাস্টের নেতাদের ক্ষোভের খবর তাদের কাছে ছিল৷ সেই অনুযায়ী যোগীর ডানা ছাঁটার জন্য মোদি ঘনিষ্ট অরবিন্দ কুমার শর্মাকে আনা হল৷ কেবল মোদিজীর সংসদীয় এলাকা বেনারসই নয়, পূর্বাঞ্চলের ২১ টা জেলার দেখরেখ করতে বলা হল, মোদিজীকে সরাসরি রিপোর্ট করতে বলা হল, কেন? কারণ আকাশের গায়ে ছিল টক টক গন্ধ, অ্যাট লিস্ট মোদিজী অমিত শাহের কাছে খবর ছিল, ২০২১ এর জানুয়ারিতে শর্মা কে ইউ পি এম এল সি তে জিতিয়ে আনাও হল, ধরে নেওয়া হচ্ছিল, আরেকজন উপমুখ্যমন্ত্রীত্ব পেলেন বলে৷
কিন্তু যোগিজী রুখে দাঁড়ালেন, হিন্দুত্বের এই পোস্টার বয় বুঝেছিলেন এসব তেনার ডানা ছাঁটার অঙ্গ৷ যোগিজীকে না ঘাঁটিয়ে শর্মাকে সাইডলাইনেই বসিয়ে রাখা হল৷ তখনও ইউপি তে যোগিজীই নির্বাচন সামলাবেন সেটা ছিল পরিষ্কার৷ কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল, যোগিজীও বুঝলেন, বৈতরিনী পার হতে গেলে সেই মোদিজীই ভরসা৷ কিন্তু নির্বাচনের মুখে যোগীকে সরানো অসম্ভব৷ তাই একটা বোঝাপড়া হল বটে, কিন্তু তা ওপরে ওপরে৷ সমস্যা থেকেই গিয়েছে৷ বোঝা গেল তিন মন্ত্রী সমেত একগুচ্ছ ব্যাকওয়ার্ড কাস্টের বিধায়ক বেরিয়ে যাবার পরে৷ এখন পুরো রাশ সেই আবার মোদী – শাহের হাতে৷ সবমিলিয়ে জোড়াতাপ্পি দিয়ে বিজেপি ভোটে নামছে৷
অন্যদিকে অখিলেশ দুটো কাজ করতে পেরেছেন৷ এক, লড়াইটা রামমন্দির, হিন্দু বনাম মুসলিম থেকে নিয়ে এসেছেন অগয়াড়ি বনাম পিছাড়িতে, ব্যাকওয়ার্ড ভারসেস ফরোয়ার্ডে, স্বামী প্রসাদ মৌর্য, দারা সিং চৌহান বা সাইনিকে নিয়ে এসে একটা পারসেপসন অন্তত তৈরি করতে পেরেছেন। দুই, লড়াইটাকে সপা আর বিজেপির মধ্যেও নিয়ে আসতে পেরেছেন৷ বাকিরা গুনতির মধ্যেও নেই৷ আপকে তো দেখাই যাচ্ছে না৷ কংগ্রেস কয়েকটা পকেটেই আছে৷ মেরুকরণ যত হবে, তত বিরোধী ভোট জমা হবে অখিলেশের খাতায়৷ তাও এখনও অ্যাডভানটেজ অখিলেশ বলার সময় আসেনি৷ যদিও লড়াই কিন্তু জমে গিয়েছে।
তাহলে সাকুল্যে দাঁড়ালোটা কি? বিরোধীদের ফলাফল যদি খুব ভাল হয় তাহলে ৫-এ ৪৷ মাঝারি হলে ৫-এ ২৷ খুব খারাপ হলেও যা ছিল তাই, ৫-এ ১। কিন্তু বিষয়টা এখানেই থেমে নেই৷ একটা ছবি তো পরিষ্কার, যে বিজেপি ইউপি-তে জিতলেও ৩১০/১৫ তো দুরস্থান, কেঁদে ককিয়ে ২০১/১৫/২০ র বেশি নয়৷ উত্তরাখণ্ড বা গোয়াতেও তাই। সেক্ষেত্রে বিজেপির সবচেয়ে বড় বিপদ তারপরেই, কারণ ইউপির নির্বাচন শেষ হলেই বাজবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘন্টা৷ ইউপির বিধায়ক সংখ্যা কমে যাওয়া মানে সেখানে আবার কাঁটে কা টক্কর, এবং নিশ্চিতভাবেই এবার সামনে শারদ পাওয়ার, যিনি বিরোধী ভোট জড়ো করতে নেমেছেন এখন থেকেই৷ জগন রেড্ডি থেকে তেলেঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও, স্তালিন, মমতা তো আছেনই। দ্বিতীয় বিপদ হল আবার বিজেপিকে শরিকদের ওপর নির্ভর করতে হবে৷ সেখানেও দরাদরি, দাম দস্তুর শুরু হয়ে গিয়েছে৷ তৃতীয় বিপদ রাজ্যসভায় আবার পিছিয়ে পড়া৷ মানে বিল আনব আর পাস হয়ে যাবে, সেটা আর হবে না। সবমিলিয়ে দেশের আচ্ছে দিন আসেনি তো বটেই, বিজেপিরও আচ্ছে দিন শেষ হয়েছে, তাকে আবার নতুনতর কোনও সমীকরণে যেতেই হবে।
আর যদি ইউপি হাত থেকে চলে যায়, উত্তরাখণ্ড, গোয়ার মধ্যে কোনও একটা, তাহলে মোদী সরকার লেম ডাক গভর্নমেন্ট, কেবল সময়ের দিন গুনতে হবে মোদিজীকে। অন্যদিকে ইউপি-তে বিরাট জয়, বাকি রাজ্যগুলো হাতে রাখতে পারলে বিজেপি হয়ে উঠবে অপরাজেয় শক্তি, বিরোধী শিবির ভেঙে ছত্রখান হয়ে যাবে। তাই এই ৫ রাজ্যের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ এক মিনি সাধারণ নির্বাচন৷ যা ভারতবর্ষের আগামী রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, দেশ এক বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে। দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সেকুলার সংবিধান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভাগ্য নির্ধারিত হবে এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে।