২০১৪ থেকেই বিজেপি নির্বাচন মাহোল, মানে নির্বাচন প্রচার৷ বিষয়, ব়্যালির চেহারা, ইস্যু সবটাই বদলে দিয়েছে। এমন কিছু জিনিস যোগ করেছে, যা এর আগে ভারতীয় রাজনীতিতে দেখা যায়নি৷ বিজেপির রাজনীতিতে তো ছিলই না৷ অন্তত নির্বাচনকে এই ধরা গতের বাইরে এনে ফেলার ১০০% কৃতিত্ব মোদি – অমিত শাহের। দুই মোটা ভাই মিলে ভারতীয় নির্বাচনের এক অন্য জমানা এনে দিয়েছেন, আসুন সেই অন্য জমানাটাকে একটু বিশ্লেষণ করা যাক, জানেন না এমন নয়, তবুও আলোচনা হোক।
নির্বাচন আসছে, কী করে বুঝবেন? আগে, মানে যে কোনও জমানায়, কং, তৃণমূল, ডিএমকে, টিডিপি এমন কি বিজেপি শাসিত রাজ্যেও, ২০১৪ র আগে, নির্বাচন আসার আগেই বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন শুরু হত, পাথরের পর পাথর, শিলাবৃষ্টি বললেও কম বলা হয়, তার কিছু রূপায়িত হত, কিছু পড়ে থাকত শিলালিপি হিসেবে থেকে যেত, বিচ্ছু ছেলেরা ওই শিলালিপির গায়ে অমুক প্লাস তমুক লিখত, যোগাড়ে লোকজন নিয়ে গিয়ে উনুন বানিয়েছেন, এও দেখেছি। জণগনের জন্য উৎসর্গিকৃত প্রকল্পের ওপর দাউ দাউ জ্বলা আগুন, ওপরে ভাত সেদ্ধ হচ্ছে। এসব আম জনতার জানা, তার আকর্ষণ ও কমে আসছিল, ভোটের আগে গুচ্ছ প্রকল্পের ঘোষণা শিলান্যাস মানুষের মনে এখন আর দাগ কাটে না, ও তো হয়, ওহ তো হোতাই হ্যায়, এরকম আর কি।
নতুন ফরমুলায় ২০১৪র পরে যে রাজ্যে নির্বাচন এসেছে, বা ২০১৯ এর সাধারণ নির্বাচনের আগে ওসব উদ্বোধনের ঢের আগে বেরিয়েছে সিবি আই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, ভিজিলেন্স অথরিটির দল, নিয়ম করে, এক্কেবারে নিয়ম করে। এর আগে কি সি বি আই দিয়ে ভয় দেখানো হয় নি? হয়েছে। কিন্তু ঠিক ভোটের আগে নিয়ম করে এই ভয় দেখানো, এটা মোদি-শাহের অবদান, আইনস্টাইন-বোস ফরমুলার মত মোদি-শাহ ফরমুলা, এবং বেশ কার্যকরী। কিভাবে কাজ করে?
ইনকাম ট্যাক্স বা ইডি পাঠিয়ে দেওয়া হল সেই ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির ঘরে, যিনি বিরোধী দলকে টাকা যোগাচ্ছেন, পরিষ্কার জানানো হল, সাপ্লাই বন্ধ করো না হলে…… না হলে জেল হাজত, যা খুশি তাই। এরপর ইডি ইনকাম ট্যাক্স চলে গেল অবাধ্য নিউজ মিডিয়ার দফতরে, সামলে যা ভাই কপালে দুঃখ আছে, ফ্রন্ট পেজ তো মোটাভাইদের জন্য, তাদের ছবি ছাপাও। এরপর সিবি আই চলে গ্যালো, একটু নড়বড়ে বিরোধী দলের নেতাদের বাড়িতে, মানে মোদি-শাহের খোলা আমন্ত্রণ, আয় ভাই চলে আয়, তারপর রফা হবেখন। সিবি আই এখন সেই রানার রানার চলেছে রানার, পিঠেতে ভারি বোঝা, কিন্তু কেবল খবর দিলেই কাজ শেষ নয়, খবরটা ভাল করে বোঝাতেও হবে তো। উদাহরণ? দিচ্ছি।
২০১৮ অক্টোবর, তেলেগু দেশম দলের সাংসদ সি এম রমেশের ঘরে গ্যালো আই টি কর্তারা, হাতে নাতে ফল, জুন ২০১৯ তিনি বিজেপিতে যোগ দিলেন। ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, ৫২ টা জায়গায় একসঙ্গে পৌঁছে গ্যালো ইনকাম ট্যাক্স, কংগ্রেস নেতা কমলনাথের পরিচিতদের বাড়িতে বাড়িতে। ২০১৯, মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটের আগে, ইডি শারদ পাওয়ার আর তাঁর বোনপো অজিত পাওয়ারের ওপরে মামলা দায়ের করল, নির্বাচনের পরেই অজিত পাওয়ারকে নিয়ে সরকার বানানোর চেষ্টা করল, তখন তাঁর ওপর থেকে মামলা তুলে নেওয়া হল, যদিও শেষ রক্ষা হয় নি। ২০২০, কর্ণাটক বিধানসভার নির্বাচনের আগে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, ডি কে শিভকুমার আর তাঁর ভাই ডি কে সুরেশের ঘরে গ্যালো সি বি আই, বিরাট অভিযোগ নিয়ে, ভোট শেষ, সেই অভিযোগ নিয়ে আর একটা উচ্চবাচ্যও হয়নি। ২০২১ এ তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচন, আই টি তৎপর হয়ে উঠল, তল্লাসি চালালো ডি এম কে নেতা স্তালিনের আত্মীয় স্বজনের বাড়ি, এক্ষেত্রেও শেষ রক্ষা হয় নি। সে ২০২১ এই আমাদের বাংলার নির্বাচনের আগে সি বি আই মাঠে নামলো, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীর নামে বিরাট অভিযোগ, সে সব নাটক আমরা দেখেছি, বাংলার নির্বাচনের ফলাফলও সব্বার জানা আছে।
এবার উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন৷ লখনউতে অখিলেশ যাদবের পরিচিত ব্যবসায়ীর বাড়িতে ইনকাম ট্যাক্স রেইড হল৷ একসঙ্গে রঘু ডাকাতের মতো হামলা। এই নির্লজ্জ প্রশাসনিক হুমকি, আর ভয় দেখানোর কায়দা হল মোদি-শাহ ফরমুলা নম্বর ওয়ান। প্রথমে দারুণ কাজ হচ্ছিল৷ ইদানিং ব্যাক ফায়ার শুরু হয়েছে৷ মানুষ বুঝে গেছে এসব নিছকই হুমকি।
এবার আসুন প্রচারে৷ সেখানেও মোদি-শাহের অন্য ফরমুলা আছে। ৫২ থেকে নির্বাচনে শাসক দলের ইস্যু দেখুন, পালটে গিয়েছে বহুবার৷ কিন্তু নির্বাচনের আগে যে ইস্যু নিয়ে শাসক দল মাঠে নেমেছে, সেটাই শেষ পর্যন্ত তুলে ধরা হত৷ ইন্দিরা গান্ধীর গরিবি হটাও, এমন কী অটল বিহারি বাজপেয়ীর ইন্ডিয়া শাইনিং স্লোগান ছিল ভোটের আগে, ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত। হারা জেতা অন্য কথা৷ ভোটও ওই স্লোগানের ওপরেই হয়েছে। মোদি-শাহ ফরমুলার টু-র ম্যাজিকটা অন্যরকম। ২০১৪-র পর থেকে প্রতিটা ভোটে তাঁরা বিকাশ দিয়ে শুরু করেন৷ বিকাশ এসেছে, বিকাশ হচ্ছে, বিকাশ হবে। বিরাট জয়ঢাক বাজানো শুরু হয়৷ এদিকে সে বিকাশ তো গেছে ছাগল চরাতে৷ মাটিতে চামড়ার চোখে তো সেই বিকাশকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ যখন মানুষ বা বিরোধী নেতারা ঠিক এই প্রশ্নটা তুলতে শুরু করবেন, ঠিক সেই সময়ে মোদি-অমিত শাহ ফরমুলার দ্বিতীয় ভাগ- গোটা প্রচারটা সরে যাবে তীব্র হিন্দুত্ববাদকে কেন্দ্র করে। রাম মন্দির, অযোধ্যা, রামলালা, কাশী, বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, মথুরা, আওরঙ্গজেব, শিবাজী হয়ে উঠবে নির্বাচনের ইস্যু। গলা জলে ডুব দিয়ে, কপালে চন্দন মেখে, হর হর মহাদেও, শিবলিঙ্গে জল আর দুধ ঢেলে, মন্ত্র পড়ে বিরাসত কি কহানি বলতে শুরু করবেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, বিজেপির তাবড় তাবড় নেতারা।
মুসলমানরা সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে, লাভ জেহাদ, ওরা গরু খায়, ওরা দেশদ্রোহী ইত্যাদিতে শেষ হয়, ২০১৪ তে শ্লোগান ছিল সব কা সাথ, সবকা বিকাশ, রামমন্দিরের কথা শোনা যায়নি, নারী সুরক্ষার কথা ছিল, মথুরার কথা তো শোনা যায়নি। কিন্তু ওই ২০১৪-র পর থেকে মোদি-শাহের ফরমুলা মেনেই প্রত্যেকটা নির্বাচনে প্রচার শুরু হয়েছে বিকাশ দিয়ে৷ কিছুদিনের মধ্যেই সেই বিকাশের কথা বন্ধ হয়ে এসে যাবে তীব্র হিন্দুত্ববাদের প্রচার। এটা কেন? কারণ ওই প্রথম ১০/১৫ দিনে বিকাশের কথা বলো৷ মিথ্যে দাবি, মিথ্যে ছবি, বিকাশের মিথ্যে ফিরিস্তি ছড়াও৷ ঠিক যখন বিরোধীরা সে সবের জবাব দিতে বসবে, তখন গোলপোস্ট বদলে দাও৷ উত্তর দক্ষিণের গোলপোস্ট তখন পূর্ব পশ্চিমের, বিরাসত, হিন্দুত্ব নিয়ে সে এক তীব্র প্রচার।
