ভারত ব্যর্থ। কোহলিরা বিপর্যস্ত। কেন? দায় শুধুই ক্রিকেটারদের? সব দেশে কি তাই হয়? কিন্তু এমনটা ভারতে হয়। পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটো ম্যাচে পরপর হার, অনেক প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
টাকা আগে না ক্রিকেট আগে? টাকা , নাকি আগে দেশের সম্মান?
বিসিসিআই কে দেখলে আর চালচলনে নজরে রাখলে, বোঝাই যায় টাকা আর টাকাই শুধু বোঝে দেশের এই সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া সংস্থাটি। এই লাইনটি পড়লে পরে অনেকেই উচ্চস্বরে বলে উঠবেন: যত দোষ, নন্দ ঘোষ! খেলবে ক্রিকেটাররা, আর যত গালমন্দ ক্রিকেট কর্তাদের?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এই বোর্ড কর্তাদের জন্য আজ এই ব্যর্থতা গিলে খেলো কোহলি – রহিতদের।
আচ্ছা, বলুন তো রোহিত বিশ্বের অন্যতম সেরা টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের ওপেনার। তাঁকে জিজ্ঞেস করে এটা করা হয়েছিল? শুধু ডান হাতি আর বাম হাতের মিশেল দিয়ে বৈতরণী পার হয়! বোল্টের বাঁহাতের বলে কি শাহিন শাহ আফ্রিদির মন্ত্র ঢুকে ছিল? — যে আগে ভাগে বোল্টের শিকার না হতে দেওয়ার ভাবনা ভাবতে হল? রোহিত তো বিশ্বসেরাদের একজন ব্যাটসম্যান যিনি সব দেশের বোলারদের সামলেছেন। তাহলে, নিউজিল্যান্ড ম্যাচে কেন রোহিত তিন নম্বরে? কেন বিশ্বসেরাদের তালিকায় থাকা তিন নম্বর স্লট ছেড়ে চারে গেলেন কোহলি?
কে কে — কার এই টিপসে বদলে গেল দলের ব্যাটিং অর্ডার! কোনও একজন নয়, এই ভাবনার পিছনে এক গুচ্ছ মাথা আছে। আজ এর উত্তর চাই। ১৩০ কোটি ভারতবাসী এর সত্যিটা জানতে চায়। কেউ সৎ সাহস দেখবেন? রবি , আপনি? মেন্টর মাহি? সভাপতি সৌরভ?
সকলে নীরব । এখনও। আর কোহলি ম্যাচ শেষে বলে গেছেন, ‘ব্যাটিং আর বোলিং – কোনোটাই আমরা পারিনি। আমরা ব্যর্থ’। ব্যাস!
বিসিসিআই তো আরও দুটো আইপিএল দল বাড়িয়ে পরের ১০ বছরের জন্য ওই দুই দলের থেকে বারশো (১২০০) কোটি টাকা পেয়ে গেলো। পরের বার থেকে টিভি রাইটস বাবদ আরও বেশি অর্থ মিলবে। সেখানেও শোনা যাচ্ছে, আবার কয়েকশো হাজার কোটি টাকা।
‘গুজ্জু’ চতুর ব্যবসায়ীরা দেশের ব্যবসায় দারুণ সফল। বিসিসিআই তো এখন তাঁদেরই হাতে। আগেও ছিল। কিন্তু হালে যা হয়েছে, ভেবেছিলাম ক্রিকেট নিয়ে ছেলেখেলা হবে না। এ তো দেখছি, সোনার ডিম দেওয়া হাঁসটাকে তো কেটে ফেলার সামিল!
একে করোনা অতিমারি। সঙ্গে বায়ো বাবলের মতো অতি জটিল এক লক্ষ্মণ গণ্ডি। সামান্য ভুলে ‘সীতা হরণ’ পর্বের মতন ঘটনা ঘটেও যায়। করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েন ক্রিকেটাররা। তবু সুস্থ হয়ে আবার খেলতে হয়। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা। অনেক ক্রিকেটার বা অন্য খেলার লোকজন সরে যাচ্ছেন খেলা থেকে। পেশাদারদেরও বেদম অবস্থা হচ্ছে। কিন্তু ক্রিকেট চলতে হবে। মাস্ট। মানি – ফার্স্ট।
The message from a Team India fan is loud & clear. @BCCI @imVkohli
Via Sashanka Chakraborty pic.twitter.com/QI56XlJGm3
— Prathap Simha (@mepratap) November 1, 2021
কেউ অস্বীকার করতে পারবেন, আইপিএল পার্ট টু সামলে বিশ্বকাপে খেলতে নেমে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতীয় ক্রিকেটেররা ? ক্রিকেটাররাও জানেন। সকলে সাফল্য চান। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন নম্বরে নেমে রোহিত হিট নিলেন। সহজ ক্যাচ ডিপ ফাইন লেগে। কিন্তু ক্যাচ মিস। ক্যামেরা দেখিয়ে দিল, গ্যালারীতে বসা রোহিতের বউকে সান্ত্বনা দিলেন সঙ্গে বসা অন্য ক্রিকেটারদের স্ত্রীরা। অর্থাৎ ব্যর্থ হওয়াই চলবে না। রোহিতের ভালো মন্দ সবই ওঁর স্ত্রীকে মাঠে বসে নিতে হয়। মোটা টাকার চুক্তিতে পেশাদার ক্রীড়া সংস্থাটিতে এই দায় কে নেবে?
আগে থেকেই সব সাজিয়ে রেখেছিল, বিসিসিআই। আইপিএল পার্ট টু শেষ হবে। তিনদিন মাঝে ফাঁক রেখে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আয়োজক হয়ে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরু করে দিল। ভারত দারুণ আয়োজক – এই প্রশংসা বোর্ড কর্তারা বেজায় পছন্দ করেন। দলের কি হল, তাতে কি আসে যায়। এত ম্যাচ খেলে টিম ইন্ডিয়া, একটা হারার পর — আবার জয় এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সে প্রতিপক্ষ যেই হোক। নামিবিয়া, স্কটল্যান্ড , আফগানিস্তান – সে যেই হোক। এইটা বুঝে গেছেন কর্তারা।
আসলে, স্রেফ একজনের জন্য আশায় বুক বাঁধা ছিল। কেন ‘ছিল’ লিখলাম, এটা পরের অংশে পড়লেই বুঝতে পারবেন। দেশের অন্যতম সফল অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ম্যাচ ফিক্সিং জলের মধ্য জড়িয়ে থাকা ভারতীয় ক্রিকেটকে তিনি আর তাঁর দলবল টেনে বের করে নিয়ে গিয়েছিল। তাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বিসিসিআই এর সভাপতি হতেই আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। আর যাই হোক – দেশের ক্রিকেট নিয়ে ছেলেখেলা হবে না। কিন্তু এ কি !
টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলছে, তিনি এখন বোর্ড সভাপতি, তাঁর বিজ্ঞাপন চলছে ম্যাচের ফাঁকে ফাঁকে। কিসের বিজ্ঞাপন? অনলাইনে গেমের। ব কলমে যা বেটিংয়ের অন্য চেহারা। লাখ লাখ আর কোটি কোটি টাকা জেতার প্রলোভন। শুধু দল বানাও, টাকা কামাও।
জাতীয় দলের অন্যতম স্পনসর এমনই এক স্বপ্নের ( Dream) সওদাগর। সেও এক অনলাইন গেম। সবটাই খেলা। সকলে বুঁদ হয়ে খেলছে। কিন্তু তা যন্ত্রের মত। আবেগ কম। দায়বোধ নেই। সেই সব শুধু দর্শকদের। ভারতীয় দলের সমর্থকদের।
সৌরভের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, আচ্ছা আপনি কোহলির জায়গায় থাকলে এমনটা হতে দিতেন? এই যে আইপিএলে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলার পরই, জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নেমে যাওয়া? আপনিও কি কোহলির মত ঘাড় কাত করে মেনে নিতেন? এটা বিশ্বকাপ। আগে শুনতাম , এশিয়া কাপ হলেও ভারতীয় দলের প্রস্তুতি শিবির হত। বিশ্বকাপ তো বড় মঞ্চ। দেশের সুনাম নিয়ে লড়াই। পারতেন এভাবে নেমে পড়তে? এখন মুখে কি বলবেন তা জানার আর ইচ্ছে নেই, মনের কথা বলতে পারি— রাজিই হতেন না। যে কোনও বিশ্বকাপের আগে দেশের অন্য যে কোনও ক্রীড়া সংস্থা প্রস্তুতি শিবির করে। বোর্ড আর এসব নিয়ে ভাবেই না। দেশের তারকাদের দিয়ে খেলিয়ে নিতে হবে। টিভি সম্প্রচার সংস্থারা খুশি। স্পন্সরদের মুখে হাসি। আর বোর্ডের কোষগারে অর্থই অর্থ।
তাইতো পাকিস্তানের কাছে, ১০ উইকেটে হারার পর , আবার নিউজিল্যান্ডের কাছে ৮ উইকেটে হার। বোর্ড সচিব জয় শাহ বোঝেন কি মেন্টর দলকে রাতারাতি চ্যাম্পিয়ন বানাতে পারে না! চেন্নাই সুপার কিংস দলের নেতা হয়ে এবারও আইপিএল জিতেছেন ধোনি। নিজে খেলেছেন, দলকে খেলিয়েছেন। এই ধরনের প্রাকটিক্যাল মেন্টর তো সফল হবে, স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক ছবি যে ধরা পড়লো না আম জনতার চোখে। ধোনিকে পেয়ে দলের এক অংশ চলে গেলো তাঁর চারপাশে। আরেক অংশ নেতা কোহলির সঙ্গে। আরেক অংশ আগামী দিনের নেতা , এই দলের সহ নেতা রোহিতের সঙ্গে। আর শাস্ত্রীয় হেড কোচ? তিনি তো গান গেয়েই রেখেছেন , নুতন করে আর কিছু তাঁর পাওয়ার নেই। দলের অনেকটাই জানে, এরপর চার বছর ‘রাহুল’ ভাই আসছেন। রবি অস্ত যায়। তাই, সাপোর্ট স্টাফদের নিয়ে ওঠা বসা।
বোর্ড কর্তারা ঠিক করেননি, টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কে এতটা হালকা ভাবে নিয়ে। জমাট বাঁধা এই দলটাই যেন কেমন অচেনা। কেমন যেন, মনে হচ্ছে চূড়ান্ত মানসিক ক্লান্ত একঝাঁক শরীর। যন্ত্রের মত চলছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, দল নির্বাচন:
সৌরভ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, লিখেছেন — নেতা হয়ে তিনি কতোটা মরিয়া ছিলেন এক ইংল্যান্ড সফরে ছন্দে না থাকা অনিল কুম্বলেকে নিয়ে যেতে। কুম্বলে না পেলে, মিটিং রুম ছেড়ে বেরুবেন না এমনটাই বলেছিলেন। তিনি শেষমেষ কুম্বলে পান। সেই কুম্বলে ভেল্কি দেখান। দলের সেরা বোলার হন। বিদেশের মাটিতে জয় মেলে। আচ্ছা, বিরাট কি এসব কিছুই করেন না? নাকি রবিও সরব হন না? তাই চাহালের মত কেউ টিকিট পান না। আবার দলে থেকেও , টিম ম্যানেজমেন্ট ভালো বোঝে বলে – অভিজ্ঞ অশ্বিনকে খেলানো হয় না!
অর্থই যদি সব হয়, ব্যর্থতায় মাহিনা কাটা হোক। কেন হবে না?
অমুক সিরিজ দারুণ ভাবে জিতেছে। বোর্ডের ঘোষণা মিললো: কোটি খানেক টাকা পাবে দল।
তাহলে হারলে, ব্যর্থ হলে কেন টাকা কাটা যাবে না?
