শনিবার বেলা দশটার পরে,
জর্জকোর্টে তে লোক না ধরে মা গো,
হলো, অভিরামের দ্বীপচালান মা
খুদিরামের ফাঁসি,
একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি।
মুখে মুখে ফিরেছে এই গান, ক্ষুদিরাম কিংসফোর্ডকে মারতে পারেননি, কিন্তু এক আত্মত্যাগের ইতিহাস তৈরি করে গিয়েছেন। স্বাধীনতার পরে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের কথা মনে রেখেই অনেক গান লেখা হয়েছে, মুক্তির মন্দির সোপানতলে, লিখেছিলেন মোহিনী চৌধুরি, বিখ্যাত গান অ্যায় মেরে বতন কে লোগোঁ জরা আঁখো মে ভর লো পানি, জো শহীদ হুয়ে হ্যাঁয় উনকি জরা ইয়াদ করো কুরবানি, জয়হিন্দ৷ এর সঙ্গেই আবার লতা মঙ্গেশকরের গলা, নেহরুর চোখে জল এসেছিল, আমরা জানি। স্বাধীনতার আগেই মালাবার উপকূলের কৃষক সভার কায়ুর ভাইদের ফাঁসি, বিনয় রায় লিখেছিলেন, “ফিরাইয়া দে দে দে মোদের কায়ুর বন্ধুদেরে, পরাধীন ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের চারজন শহীদ, যারা ফাঁসির দড়ি গলায় নিল। গান লেখা হল মালয়ালম ভাষায়, বাংলাতেও। ‘
ফিরাইয়া দে, দে, দে মোদের কায়ুর বন্ধুদেরে
মালাবারের কৃষক সন্তান
তারা কৃষক সভার ছিল প্রাণ
অমর হইয়া রহিবে দেশের দশের অন্তরে।
কৃষকসভার রাখতে ইজ্জতমান
তাঁরা ফাঁসি কাষ্ঠে দিল প্রাণ
ফিরিয়া পাব নারে মোদের কায়ুর বন্ধুদেরে।’
দেশ স্বাধীন হল, বাংলায় তেভাগা আন্দোলন শহীদ হলেন মা অহল্যা, পেটে তার সন্তান, স্বাধীন ভারতবর্ষের উলিশের গুলিতে শহীদ কৃষক রমণী, সলিল চৌধুরির আগুনের বর্ণমালা আজও মনে আছে।
সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল
হয়েছিলো
সেদিন আকাশে জলভরা মেঘ
বৃষ্টির বেদনাকে বুকে চেপে ধরে থমকে দাঁড়িয়েছিলো
এই পৃথিবীর আলো বাতাসের অধিকার পেয়ে,
পায়নি যে শিশু জন্মের ছাড়পত্র,
তারই দাবী নিয়ে সেদিন রাত্রে,
সারা কাকদ্বীপে, কোনও গাছে কোন কুঁড়িরা ফোটেনি
কোন অঙ্কুর মাথাও তোলেনি,
প্রজাপতি যতো, আরও একদিন
গুটিপোকা হয়েছিলো,
সেদিন রাত্রে, সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিলো
তাই, গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরী হও
কার ঘরে জ্বলেনি দীপ?
চির আঁধার তৈরী হও,
কার বাছার জোটেনি দুধ,
শুকনো মুখ তৈরী হও,
ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই, তৈরী হও, জোটবাঁধো
মাঠে কিষান, কলে মজুর, নওজোয়ান জোট বাঁধো
এই মিছিল সবহারার, সবপাওয়ার এই মিছিল
প্রতিভা আর যশোদা মার, রক্তবীজ এইমিছিল
স্বামীহারা অনাথিনীর চোখের জল, এই মিছিল
শিশুহারা মাতাপিতার, অভিশাপের এই মিছিল
এই মিছিল সবহারার সবপাওয়ার এই মিছিল, হও সামিল
আমর বুকে এলো যখন, কোটি প্রাণের স্বপ্ন
কোটি মনের বরফ জমা, অগাধ সম্ভাবনা
কোটি দেহের ঘৃণার জ্বালা, অগ্নিগিরি বুকে
কোটি শপথ পাথর জমা, গোনে শেষের লগ্ন
তবে আমার বজ্রনাদে শোন রে ঘোষনা,
কোটি দেহের সমষ্টি এই, আমিই হিমালয়
আমি তোদের আকাশ ছিঁড়ে, সূর্য পরি ভালে
তুচ্ছ করি কুজ্ঝ্বটিকা, মেঘের ভ্রুকুটিও
জানাই তোদের, কারা আছিস ঘৃণ্য পরগাছা?
কোটি বুকের কলজে ছিঁড়ে, রক্ত করিস পান?
বুকে শ্বাপদ, মুখে তোদের অহিংসা অছিলা?
এবার তবে করবি তো আয়, আমার মোকাবিলা
এরপর ১৯৫৯, তারপরে ১৯৬৬ র খাদ্য আন্দোলন, ৫৯ এ পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন রাঁধুনি হেমব্রম, ৬৬ তে অনেক শহীদের মধ্যে ছাত্র নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইত মারা গেলেন, পুলিশের বুলেটে। সে এক উত্তাল সময়, ধর্মঘট, অবরোধ, কলকাতার রাজপথে খাদ্য আন্দোলনের লড়াই, ৫৯ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছিলেন,গুলিবিদ্ধ গান যে আমার খুঁজে খুঁজে মরে, সান্ধ্য আইনের কুটিল অন্ধকারে, ক্ররীষ্ণনগর হতে যায় যে কোন্নগরে, ঘুরে আউলি হয়ে বসিরহাটে, ইছামতির তীরে, ৬৬ সালে গান লেখা হল শপথ করো শপথ করো দিল প্রাণ বলিদান, বাংলা মায়ের দামাল ছেলে নুরুল ইসলাম, অজিত পান্ডে গেয়েছিলেন, ও নুরুলের মা, সারাদিন চোখের জলে বাণ ডাকাইয়া জমিন ভিজাস না, কাইন্দা মরে হাজার নুরুল, ভুখের আগুন পেটে, আরে যে জমিন খুইড়াঁ তুলল সোনা, অন্ন না তার জোটে।
এক আন্দোলন শেষ হয়, অন্য আরেক আসে বাংলার বুকে৷ এল নকশালবাড়ি, ৬৭ সালে প্রসাদজোতে ৭ জন কৃষক রমণী, দুজন শিশু, একজন কৃষক পুলিশের গুলিতে মারা গেল৷ এক স্ফুলিঙ্গ, যা থেকে শুরু হল নকশালবাড়ির আন্দোলন৷ সেই সময় গান লেখা হল, তরাই কান্দে গো, গাইলেন অজিত পান্ডে। তরাই কান্দে গো, জ্বলছে আমার হিয়া, নকশালবাড়ির মাঠ জ্বলে সপ্তকন্যার লাগিয়া। সেই নকশালবাড়ির আঁচ কমে এল, জরুরি অবস্থা জারী হল, ৭৭ এ আবার নির্বাচন, এল বামফ্রন্ট সরকার। ৪৭ থেকে ১৯৭৫, ২৮ বছরে অজস্র গণআন্দোলন হয়েছে, মূলত বামপন্থীরাই সেই সব গণআন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, মারাও গিয়েছেন তাঁরা, ৪৭ এর আগে জেলে গিয়েছেন, গুলি খেয়েছেন, ফাঁসি কাঠে প্রাণ দিয়েছেন অজস্র মানুষ৷ বিরাট অংশ ছিলেন বাংলার বিপ্লবীরা, অবশ্যই কংগ্রেস নেতা ও কর্মীরা। কিন্তু ৭৭ সালের পর থেকে সেই রাজনৈতিক আন্দোলনে ভাটা, দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের নেতৃত্ব জানেনই না কিভাবে ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়, ছিটফুট রাস্তায় নামা, নিয়ম মাফিক আইন অমান্য আন্দোলন করতে থাকলেন। বন্ধ বা ধর্মঘটের কথা বলবেন না, কারণ তার ক্রেডিট বাম দলের, তাঁরা সরকারে ছিলেন কিন্তু কেন্দ্রের বঞ্চনা ইত্যাদির বিরুদ্ধে বছরে ৪/৫ টা বনধ তাঁরাই ডাকতেন৷ সেটাও ছিল নিয়ম মাফিক৷ কাজেই রাজনৈতিক ঝাঁঝহীন সময় বয়েছে বহুদিন৷
কিছুটা ক্রেডিট তো বাম দলগুলোর, বা বলা ভাল সিপিএমের, তাদের এক ওমনিপোটেন্ট উপস্থিতি ছিল দেখার মতন, সর্বত্র তাঁরা আছেন, রিকশা মালিক ইউনিয়ন, রিকশা চালক ইউনিয়ন, রিকশা যাত্রী ইউনিয়নের সবকটাই তাদের দখলে, অতএব রিকশা মালিক দাম বাড়ালে, সেটা ছিল প্রগতিশীল মূল্যবৃদ্ধি। রিকশা যাত্রী হেনস্থা হলে, সেটা ছিল ভুল বোঝাবুঝির ফল, রিকশা চালকের মজুরি না বাড়ানো হলে, যুক্তি আসত বাম সরকারকে চোখের মণির মত রক্ষা করতে হবে। বামেরা দিব্য ম্যানেজ করেছিল কংগ্রেসকে, বাংলার কিছু নেতা, দিল্লির কিছু নেতা তো আলিমুদ্দিনের নির্দেশে কাজ করতেন৷ দুধু ও মধুর ভাগও পেতেন। দিব্য চলছিল, এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে সবটা ঘেঁটে দিলেন, ভদ্রমহিলা রাজনীতির সূক্ষ্ম মার প্যাঁচ বোঝেন