অতঃপর বিরোধীরা হালকা হিন্দুত্ব নিয়ে মাঠে নামবেন, রাহুল গান্ধী জনেয়ু মানে পৈতে দেখাবেন, বিরোধী নেতাদের কেউ কেউ গঙ্গাতে নামবেন কিন্তু হিন্দুত্বের ওই লড়াইয়ে বিজেপির কাছে সে সব বালখিল্য ব্যাপার, বিজেপি এই খেলাতে এগিয়ে থাকবে এক ডজন গোল দিয়ে, হ্যাঁ এটাই স্ট্রাটেজি, প্রথমে কার্যকরী ছিল৷ এখন আর কার্যকরী নয়৷ কাজ করছে না৷ রোজ গঙ্গাস্নান করা মানুষ, প্রতিদিন শিবের মাথায় জলঢালা মানুষকেও তো বাজারে যেতে হয়৷ তাদের ঘরে বেকার ছেলেপুলে আছে, তাঁরা শিব পুজো করেন বটে কিন্তু গাঁজা খেয়ে তো বসে নেই, তাঁরাও স্বপ্ন দেখেছিলেন আচ্ছে দিনের, চাকরির, মূল্যহ্রাসের না হলেও মূল্যবৃদ্ধির তো দেখেননি, চাকরির মাইনে বাড়ার না হোক, মাইনে কমে যাওয়ার স্বপ্ন তো দেখেননি৷ এখন সেই বাস্তব তাঁদের সামনে।
এরপর তিন নম্বর ফরমুলা৷ নিউটনের তিনটে গতি সূত্রের মতন৷ মোদি-শাহের তিনটে ফর্মুলা কাজ করে। প্রথম হল সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি বাহিনীকে পাঠানো৷ দ্বিতীয় হল প্রথমে বিকাশের কথা বলে তারপরেই প্রচারকে হিন্দুত্ববাদের দিকে নিয়ে যাওয়া৷ তিন নম্বর ফর্মুলা হল বিরোধী দলের নেতাদের ভাঙানো, আর ছোট ছোট কিছু দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলানো, তাদের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট বাগানো।
এ বাংলাতেও সেই ফরমুলা প্রয়োগ হয়েছিল, চার্টাড ফ্লাইটের কথা নিশ্চই ভোলেননি? এরপর তারা রাজবংশীদের কিছুটা বোঝাতে পেরেছিল, অন্তত লোকসভায় পেয়েছিল পাহাড়ের নেতাদের, উত্তর প্রদেশ বা হিন্দি হার্ট ল্যান্ডেও একই ছবি, অসংখ্য ছোট ছোট দলকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে সঙ্গে রাখা আর ক্ষমতার ছিটেফোঁটা ভাগ দেওয়া, সে ফরমুলাও দারুণ কার্যকরী, আমাদের উত্তরবঙ্গতে কাজ করেছে, কিন্তু এ ফরমুলা বেশিদিন কাজ করে না, এসব ছোট দলের শরিকরা কদিন পরেই বুঝে যান, তাদের কেবল ব্যবহার করা হচ্ছে, উত্তর প্রদেশের দিকে তাকান, সুহেলদেব পার্টির ওম প্রকাশ রাজভড় এখন সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে, অপনা দলেরও এক অংশ সরে এসেছে, আমাদের বাংলার পাহাড়ের নেতারা সরে এসেছেন, এই মুহূর্তে রাজবংশী নেতাদেরও ঘুম ভেঙেছে। এই তিন অস্ত্র নিয়ে, বিজেপি আবার উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে নেমেছে, কিন্তু মোদি-শাহের এই তিন ফরমুলাই এখন তেমন কার্যকরী নয়, বা বিরোধী নেতারা বুঝে ফেলায় তার ভার কমেছে, উত্তর প্রদেশে একই ফরমুলা কপি করে ফেলেছেন অখিলেশ যাদব। এবারের উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফলাফল তা প্রমাণ করবে। এবং হ্যাঁ এই ফরমুলা প্রয়োগের আগে, মোটাভাই অমিত শাহ প্রত্যেকবার দেড়শ পাব, তিনশ পাব, সরকার বানাবো বলে পথচলা শুরু করেন, এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়, বলেছেন উত্তরপ্রদেশে তিনশো পাবো, বাংলায় বলেছিলেন ২০০ পার। পেয়েছিলেন ৭০, উত্তরপ্রদেশে ১৩০ পার করতে পারবেন? যথেষ্ট সন্দেহ আছে।