মেনে নিচ্ছি, নিউজিল্যান্ড ম্যাচে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা যখন ব্যাটিং করছিল, তখন ২২ গজের উইকেটটা ডবল পেস হয়েছিল। এমন উইকেটেই তো জাত চেনাতে হয়। বিরাট, রোহিত, ঋষভ, রাহুলদের আউট দেখে মনে হচ্ছিল – ভুতুড়ে চাপ নিয়ে ব্যাটিং করছে। চাপ করতে, বেমক্কা চালিয়ে দিয়ে লাক ট্রাই করতে চেয়েছিল। সেই হার্দিক! কি দিলেন দলকে? জাদেজা রাজপুত মেজাজে ব্যাটটি না চালালে, দলের রান ১০০ টপকাতো না।
টিভিতে ম্যাচ দেখতে দেখতে বিজ্ঞাপনের হিড়িকে দেখলাম, এই দলের বেশ কিছু ক্রিকেটারের ছেলেবেলার ঝলক। টিম স্পনসরের বিজ্ঞাপন। মনে হচ্ছিল, ঠিক তো – এত ভাবে, খরচ করে এসব বানানো, সেইসব ক্রিকেটার মাঠের বাইরে বসবে কি ভাবে! তাই কি আনফিট পান্ডিয়া খেলেই যাচ্ছেন? বুমরাহ কি আর সময় পান, নিজের বোলিং আরও শানিয়ে নেওয়ার?
প্রতিপক্ষের ইশ সোধিকে দেখে মনে হচ্ছিল, এমন স্পিনার যাকে খেলাই দুষ্কর! তিনি তাঁর জন্মদিনে চওড়া হাসি নিয়ে মাঠ ছাড়লেন। ভাবা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাটিং নির্ভর দল, ৭১ টি বলে ( টি টোয়েন্টিতে ৬ থেকে ১৭ ওভারের মাঝে) একটিও বাউন্ডারি মারতে পারেনি! এত ভালো বোলিং হল! একটা সত্যি এই বিশ্বকাপে দেখিয়ে দিচ্ছে, জীবন যুদ্ধ কি তা জানা থাকলে লড়াইয়ের চেহারাটাই আলাদা হয়ে যায়। আফগানিস্তান দেখাচ্ছে তা। আসিফ আলি যা পারেন, আমাদের পাণ্ডিয়া তা যখন পারেন না – তাহলে এত তোষামোদ কেন! তাহলে কি বাইরের অঙ্ক এইসব ক্রিকেটারদের শক্তি?
রাহুল আরও ‘ওয়াল’ সাজান:
আর কিছু না ভাবাই ভালো। অন্য দলের অঙ্কের ওপর ভরসা করে, সেমি ফাইনালে ওঠা সেটা এই টিম ইন্ডিয়ার লজ্জা। পরপর দুটি ম্যাচের ব্যর্থতা – এর কোনও তদন্ত কমিশন হবে না। রাহুল, আপনি যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন – তা জানি। আপনি কোনো আপোষে নাম লিখিয়েছিলেন, মনে নেই। চ্যাপেলের সঙ্গে চলেও বুঝিয়েছিলেন আপনি ক্রিকেট নিয়ে ছেলেখেলা করবেন না। সৌরভকে ওপেনার বানানোর চেষ্টা ( পাকিস্তানে) আপনি নিজে ওপেন করে রুখতে চেয়েছিলেন একসময়। আপনি অকৃতজ্ঞ নন। আপনি, জানেন দাঁতে দাঁত চেপে কিভাবে সফল হতে হয়। আপনার কাছে একটাই আবেদন, আরও চার বছর যারা টানতে পারবেন – তাঁদের জন্যও খাটুন। কিন্তু, বাকি সব ওয়াল দাঁড় করার দলে। যা সহজে ভাঙবে না। আপনি কুম্বলের মতনই হার্ড টাস্ক মাস্টার। কিন্তু আপনার কৌশলটি আলাদা। তবু বলি, আপনি বড় ভরসার মানুষ। অধিনায়কত্ব ছাড়ার মত, মাঝপথে কিছু করে বসবেন না । প্লিজ।