না, দুম দাম বলে ফেলেন, হুট বলতে ঝুট রাস্তায়, আলিমুদ্দিন বুঝেছিল, হার্ড নাট টু ক্রাক। গীতা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, মেয়েটির তো কমিউনিস্ট পার্টিতে থাকার কথা। ঝালে ঝোলে অম্বলে, ধর্ম এবং জিরাফ নিয়ে থাকা কংগ্রেসের ঘুঘু নেতৃত্ব চোখের সামনে দেখল, কংগ্রেসের র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল ভেঙে নতুন দল তৈরি হয়ে গিয়েছে, নতুন নির্বাচনী চিহ্ন দেখে সোমেন মিত্র বলেছিলেন, বাপের জন্মে এরকম নির্বাচনী প্রতীকের কথা ভাবিনি তখন জানতেন কি? ক’বছর পরে সেই দলের টিকিট নিয়ে সংসদে যেতে হবে? নিশ্চই জানতেন না।
মমতার ওই জঙ্গি, আপোষহীন রাজনীতি তাঁকে অনেক উপাধিও এনে দিল৷ বেদের মেয়ে জোৎস্না, বাংলার অগ্নিকন্যা, পটুয়াপাড়ার অগ্নিকন্যা, হাওয়াই চটি ফটরফটর, এরকম কত৷ কিন্তু এই মহিলাই বাংলার আন্দোলনহীন নিস্তরঙ্গ জীবনে আন্দোলন ফিরিয়ে আনলেন, আনলেন বললে ভুল হবে, এখানে বসে পড়ছেন, সেখানে চলে যাচ্ছেন আইবির লোকজনদের কাছে শুনেছি, কেবল ওনার গতিবিধিতে নজর রাখার জন্য একটা টিম করা হয়েছিল। ওনার বাঁ হাত, ডান হাতদের কাছ থেকে আগাম খবর নেবার ব্যবস্থা করেও লাভ হয়নি, কারণ বাঁ হাত আর ডান হাত বদলে গিয়েছে ক্ষণে ক্ষণে৷ সেটাও বোধ হয় ছিল স্ট্রাটেজির অঙ্গ৷ কাজেই উনি কার স্কুটারে চেপে কোথায় হাজির হচ্ছেন, কোন রাস্তায় অবরোধে বসছেন, কখন মহাকরণে হাজির হচ্ছেন, এসব খবর আগাম না জানানোর দায় নিতে হয়েছে আইবি আফিসারদের৷
মমতাই আবার বাংলার রাজনীতিতে সেই অর্থে আন্দোলন, ধর্মঘট, অবরোধ ফিরিয়ে আনলেন। সেই পর্যায়ের, প্রথম বড় আন্দোলনের ইস্যু ছিল ভোটার কার্ড, নো ভোটার কার্ড, নো ভোট। শেসন সাহেব ভোটার কার্ডের কথা বলেছেন, জ্যোতিবাবু বলেছেন মেগালোম্যানিয়াক, কমরেড্রা রাস্তা মিটিং এ বলেছেন, কৃষক এই কার্ড রাখবে কোথায়? যার ঘরের চাল খড়ের, দেওয়াল মাটির, ফি বছর বন্যায় ধুয়ে যায়, সে ভোটার কার্ড রাখবে কোথায়? কেন কৃষকের ঘর ভাসবে ফি বছর, তার উত্তর অবশ্য ছিল না, সে কথা থাক, মমতা স্লোগান দিলেন নো কার্ড, নো ভোট, এই মূল দাবিকে মাথায় রেখে ২১ জুলাই, মহাকরণের আশেপাশে জমায়েত, আলিমুদ্দিন বলল, জ্যোতিবাবু বললেন, উনি মহাকরণ দখল নিতে আসছেন, তারপরের ইতিহাস সবার জানা৷ ১৯৯৩ এর ২১ জুলাই পুলিশের গুলিতে কলকাতার রাজপথে মারা গেলেন ১৩ জন বিক্ষোভকারী৷ একজন পথচারী, বেশিরভাগ গুলি লেগেছিল মৃতদের দেহের উর্ধাঙ্গে৷ মমতা নিজেও গুরুতর আহত হলেন, হাসপাতালে গেলেন৷ এরপর থেকে তিনিই ছিলেন বাংলার বামফ্রন্ট বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু৷
এই আন্দোলনের পথ বেয়েই সিঙ্গুরের আন্দোলন, নন্দীগ্রামের আন্দোলন, এবং বামফ্রন্টের পতন। ২১ জুলাই তাই কেবল এক দলের নয়, বাংলার রাজনীতিতে বহমান আন্দোলনের এক মাইলস্টোন যা ভোলা যাবে না, আজ সেই ২১ জুলাই। কিন্তু একটা আক্ষেপ থেকে গিয়েছে, বলেই ফেলি, কবীর সুমনের মত, নচিকেতার মত তৃণমূল ঘনিষ্ঠ লেখক গায়ক, কবি সুবোধ সরকার, সৃজাতর কলম থাকা সত্ত্বেও, ২১ জুলাই নিয়ে তেমন কোনও গান, কবিতা নেই, গান, কবিতা লেখাও হয়নি। হোক গান হয়ে উঠুক কবিতা, ২১ জুলাই নিয়ে একটা গান হোক, এক কবিতা জন্ম নিক, বাংলার ইতিহাস মনে রাখার জন্য এটুকু দাবি তো স্বাভাবিক।